মিছে মিছে সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশ করে পাঁচ টাকার শেয়ারের দাম ১১৯ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়েছেন। এরপর তিনি ও তার গ্রুপের সদস্যদের শেয়ার বিক্রি করে পুঁজিবাজার থেকে সাড়ে ৭৪ কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন। ঘটনাটি ২০০৯ সালের। এরপর এক যুগ পার হয়েছে, শেয়ার কারসাজির মূলহোতাও মৃত্যুবরণ করেছেন।

এখন পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) প্রমাণ করেছে, এটি ছিল শেয়ার কারসাজি। এজন্য মৃত ব্যক্তির সাজা মাফ করে দেওয়া হয়েছে। আর জীবিত ব্যক্তিদের লোক দেখানো জরিমানা করেছে কমিশন।

বিএসইসির তথ্য অনুসারে, মিথ্যা সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশ করে ২০০৯-১০ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি বিচ হ্যাচারি লিমিটেডের শেয়ারের দাম বৃদ্ধি করা হয়। এই কাজে জড়িত ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরিফুল ইসলাম, তার স্ত্রী ও পরিচালক ফাহমিদা ইসলাম, পরিচালক সাঈদ নুর আহমেদ, করপোরেট পরিচালক মেঘনা শ্রিম্প কালচার ও যুব কর্মসংস্থান সোসাইটি (অব)।

তারা ২০০৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর থেকে ২০১০ সালের ২৭ মে পর্যন্ত সময়ে শেয়ার বিক্রি করে প্রায় সাড়ে ৭৪ কোটি টাকা পুঁজিবাজার থেকে তুলে নিয়েছেন, যা কোম্পানিটির শেয়ারের ৩৩ শতাংশের বেশি। এছাড়াও দুজন বিনিয়োগকারী এই অপরাধে জড়িত ছিলেন।

পৌনে ১০০ কোটি টাকা তুলে নেওয়া অপরাধীদের কমিশন জরিমানা করেছে মাত্র ১ কোটি টাকা। অর্থাৎ শত কোটি টাকা অবৈধভাবে ব্যবসা করে মাত্র এক কোটি টাকা জরিমানায় বৈধ হলো ব্যবসা।

বিএসইসি তদন্ত প্রতিবেদনের মাধ্যমে প্রমাণ করে যে বিচ হ্যাচারি ২০০৯ সালের শেষ দিকে চারটি স্টিল বড়ির ট্রলার কেনার ঘোষণা দেয়। এই সংবেদনশীল তথ্য গণমাধ্যম এবং স্টক এক্সচেঞ্জে প্রকাশ করা হয়। আর এ খবরে বিচ হ্যাচারির শেয়ার ৫ টাকা ৮০ পয়সা থেকে বেড়ে ১১৯ টাকা ১০ পয়সা হয়ে যায়।

এরপর ট্রলার কেনার সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়। কিন্তু ট্রলার কেনার সিদ্ধান্ত বাতিলের এই মূল্যসংবেদনশীল তথ্য প্রকাশ করেনি কোম্পানি কর্তৃপক্ষ। বরং অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির এই সুযোগে বিচ হ্যাচারির তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরিফুল ইসলামের নেতৃত্বে ২০০৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর থেকে ২০১০ সালের ২৭ মে পর্যন্ত সময়ে পরিচালকরা তাদের হাতে থাকা ৭৪ লাখ ৪১ হাজার ৬০০টি শেয়ার বিক্রি করে দেন।

এর মধ্যে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরিফুল ইসলাম ৪১ লাখ ১৫ হাজার, পরিচালক ফাহমিদা ইসলাম ৬ লাখ ৮৪ হাজার ৮০০টি, কর্পোরেট পরিচালক মেঘনা শ্রিম্প কালচার ৭ লাখ ২৫ হাজার, পরিচালক সাঈদ নুর আহমেদ ৫ লাখ, পরিচালক নজরুল ইসলাম (অব.) ১ লাখ ৮৪ হাজার ৮০০টি ও করপোরেট পরিচালক যুব কর্মসংস্থান সোসাইটি (অব.) ১২ লাখ ৩২ হাজার শেয়ার বিক্রি করে, যা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অধ্যাদেশের ১৭ (এ), (বি) ও (সি) লঙ্ঘন।

এই আইনে বলা হয়েছে, কোম্পানির মূল্যসংবেদশীল তথ্য ওইদিন পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা, স্টক এক্সচেঞ্জ এবং গণমাধ্যমে প্রকাশ করতে হবে। বাতিল করলেও সেই তথ্য প্রকাশ করতে হবে।

তদন্ত প্রতিবেদনে প্রমাণ হয়, ৪১ লাখ শেয়ারের মধ্যে কারসাজির মাধ্যমে শরিফুল ইসলাম ২৩ কোটি ২২ লাখ টাকা, করপোরেট পরিচালক মেঘনা শ্রিম্প কালচার ৪ কোটি ৪৫ লাখ টাকা, পরিচালক সাঈদ নুর আহমেদ ৩ কোটি ৮ লাখ টাকা, পরিচালক নজরুল ইসলাম (অব:) ৯৩ লাখ টাকা ও করপোরেট পরিচালক যুব কর্মসংস্থান সোসাইটি (অব.) ৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা তুলে নেয়।

এই অপরাধে প্রথমে বিএসইসির পক্ষ থেকে পরিচালকদের শুনানিতে ডাকা হয়। পরিচালকদের মধ্যে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিএসইসিতে ২০১৫ সালের ১৪ মে কোম্পানির পক্ষ থেকে লিখিত বক্তব্য তুলে ধরেন।

বক্তব্যে পরিচালক বলেন, ট্রলার কেনার সিদ্ধান্ত আমরা নিয়েছিলাম। কিন্তু বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের অর্থায়নে অনিচ্ছার কারণে ট্রলার কিনতে পারিনি। তার বিকল্প হিসেবে পুঁজিবাজারে একটি সাধারণ শেয়ারের বিপরীতে দুটি রাইট শেয়ার ইস্যুর সিদ্ধান্ত নিলেও তার অনুমোদন দেওয়া হয়নি। ফলে ট্রলার কিনতে পারিনি।

তিনি বলেন, পুঁজিবাজারে শেয়ারের দাম ওঠানামার ঘটনা স্বাভাবিক। ১৯৯৬ সালের ধসের পরে ২০০৯ সালে বিচ হ্যাচারির ইপিএস, এনএভি ও ডিভিডেন্ড ইল্ড ভালো ছিল। শুধু আমাদের কোম্পানিই নয় ২০০৯ সালে পুঁজিবাজার ছিল বুমিং, সেখানে সব খাতের শেয়ারের দাম বেড়েছে। ফলে সব খাতের শেয়ারের পাশাপাশি বিচ হ্যাচারির শেয়ারের দাম বেড়েছে।

তিনি লিখিত বক্তব্যে আরও বলেন, পরিচালকরা সঠিক সময়ে সঠিকভাবে ডিসক্লোজার দিয়েছি। সব নিয়ম মেনেই মাত্র ৫৫ টাকা গড়ে প্রতিটি শেয়ার বিক্রি করেছেন পরিচালকরা। কারসাজির ইচ্ছা থাকলে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ১১৯ টাকা ৪০ পয়সা হয়েছিল তখনি করতে পারত। 

কমিশন পরিচালকদের এই ব্যাখ্যায় খুশি হতে পারেনি। বরং ১৭ মে পুঁজিবাজারের শৃঙ্খলা, স্বচ্ছতা ও জনস্বার্থে সাবেক এমডি শরিফুল ইসলাম, তার স্ত্রী ও পরিচালক ফাহমিদা ইসলাম, করপোরেট পরিচালক মেঘনা শ্রিম্প কালচার, পরিচালক সাঈদ নুর আহমেদকে জরিমানা করার সিদ্ধান্ত নেয় বিএসইসি। তবে জরিমানার চিঠি পাঠানোর আগেই গত ৩ মে মৃত্যুবরণ করেছেন সাবেক এমডি শরিফুল ইসলাম। ফলে জরিমানা মওকুফ করা হয়েছে।

আর বাকি পরিচালকদের মধ্যে শরিফুল ইসলামের স্ত্রী ফাহমিদা ইসলামকে ১০ লাখ টাকা, করপোরেট পরিচালক মেঘনা শ্রিম্প কালচার লিমিটেডকে ২৫ লাখ টাকা ও পরিচালক সাঈদ নুর আহমেদকে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

পরিচালকের পাশাপাশি সংবেদনশীল তথ্য জেনে সিরিয়াল ট্রেনিংয়ে জড়িয়ে পড়েন ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন সার্ভিসেসের গ্রাহক এমএম মফিদুল হক ও এনবিএল সিকিউরিটিজের মোহাম্মদ সাইফ উল্লাহ। তারা একাধিক বেনিফিশিয়ারি অ্যাকাউন্ট (বিও) হিসাবের মাধ্যমে কারসাজি করেন।

দুই বিনিয়োগকারীর মধ্যে মফিদুল হক প্রথমে ২০০৯-১০ সালে ৬ লাখ ৪৮ হাজার শেয়ার গড়ে প্রতিটি ৯৪ টাকা ০৩ পয়সায় বিক্রি করেন, যা অংকে ৬ কোটি ৩৬ লাখ ৯৮ হাজার ৪০০ টাকা। এটি সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অধ্যাদেশ, ১৯৬৯ এর ধারা ১৭ (ই)(৩) ও (৫) এর লঙ্ঘন। এজন্য তাকে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

তার আগে ২০১৪ সালের ২৬ অক্টোবর বিএসইসি বিনিয়োগকারী মফিদুল হককে তলব করে। তিনি সময় চেয়ে আবেদন করেন। সময় বাড়িয়ে ২০১৫ সালের ১৯ এপ্রিল থেকে ১৪ মে পর্যন্ত নির্ধারণ করেন। তারপর আবারও সময়ে চেয়ে আবেদন করেন তিনি। কিন্তু কমিশন আর সময় দেয়নি। বরং তাকে শেয়ার কারসাজির অপরাধে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। জরিমানার টাকার চিঠি দেওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে বিএসইসিতে জমা দিতে বলা হয়। তা না হলে বিও হিসাব স্থগিত এবং ওই বিও হিসাবের সিকিউরিটিজ বিক্রি করে জরিমানার টাকা নিয়ে নেওয়া হবে।

একইভাবে এনবিএল সিকিউরিটিজের বিনিয়োগকারী মোহাম্মদ সাইফ উল্লাহ বিচ হ্যাচারির শেয়ারে কারসাজি করেন। তিনি ০১৫৭১ নং কোড থেকে ১০৪ টাকা ৬৮ পয়সায় ৬ লাখ শেয়ার বিক্রি করে ৬ কোটি ২৮ লাখ ৮ হাজার টাকা তুলে নেন। ০১৫৯১ নং কোড থেকে ১০৫ টাকা ০৬ পয়সা করে ৫৫ হাজার শেয়ার ৫৭ লাখ ৭৮ হাজার ৩০০ টাকায় বিক্রি করেন। এরপরে ১১৬ টাকা ২০ পয়সা করে ৬ লাখ শেয়ার ৬ কোটি ৯৭ লাখ ২০ হাজার টাকায় এবং ১০৬ টাকা করে ৫৫ হাজার শেয়ার ৫৮ লাখ ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করেন।

সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ১৪ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলন করেন। এই লেনদেনের মাধ্যমে তিনি ক্রয় চাপ তৈরি করেন এবং সরবরাহ সংকট তৈরি করেন, যা শেয়ারটির দর বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলে।

এ বিষয়ে ২০১৪ সালের ২৬ অক্টোবর শুনানিতে লিখিত বক্তব্যে সফিউল্লাহ বলেন, ২০১০ সালের ২৪ নভেম্বর বিচ হ্যাচারির ১৮ লাখ ৮৩ হাজার ৫০০টি শেয়ার লেনদেন হয়েছিল। এর মধ্যে আমার কেনা শেয়ারের সংখ্যা ছিল ৬ লাখ ৫৫ হাজার। যা ওইদিনের লেনদেনের ৩৪ টাকা ৭৭ শতাংশ। এরপরে ২৫ নভেম্বর ১৮ লাখ ৭৪ হাজার ৫০০টি ও ২৮ নভেম্বর ১৩ লাখ ৬৩ হাজার শেয়ার লেনদেন হয়েছিল।

অর্থাৎ ২৪-২৮ নভেম্বরের তিন কার্যদিবসে ৫১ লাখ ১১ হাজার শেয়ার লেনদেন হয়েছিল। এ হিসেবে আমার লেনদেনের পরিমাণ ১২ দশমিক ৮১ শতাংশ। এর ফলে আমার পক্ষে বিচ হ্যাচারির শেয়ারের সংকট তৈরি করা সম্ভব ছিল না।

বিএসইসি তার ব্যাখ্যা সঠিক মনে করেনি। বরং শেয়ার কারসাজি হয়েছে বলে তাকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করেছে।

পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এক যুগ পর কারসাজি প্রমাণিত হয়েছে এটা নিঃসন্দেহে একটি ভালো খবর। তবে যে শাস্তি কিংবা জরিমানা হয়েছে। তাতে কারসাজি কমার পরিবর্তে আরও বেশি কারসাজিতে মেতে উঠবেন কারসাজি চক্রের সদস্যরা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, পুঁজিবাজারের বড় বড় অপরাধগুলোর দ্রুত বিচার হওয়ার উচিত। সিরিয়াল ট্রেডিং, মূল্য সংবেদনশীল তথ্য পাচার কিংবা মূল্য সংবেদনশীল তথ্যের নামে মিথ্যা তথ্য দেওয়া এগুলোর বিচার করা দরকার। তা না হলে বাজারে শৃঙ্খলা আসবে না। বিনিয়োগাকরীরা আস্থা পাবে না।

তিনি বলেন, দোষীদের উপযুক্ত শাস্তির আওতায় আনতে হবে। প্রয়োজনে আইন সংশোধন করে শাস্তি বাড়াতে হবে। কিন্তু কিছুতেই ক্রিমিনালদের ছাড় দেওয়া যাবে না।

এ বিষয়ে বিএসইসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে মামলাগুলো দ্রুত শেষ করতে চেষ্টা করছি। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা করে বাজারের প্রতি আস্থা বাড়াতে কাজ করছি। তিনি বলেন, ১০ বছর আগের বিষয়টি নিয়ে আমি দায়িত্ব নেওয়া পরই ব্যবস্থা নিয়েছি। লোকবল নেই বলে এতদিন কর্মকর্তারা কাজ করতে পারেননি বলে জানান তিনি।

এমআই/এসএসএইচ