গত এক সপ্তাহ ধরে ইতিবাচক ধারায় রয়েছে দেশের উভয় শেয়ার বাজার। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি নতুন করে শেয়ার ব্যবসায় ঝুঁকছে অনেকে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে ইতিবাচক শেয়ার বাজারকে ‘গুড সাইন’ বলছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তবে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বনের কথাও বলছেন তারা।

গত এক মাসের (১ আগস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বর) বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, ঊর্ধ্বমুখী পুঁজিবাজারে এক দিনে বাংলাদেশ মনোস্পুল পেপার ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি লিমিটেডের ১৮০ টাকার শেয়ারে ১৬ টাকা পর্যন্ত মুনাফা করেছেন বিনিয়োগকারীরা। ন্যাশনাল টি লিমিটেডের শেয়ার ৭১১ টাকায় কিনে দুই দিনের ব্যবধানে মুনাফা পেয়েছেন শেয়ার প্রতি ১১১ টাকা।

এভাবে গত এক মাসে ওরিয়ন ইনফিউশন লিমিটেডের শেয়ার ১১৭ টাকা থেকে বেড়ে ৩১০ টাকা পর্যন্ত হয়েছে। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে প্রায় আড়াই গুণ (১৯২) মুনাফা পেয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

ডিএসইর তথ্য মতে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি ওরিয়ন ইনফিউশন, ইস্টার্ন হাউজিং, ডেল্টা লাইফ, লাফার্জহোলসিম, মেট্রো স্পিনিং মিলস এবং ম্যাকসন স্পিনিং মিলস কোম্পানিসহ সাড়ে ৩০০ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম বেড়েছে। তাতে ১ আগস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বর সময়ে ১৮ লাখ ৪৩ হাজার ৩৪১ জন বিনিয়োগকারীদের মুনাফা হয়েছে ১৬ হাজার ৮৫৬ কোটি ৩৩ লাখ ৫ হাজার টাকা।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশ ও বিশ্ব অর্থনীতি মন্দায় দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মানুষ দিশেহারা। ডলারের মূল্য বৃদ্ধি ও সব কিছুই মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ায় বেঁচে থাকার জন্য সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন। ঠিক সেই সময় রাতারাতি এমন মুনাফায় আবারও পুঁজিবাজারে ফিরতে শুরু করেছেন বিনিয়োগকারীরা। ফলে সর্বশেষ মাসে প্রায় ১০ হাজার নতুন বিনিয়োগকারী বাজারে ফিরেছেন।

অর্থনীতির এই দুঃসময়ে পুঁজিবাজারের উত্থান বিনিয়োগকারীদের জন্য আর্শীবাদ বলে মনে করেন ইউসিবি ক্যাপিটালের বিনিয়োগকারী এনামুল হক শামীম। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ব্যাংকগুলো এখন আমানতের বিপরীতে সুদ দিচ্ছে মাত্র ৫ থেকে ৬ শতাংশ। সঞ্চয়পত্রে সুদ দিচ্ছে মাত্র ৯ শতাংশ। সেখানে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে এক মাসে মুনাফা পাওয়া যাচ্ছে দ্বিগুণ। এর চেয়ে ভালো খবর আর কী হতে পারে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) চেয়ারম্যান ইউনুসুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, পুঁজিবাজার হচ্ছে দেশের অর্থনীতির আয়না। এটা দেখে বুঝা যায় যে দেশের অর্থনীতির অবস্থা কেমন।

তিনি বলেন, ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধ, ডলার ও জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ইস্যুকে কেন্দ্র করে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে পুঁজিবাজারে নেতিবাচক ধারায় লেনদেন হয়েছে। এখন ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। মুনাফা পেতে হলে সতর্কতা ও ধৈর্য জরুরি বলেও মনে করেন দিনি।

চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, পুঁজিবাজারে শেয়ারের দর ওঠা-নামা করে। বিশ্বজুড়ে এটাই নিয়ম। এখানে যারা লোভ সংযত করে ব্যবসা করেন তারাই মুনাফা করবে। 

তিনি বলেন, আমাদের বাজারে ২০ শতাংশ মানুষ মুনাফা করেন আর ৮০ শতাংশই লোকসান করেন। কারণ তারা হুজুগে পড়ে শেয়ার কেনা-বেচা করেন। ফলে দিন শেষে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হন।

ডিএসইর পরিচালক শাকিল রিজভী ঢাকা পোস্টকে বলেন, দীর্ঘ মেয়াদী বিনিয়োগ করলেই পুঁজিবাজার থেকে সব সময়ই ভালো মুনাফা আসবে। সেজন্য ধৈর্য ধরতে হবে, কোম্পানির অবস্থান এবং সঠিক তথ্য জেনে বুঝে বিনিয়োগ করতে হবে। তাহলে সব সময় পুঁজিবাজার থেকে ভালো মুনাফা অর্জন করা সম্ভব।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিনিয়োগকারীরা যাতে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে ভালো মুনাফা করতে পারেন সেই চেষ্ঠা আমাদের অব্যাহত রয়েছে। 

তিনি বলেন, একটু দেখে-শুনে বিনিয়োগ করলেই ব্যাংক কিংবা সঞ্চয়পত্রের চেয়ে বেশি মুনাফা পুঁজিবাজার থেকে অর্জন করা সম্ভব।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বেশ কিছুদিন দরপতন হয়েছে। এখন শেয়ারের দাম বাড়ছে এটা পুঁজিবাজারের জন্য পজিটিভ। কিন্তু দেখতে হবে দুর্বল মৌলভিত্তি কোম্পানির শেয়ার যাতে না বাড়ে। এই শেয়ারের দাম বাড়লে লোভে পড়ে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করেন। পরে ক্ষতিগ্রস্ত হন।
তাই বিনিয়োগকারীদের ভালো কোম্পানি দেখে বিনিয়োগের আহ্বান জানান তিনি।

ডিএসইর তথ্য মতে, বাংলাদেশ মনোস্পুল পেপার ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি লিমিটেড শেয়ারের দাম ৩১ আগস্ট সর্বশেষ লেনদেন হয়েছে ১৮০ টাকা ৭০ পয়সাতে। সেই শেয়ার ১ সেপ্টেম্বর লেনদেন হয়েছে ১৯৬ টাকা ৮০ পয়সা। অর্থাৎ কোম্পানিটির ৯৩ লাখ ৮৮ হাজার ৮২৫টির মালিকরা একদিনের ব্যবধানে শেয়ার প্রতি ১৬ টাকা ১০ পয়সা করে মুনাফা পেয়েছেন।
একইভাবে ২৮ আগস্ট ৭১১ টাকায় সর্বশেষ লেনদেন হয়েছে ন্যাশনাল টি লিমিটেডের শেয়ার। ২৯ ও ৩০ এ দুই দিনে শেয়ারটির দাম ১১১ টাকা বেড়ে বিক্রি হয়েছে ৮২২ টাকায়। অর্থাৎ কোম্পানটির ৬৬ লাখ শেয়ারের মালিকরা মুনাফা পেলেন ১১১ টাকা করে।

এক, দু’দিন, কিংবা তিন নয় টানা এক মাস ধরে দাম বেড়েছে ১৯৯৪ সালে তালিকাভুক্ত ওরিয়ন ইনফিউশন লিমিটেডের শেয়ার। ১ আগস্ট প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারটির মূল্য ছিল ১১৭ টাকা ৭০ পয়সা। সেখান থেকে ১৯২ টাকা ৬০ পয়সা বেড়ে ১ সেপ্টেম্বর সর্বশেষ লেনদেন হয়েছে ৩১০ টাকা ৩০ পয়সাতে। অর্থাৎ প্রায় আড়াই গুণ দাম বেড়েছে।

এতে কোম্পানির ২ কোটি ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৭৬০টি শেয়ারহোল্ডারদের মুনাফা হয়েছে ৩৯২ কোটি ১২ লাখ ৮৯ হাজার ৭৭৬ টাকা। আর ২০ কোটি ৩৬ লাখ টাকার কোম্পানি বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে ৬৩১ কোটি ৭৬ লাখ ৩৩ হাজার ৫২৮ টাকায়।

ম্যাকসন স্পিনিং মিলস লিমিটেড কোম্পানির এক মাস আগে শেয়ারের দাম ছিল ২৩ টাকা ৫০ পয়সা, সেখান থেকে ৭ টাকা ৬০ পয়সা বেড়ে লেনদেন হয়েছে ৩১ টাকা ১০ পয়সা। ২৩ কোটি ৮২ লাখ ৩২ হাজার ৫৩৮ টি শেয়ারধারীদের বেড়েছে ১৮১ কোটি ৫ লাখ ৬৭ হাজার ২৮৮ টাকা।

মেট্রো স্পিনিং কোম্পানির শেয়ার ৬ কোটি ১৬ লাখ ৯৮ হাজার ২৭৫টি শেয়ার রয়েছে। ১ আগস্ট শেয়ারটির দাম ছিল ২৫ টাকা ৯০ পয়সা। সেখান থেকে এক মাস ১৯ টাকা ৭০ পয়সা বেড়ে ১ সেপ্টেম্বর লেনদেন হয় ৪৫ টাকা ৬০ পয়সায়। তাতে কোম্পানির বিনিয়োগকারীদের মুনাফা হয়েছে ১২১ কোটি ৫৪ লাখ ৫৬ হাজার ১৭ টাকা।

বহুজাতিক কোম্পানি লাফার্জহোলসিমের শেয়ারের দাম এক মাসে বেড়েছে ১৫ টাকা ৫০ পয়সা। প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার গত ২৮ জুলাই সর্বশেষ লেনদেন হয়েছিল ৬৩ টাকা ৫০ পয়সা। সেই শেয়ার ৩১ আগস্ট লেনদেন হয়েছে ৭৯ টাকা। অর্থাৎ প্রতি শেয়ার মুনাফা হয়েছে ১৬ টাকা ৫০ পয়সা করে। তাতে কোম্পানির ১১৬ কোটি ১৩ লাখ ৭৩ হাজার ৫০০টি শেয়ারের মালিকের মুনাফা হয়েছে ১৮০০কোটি ১২ লাখ ৮৯ হাজার টাকা।

ইস্টার্ন হাউজিং শেয়ার ৯২ টাকা ২০ পয়সাতে লেনদেন হয়েছে। কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়তে শুরু করে ২৮ জুলাই থেকে। সেদিন শেয়ারটির সর্বশেষ লেনদেন হয়েছি ৫২ টাকা। সে হিসেবে কোম্পানটির মালিকরা শেয়ার ৪০ টাকা ২০ পয়সা করে মুনাফা পেয়েছেন। যা প্রায় দ্বিগুণ।

বিমা খাতের কোম্পানি ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারের দাম সর্বশেষ ১ আগস্ট ছিল ১৪২ টাকা ৭০ পয়সা। সেখান থেকে ২৫ টাকা ৬০ বেড়ে সর্বশেষ লেনদেন হয়েছে ১৬৮ টাকা ৩০ পয়সা। তাতে ১২ কোটি ৩৭ লাখ ৫০ হাজার শেয়ারের মালিকদের মুনাফা হয়েছে ৩১৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা।

এমআই/এসএম