মহামারি কোভিড-১৯ সৃষ্ট অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবিলায় দ্বিতীয় মেয়াদে প্রণোদনার ঋণ বিতরণের ঘোষণা দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে এ ঋণ বিতরণ শুরু হলেও কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। 

তিন মাস পার হলেও বিশেষ এ প্যাকেজ বাস্তবায়নের হার এক থেকে দুই শতাংশেই ঘুরপাক খাচ্ছে। যদিও প্রথম মেয়াদে সরকারঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের প্রায় ৮০ শতাংশ বাস্তবায়নে সক্ষম হয় ব্যাংক খাত, যেখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, কোভিড-১৯ এর কারণে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য সরকারের নির্দেশনায় মোট ২৮টি প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। সবমিলিয়ে এসব প্যাকেজের অর্থের পরিমাণ এক লাখ ৩১ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে এক লাখ তিন হাজার ২৫০ কোটি টাকার নয়টি প্যাকেজ বাস্তবায়ন হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে। বছর শেষে এসব প্যাকেজের সার্বিক বাস্তবায়নের হার ছিল প্রায় ৮০ শতাংশ।

হালনাগাদ তথ্য বলছে, ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প সার্ভিস সেক্টরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল হিসেবে প্রথম মেয়াদে ৪০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছিল, যার বাস্তবায়ন হার ছিল ৮১ দশমিক ৭৫ শতাংশ। তবে ১ জুলাই থেকে দ্বিতীয় মেয়াদের প্যাকেজ বাস্তবায়ন শুরু হলেও সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ খাতে বিতরণ হয়েছে মাত্র ৫১৯ কোটি টাকা, যা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার এক দশমিক ৫৭ শতাংশ।

ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্পে (সিএমএসএমই) ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল হিসেবে ২০ হাজার কোটি টাকার ঋণসুবিধা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় মেয়াদে এখন পর্যন্ত বিতরণ হয়েছে মাত্র ৪৭৭ কোটি টাকা, যা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ২ দশমিক ৩৮ শতাংশ। 

প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট রিফাইন্যান্স স্কিম ঘোষণা করা হয়েছে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এ প্যাকেজের আওতায় এ পর্যন্ত সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৬৫টি। এ পর্যন্ত ৩৭৫ কোটি টাকার ঋণ সুবিধা পেয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো, যা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার সাত দশমিক ৫১ শতাংশ।

ঋণ হিসেবে বিতরণযোগ্য প্রতিটি প্রণোদনা প্যাকেজের জন্য গত বছরের এপ্রিলে পৃথক নীতিমালা জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নীতিমালায় বলা হয়, প্রণোদনা প্যাকেজগুলোর মেয়াদ হবে তিন বছর। তবে একজন উদ্যোক্তা কেবল এক বছরের জন্য স্বল্প সুদের ঋণ সুবিধা ভোগ করবেন। ঋণ বিতরণের শুরুর দিন থেকে এক বছর পার হলে সে ঋণের বিপরীতে সরকার থেকে কোনো সুদ ভর্তুকি দেওয়া হবে না। ঋণটি আদায় না হলে তা বিতরণকারী ব্যাংকগুলোর স্বাভাবিক ঋণ বলে গণ্য হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জারি করা নীতিমালার আওতায় এরইমধ্যে বৃহৎ শিল্প ও সেবা খাতের জন্য ঘোষিত ৪০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে বিতরণ করা বেশিরভাগ ঋণের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। এজন্য দ্বিতীয় মেয়াদে ওই প্যাকেজ থেকে ঋণ বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ প্যাকেজ থেকে একজন উদ্যোক্তা তার ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ ঋণ নিতে পারবেন। অর্থাৎ যদি কোনো উদ্যোক্তা এরইমধ্যে ৩০ শতাংশ ঋণ নিয়ে থাকেন, তাহলে তিনি দ্বিতীয়বার প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে কোনো ঋণ নিতে পারবেন না। প্রথমবার যদি কোনো উদ্যোক্তা ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের ৩০ শতাংশ অর্থ না নিয়ে থাকেন, তবে দ্বিতীয় মেয়াদে তিনি অবশিষ্ট অংশের ঋণ নিতে পারবেন বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

নির্ধারিত সময় পার হয়ে গেলেও বেশিরভাগ গ্রাহক প্রণোদনার ঋণ  পরিশোধ করতে পারছেন না। উল্টো এখন ব্যাংকের কাছে বাড়তি সময় চাচ্ছেন তারা। এতে উভয় সংকটে পড়েছেন ব্যাংকাররা। একদিকে, সময় বাড়িয়ে না দিলে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাবে, এতে বাড়তি প্রভিশন রাখতে গিয়ে কমে যাবে আয়। অপরদিকে, বাড়তি সময় দিলে ঋণ আদায়ের হার কমে যাবে। এতে প্রভাব পড়বে ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতার ওপর। 

এরপরও গ্রাহকদের চাপে বাধ্য হয়েই ব্যাংকগুলো এক বছর সময় বাড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এতেও সন্তুষ্ট নন অনেক গ্রাহক। তারা দুই বছর সময় চাচ্ছেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালার বাধ্যবাধকতায় এক বছরের বেশি সময় বাড়ানো যাবে না। সব মিলেই প্রণোদনার ঋণ নিয়ে বিপাকে পড়েছে দেশের ব্যাংকিং খাত।
 
এ প্রসঙ্গে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, জুন পর্যন্ত ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা ছিল। কিস্তির ২৫ শতাংশ দিলেই গ্রাহককে নিয়মিত রাখার নির্দেশনা দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে অনেকেই টাকা পরিশোধ করতে পারেননি। এসব কারণে দ্বিতীয় মেয়াদে ঋণ বিতরণ কম হয়েছে।

এসআই/আরএইচ