ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. তারিক আমিন ভূঁইয়া

স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক বাজার গঠনে পুঁজিবাজারকে ডিজিটালাইজড করা হবে। ফলে কারসাজি চক্রের সব অপচেষ্টা আয়নার মতো পরিষ্কার হয়ে উঠবে। পার পাবে না এ চক্রের কেউ। সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হবে বিনিয়োগকারীদের। পুঁজিবাজারের পরিধি বাড়াতে ‘বাংলালিংক ও ‘ইউনিলিভার’র মতো ভালো প্রতিষ্ঠানকে তালিকাভুক্ত করা হবে। বাংলাদেশের পুঁজিবাজার হবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি মর্যাদাপূর্ণ বাজার। বিদেশিরা এখানে বিনিয়োগের জন্য আকৃষ্ট হবেন।

ঢাকা পোস্টকে কথাগুলো বলছিলেন দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. তারিক আমিন ভূঁইয়া।

দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করে আসা এ পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ ডিএসইকে ডিজিটালাইজড করতে গ্রহণ করেছেন ‘ফাইভ পি’ তথা ‘পাঁচ পি’ পরিকল্পনা। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ঢাকা পোস্টের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মাহফুজুল ইসলাম।

ঢাকা পোস্ট : ডিএসই’র নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে যোগ দিয়েছেন। কেমন লাগছে?

মো. তারিক আমিন ভূঁইয়া : আলহামদুলিল্লাহ, ভালো লাগছে। এখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাইকে খুবই আন্তরিক মনে হচ্ছে। কাজের পরিবেশও ভালো। সবমিলিয়ে ভালো সময় পার করছি।

ঢাকা পোস্ট : এমডি হিসেবে ডিএসইকে নিয়ে আপনার বিশেষ কোনো পরিকল্পনা আছে কি না?

মো. তারিক আমিন ভূঁইয়া : পুঁজিবাজারের বিদ্যমান সমস্যাগুলো সমাধান করব। সামনে যাওয়ার নতুন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করব। একটি ডিজিটাল পুঁজিবাজার গঠন করব, যাতে জিডিপিতে (মোট দেশজ উৎপাদন) পুঁজিবাজারের অবদান ৫০ শতাংশ হয়। এটি অনেক কঠিন কাজ, কিন্তু আমরা সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করব।

নতুন চ্যালেঞ্জসহ পুঁজিবাজারের সার্বিক উন্নয়নে ‘ফাইভ পি’ (পাঁচ পি) পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। এর মধ্যে রয়েছে- পিপলস, প্লাটফর্ম, প্রসেস, প্রোডাক্ট ও পলিসি। এ ‘ফাইভ পি’ বাস্তবায়ন করা গেলে ডিএসই অবশ্যই পূর্ণাঙ্গ রূপে ডিজিটালাইজড হবে।

ঢাকা পোস্ট : ‘ফাইভ পি’ (পাঁচ পি) পরিকল্পনার বিষয়ে যদি বিস্তারিত বলতেন…

মো. তারিক আমিন ভূঁইয়া : ‘ফাইভ পি’ একটি মন্ত্র। প্রথম ‘পি’ হলো- পাবলিক (জনগণ বা বিনিয়োগকারী) অর্থাৎ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা করা হবে। ডিএসই বিনিয়োগকারীদের আরও কাছে আসবে। অর্থাৎ উভয়ের মধ্যকার দূরত্ব কমানো হবে।

দ্বিতীয় ‘পি’ হচ্ছে- প্লাটফর্ম। প্লাটফর্ম মানে হচ্ছে- ডিএসই’র শেয়ার কেনা-বেচাসহ সব ধরনের বিষয়। এগুলো আরও সহজ করা হবে। যাতে বিনিয়োগকারীদের কোনো ক্ষতি না হয়। বিনিয়োগকারীরা যেন প্রতিদিনের তথ্য সঠিক সময়ে পেতে পারেন সেই ব্যবস্থা করা হবে।

তৃতীয় ‘পি’ হচ্ছে- প্রোডাক্ট। ডিএসই এখনও ইক্যুইটি বেজ পুঁজিবাজার। অর্থাৎ, এখানে কেবল কিছু কোম্পানির শেয়ার কেনা-বেচা হয়। কিন্তু বিশ্বের অন্যান্য পুঁজিবাজারে এর বাইরে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থাকে। যেমন- বন্ড, হালাল ব্যবসা অর্থাৎ শরিয়াহ ভিত্তিক কোম্পানি, ভেঞ্চার ক্যাপিটাল পণ্য ইত্যাদি পুঁজিবাজারে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। বিনিয়োগকারীরা যাতে তাদের পছন্দ মতো বিনিয়োগ করতে পারেন।

চতুর্থ ‘পি’ হচ্ছে- প্রসেস। প্রসেস বলতে বোঝায় প্রক্রিয়া। এখানে সবাই যাতে খুবই সহজে ও নির্ভুলভাবে কাজ করতে পারেন, সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

পঞ্চম ‘পি’ হচ্ছে- পলিসি। এটি দেশ, পুঁজিবাজার ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে করা হবে। যাতে সবাই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে আকৃষ্ট হন। ভালো মুনাফা পান।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. তারিক আমিন ভূঁইয়া। গত ২৫ জুলাই তিনি এখানে যোগ দেন। আগামী তিন বছর তিনি এ পদে আসীন থাকবেন। তিনি প্রশাসন ও ব্যবসা পরিচালনা, ডিজিটাল অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল টেকনোলজিসহ আইটি সেক্টরে অভিজ্ঞ।

পেশাগত জীবনে তিনি এএনজেড গ্রিন্ডলেস ব্যাংক, বাংলাদেশে গ্র্যাজুয়েট ট্রেইনি হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে আইএনজি, সেন্ট জর্জ ও ওয়েস্ট পেক, আইটি প্রতিষ্ঠান টাটা কন্সালটেন্সি সার্ভিসেস (টিসিএস), ইনফোসিস, উদ্ভাবনী পরামর্শক সংস্থা- অ্যাকসেন্টারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ২৫ বছরেরও বেশি সময় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

এছাড়া তিনি ব্র্যাক ব্যাংকের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা (সিআইও) এবং মোবাইল মানি ট্রান্সফার কোম্পানি বিকাশের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

ডিএসইতে যোগদানের আগে তিনি ফ্রেন্ডশিপ এনজিও’র তথ্যপ্রযুক্তি পরামর্শক, অস্ট্রেলিয়ার হ্যাশক্লাউড পিটিওয়াই লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা সিইও এবং সিটিপিও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি হ্যাশক্লাউড বাংলাদেশ লিমিটেডের নির্বাহী চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

ঢাকা পোস্ট : কারিগরি ত্রুটির কারণে প্রায় সময় ডিএসই’র সার্বিক লেনদেন বন্ধ হয়ে যায়। এ ধরনের ত্রুটি নিরসনে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন?

মো. তারিক আমিন ভূঁইয়া : ডিএসইতে লেনদেনের শুরু ও শেষের সময়ে শেয়ার বেচা-কেনার অর্ডার বেশি হয়। ফলে এর সফটওয়্যারের ওপর চাপ পড়ে। কারিগরি ত্রুটি দেখা যায় এবং লেনদেন বন্ধ হয়ে যায়। বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। বাজারের প্রতি তাদের এক ধরনের শঙ্কা তৈরি হয়। এটি বাজারকে প্রভাবিত করে।

উন্নত বিশ্বের পুঁজিবাজারের মতো আমাদের বাজারেও যাতে কোনো কারিগরি ত্রুটি না হয় সে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। শুধু তা-ই নয়, কারিগরি ত্রুটির কারণে লেনদেন যেন বন্ধ না হয় সেটিও দেখা হবে। বর্তমানে ডিএসই’র যে সক্ষমতা, প্রয়োজনে তা ১০০ ভাগ বাড়ানো হবে। বিনিয়োগকারীরা যেন স্বাচ্ছন্দ্যে লেনদেন করতে পারেন, সেই উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।

ঢাকা পোস্ট : দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির তুলনায় পুঁজিবাজারের আকার ছোট, আপনি এটিকে কোথায় দেখতে চান?

মো. তারিক আমিন ভূঁইয়া : আপনি ঠিকই বলছেন। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির তুলনায় আমাদের পুঁজিবাজারের প্রবৃদ্ধি কম। এখন জিডিপিতে পুঁজিবাজারের অবদান ১৯ থেকে ২০ শতাংশ। এটি বাড়িয়ে ৫০ শতাংশে উন্নীত করব। কারণ, যে দেশের পুঁজিবাজার যত উন্নত ওই দেশের অর্থনীতি তত উন্নত।

আমাদের পুঁজিবাজারের মূলধন পাঁচ লাখ কোটি টাকার কিছু বেশি। এটি উঠা-নামা করছে। জিডিপিতে দেশের পুঁজিবাজারের অবদান বাড়িয়ে ৫০ শতাংশে উন্নীত করা হবে। এটি অনেক কঠিন কাজ। তারপরও বর্তমান বাজারের মূলধন বাড়াতে উদ্যোগ নেওয়া হবে। নতুন নতুন পণ্য ও প্রতিষ্ঠানের তালিকাভুক্তির মাধ্যমে এটি করা হবে।

ঢাকা পোস্ট : মূলধন বাড়াতে আপনি কোন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে চান?

মো. তারিক আমিন ভূঁইয়া : পুঁজিবাজার সম্প্রসারণ করলে এমনিতেই মূলধন বাড়বে। এজন্য ভালো মানের নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান তালিকাভুক্ত করা হবে। বাংলালিংক, ইউনিলিভার ও নেসলেসহ যেসব বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে ব্যবসা করছে তাদেরকে পুঁজিবাজারে আসার প্রস্তাব দেব। তারা যাতে সহজে বাজারে আসতে পারে সেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আবার কাঙ্ক্ষিত মুনাফা না পেলে তারা যাতে সহজেই পুঁজি নিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে— এমন কর্মপন্থা গ্রহণ করা হবে।

ঢাকা পোস্ট : ডিএসইতে টাকার অঙ্কে লেনদেনের পরিমাণ প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। এক্ষেত্রে আপনার টার্গেট (লক্ষ্য) কী হবে?

মো. তারিক আমিন ভূঁইয়া : পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) পরিকল্পনা, আগামী বছরের মধ্যেই পুঁজিবাজারের লেনদেন ছাড়াবে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। আমরা নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে শতভাগ সহযোগিতা করব। লেনদেন যেন কয়েকগুণ উন্নীত হয় সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করব। আমাদের লক্ষ্য থাকবে ডিএসইকে ব্যবসায়িকভাবে সফল কোম্পানিতে পরিণত করা।

ঢাকা পোস্ট : পুঁজিবাজারের প্রধান সমস্যা শেয়ার কারসাজি। এটি রোধে বিশেষ কোনো পরিকল্পনা আছে কি না?

মো. তারিক আমিন ভূঁইয়া : গুজব ও কারসাজি রোধে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে। বর্তমানে যেসব প্রযুক্তি রয়েছে, প্রয়োজনে সেসব প্রযুক্তি আরও আধুনিকায়ন করা হবে। ডিএসই’র সার্ভিলেন্স সফটওয়্যারে (নজরদারি সফটওয়্যার) এমন কিছু প্রযুক্তি যুক্ত করা হবে যাতে কেউ অস্বাভাবিক কিছু করলে ধরা পড়ে যায়।

দেশের পুঁজিবাজারের প্রতি জনগণের যে আস্থা তৈরি হয়েছে তা যাতে আরও দৃঢ় হয় সেদিকে বিশেষ নজর দেওয়া হবে।

ঢাকা পোস্ট : কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-বোনাস বাড়ানোর বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেবেন কি না?

মো. তারিক আমিন ভূঁইয়া : লাভবান প্রতিষ্ঠান হিসেবে ডিএসইকে গড়ে তোলাই আমার অন্যতম লক্ষ্য। এখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আরও দক্ষ ও যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলা হবে। তাদের প্রাপ্য অনুসারে বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হবে। কেউ ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন না।

ঢাকা পোস্ট : আপনাকে ধন্যবাদ।

মো. তারিক আমিন ভূঁইয়া : আপনাকেও ধন্যবাদ। ঢাকা পোস্টের জন্য শুভ কামনা।

এমআই/ওএফ/এমএআর/এমএইচএস