করোনা মহামারির ধাক্কায় প্রায় সবখাতের অবস্থা বেহাল। কারো কারো টিকে থাকাই দায় হয়ে পড়েছে। তবে উল্টো চিত্র ওষুধ খাতে। মহামারির এ সময়ে ব্যাপক মুনাফা করেছে অধিকাংশ ওষুধ কোম্পানি। তাতে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।

২০১০ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় বিকন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। কোম্পানিটির শেয়ারের গত দেড় মাসে দাম বেড়েছে ১১৫ টাকা। আর করোনার সর্বশেষ এক বছরে দাম বেড়েছে ১৭০ টাকা। 

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য মতে, করোনা শুরুর বছর ২০২০ সালের ৫ জুলাই বিকন ফার্মার শেয়ারের দাম ছিল ৬০ টাকা। সেখান থেকে গত ৩ আগস্ট শেয়ারটির দাম ১৭০ টাকা বেড়ে বিক্রি হয় ২৩০ টাকায়। এর মধ্যে চলতি বছরের ২০ জুন শেয়ারটির দাম ছিল ১১৫ টাকা। অর্থাৎ দেড় মাসে শেয়ারটির দাম দ্বিগুণ বেড়েছে।

৩০ জুন ২০২০ সালে শেয়ারহোল্ডারদের ৬ শতাংশ লভ্যাংশ দেওয়া কোম্পানিটি ২০২০-২১ অর্থবছরের তিন প্রান্তিকে শেয়ার প্রতি মুনাফা (ইপিএস) হয়েছে ৩ টাকা ২৭ পয়সা। যা ২০১৯-২০ বছরের একই সময়ে ছিল ৫৫ পয়সা। আগের বছরের তুলনায় গত বছরের নয় মাসে কোম্পানিটির ইপিএস বেড়েছে ২ টাকা ৭২ পয়সা। বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা ৩০ জুন ২০২১ সময়ে কোম্পানিটি শেয়ারহোল্ডারদের আরও বেশি মুনাফা দেবে।

পুঁজিবাজারে সবচেয়ে ভালো কোম্পানিগুলোর একটি স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। ১৯৯৫ সালে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির শেয়ারের দাম চলতি বছরের ২৩ মে ছিল ২১০ টাকা ৩০ পয়সা। সেখান থেকে ২০ টাকা বেড়ে ২৩১ টাকা ৯০ পয়সা দাঁড়িয়েছে। কোম্পানিটি ৩০ জুন ২০২০ সমাপ্ত বছরে শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ৫২ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাস অর্থাৎ তিন প্রান্তিকে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ১৩ টাকা ১২ পয়সা। যা এর আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১১ টাকা ৮৫ পয়সা। অর্থাৎ ১ টাকা ২৭ পয়সা বেড়েছে।

তিন প্রান্তিকের মধ্যে তৃতীয় প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) ইপিএস দাঁড়িয়েছে ৪ টাকা ৩৬ পয়সা। যা এর আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৪ টাকা ৮ পয়সা। অর্থাৎ ইপিএস বেড়েছে ২৮ পয়সা। দেশে চলমান করোনাভাইরাসের প্রকোপ রোধে কোম্পানির উৎপাদিত ‘এইস’, ‘এইস প্লাস’, ‘সিভিট’ এবং ‘ফেক্সো’ এই তিন ধরনের ‍ওষুধের চাহিদা ব্যাপক বেড়েছে। আর তাতে কোম্পানিটির ব্যবসাও ভালো হয়েছে।

ওষুধ খাতের আরেক কোম্পানি বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। গত ৯ আগস্ট এই কোম্পানিটির শেয়ার সর্বশেষ বিক্রি হয়েছে ১৮৮ টাকা ৬০ পয়সায়। এক বছর আগে অর্থাৎ ২০২০ সালের ৯ আগস্ট শেয়ারটির দাম ছিল ৯৮ টাকা। অর্থাৎ এক বছরে শেয়ারটির দাম বেড়েছে ৯০ টাকা। গত ২৭ জুন শেয়ারটির দাম ছিল ১৭২ টাকা ২০ পয়সা। সেখান থেকে দাম বেড়ে ৯ আগস্ট বিক্রি হয়েছে ১৮৮ টাকায়।

ডিএসইর তথ্য মতে, কোম্পানিটির জুলাই ২০২০ থেকে ৩১ মার্চ ২০২১ সালে শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) দাঁড়িয়েছে ৮ টাকা ২৩ পয়সা। এর মধ্যে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে করোনার ৫০ লাখ টিকার মাধ্যমে মুনাফা হয়েছে ৩৮ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। তাতে তৃতীয় প্রান্তিকে কোম্পানিটির ইপিএস দাঁড়িয়েছে ৩ টাকা ২৮ পয়সা। যা আগের বছরের চেয়ে ১ দশমিক ২৪ পয়সা বেশি। জুন পর্যন্ত সময়ে মোট ৭০ লাখ ডোজ টিকা সেরামের মাধ্যমে আনা হয়েছে। ফলে আরও ২০ লাখ ডোজ টিকার মুনাফা পাবে বেক্সিমকো ফার্মা। এছাড়াও চলমান করোনাকালীন ‘নাপা’, ‘নাপা এক্সট্রা’, ‘নাপা এক্সটেন্ড’, ‘নাপা রেপিড’সহ কোম্পানির উৎপাদিত প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ বিক্রি বেড়েছে।

কোম্পানিটির সচিব মোহাম্মদ আসাদ উল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনার বছরে বেক্সিমকো গ্রুপের সবকটি কোম্পানির মুনাফাও বেড়েছে। কারণ আমাদের ওষুধের বিক্রি বেড়েছে।

এই কোম্পানিগুলোর মতো পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ওষুধ ও রসায়ন খাতের ৩১টি কোম্পানির মধ্যে প্রায় সবকটি কোম্পানির জুলাই- ২০২০ সাল থেকে ৩১ মার্চ ২০২১ সাল পর্যন্ত মুনাফা বেড়েছে। কোম্পানিগুলো আরও মুনাফা করবে এমন প্রত্যাশায় ওষুধ খাতের শেয়ারে আগ্রহ বেড়েছে বিনিয়োগকারীদের। আর তাতে কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম সর্বশেষ দুই মাসে ব্যাপক বেড়েছে।  

পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার বছরে ব্যাংকগুলো আমানতের বিপরীতে ৯ শতাংশের কম মুনাফা দিচ্ছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান কিংবা বিমায় বিনিয়োগ আরও বেশি অনিরাপদ। ঠিক সেই সময় পুঁজিবাজারে ওষুধ কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে তার চেয়ে কয়েকগুণ রিটার্ন বেশি পাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারে অর্থ উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনা কারো জন্য আশির্বাদ হয়ে এসেছে। এ সময়ে দেশের শিল্প কারখানাসহ বিভিন্ন ধরনের কোম্পানির উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। লাখ লাখ মানুষ চাকরি হারিয়েছে। তবে এই সময় সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থায় ছিল দেশের পুঁজিবাজার। এই পুঁজিবাজারে বিমা, পোশাক এবং ওষুধ কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়েছে। ফলে পুঁজিবাজার এখন ভালো অবস্থানে রয়েছে। তবে কোম্পানিগুলোর শেয়ার ও আর্থিক প্রতিবেদনে যেন কোনো ধরনের কারসাজি না হয় সেই বিষয়ে কমিশনকে খেয়াল রাখতে হবে।

ডিএসইর তথ্য মতে, দ্য একমি ল্যাবরেটরিজ লিমিটেডের শেয়ার গত ২৮ জুলাই লেনদেন হয়েছে ৭৪ টাকা ৭০ পয়সায়। সেখান থেকে ২০ টাকা বেড়ে গত ১০ আগস্ট দাঁড়িয়েছে ৯৪ টাকায় ১০ পয়সায়। ২০১৬ সালে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটি সর্বশেষ বছরে ২৫ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছে। কোম্পানিটির জুলাই ২০২০ থেকে ৩১ মার্চ ২০২১ সময়ে ৯ মাসে শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ৫ টাকা ৫৯ পয়সা। এর আগের বছরের একই সময় যা ছিল ৫ টাকা ৩৪ পয়সা। অর্থাৎ ২৫ পয়সা মুনাফা বেড়েছে। করোনাকালে কোম্পানিটি উৎপাদিত ওষুধ ‘মোনাস’ এর চাহিদা বেড়েছে। 

কোম্পানি সচিব আরসাদুল কবির ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনার বছরেও ভালো মুনাফা হয়েছে। মুনাফা বাড়ায় বিনিয়োগকারীরাও লাভমান হচ্ছেন।

২৮ জুন থেকে দাম বেড়েছে এক্টিভ ফাইনের শেয়ারের। ২০১০ সালে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির ২৮ জুন দাম ছিল ১৭ টাকা ৬০ পয়সা। সেখান থেকে বেড়ে ২৬ টাকা পর্যন্ত দাম উঠেছে গত ২ আগস্ট। সর্বশেষ গত ৯ আগস্ট কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ছিল ২৪ টাকা।

এসিআই লিমিটেড ২৭ জুন লেনদেন হয়েছে ২৫৮ টাকা ৯০ পয়সা। ৯ আগস্ট বিক্রি হয়েছে ২৯৮ টাকা ১০ পয়সা। এ সময়ে দাম বেড়েছে ৪০ টাকা। ১৯৭৬ সালে তালিকাভুক্ত কোম্পানির গত অর্থবছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে আগের বছরের তিন প্রান্তিকের চেয়ে মুনাফা বেড়েছে। গত তিন প্রান্তিকে কোম্পানির শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) দাঁড়িয়েছে ৩৫ পয়সা। আগের বছরের একই সময় লোকসান ছিল ৪ টাকা ৮১ পয়সা। প্রতিষ্ঠানটিতে বিনিয়োগও বেড়েছে।

এমবি ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের শেয়ার ১৫ জুলাই ছিল ৪০৮ টাকা ৬০ পয়সা। সেখান থেকে বেড়ে ৪৮৯ টাকায় বিক্রি হয়েছে। দাম বেড়েছে ৮১ টাকা। ১৯৮৬ সালে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটি ৩০ জুন ২০২০ সমাপ্ত বছরে শেয়ার হোল্ডারদের ১৫ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছে। আগামী ১৭ আগস্ট কোম্পানিটির তিন প্রান্তিকে আর্থিক প্রতিবেদন নিয়ে বোর্ড সভা রয়েছে।

এডভেন্ট ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের শেয়ার ৩০ মে বিক্রি হয়েছে মাত্র ২০ টাকা ৯০ পয়সা দরে। সেখান থেকে সাত টাকা বেড়ে ৯ আগস্ট লেনদেন হয়েছে ২৭ টাকা ৪০ পয়সায়।

সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের শেয়ারের দাম গত ৮ জুন ছিল ১১ টাকা ২০ পয়সা। সেখান থেকে ১১ টাকা বেড়ে বিক্রি হয়েছে ২২ টাকা ৬০ পয়সা। অর্থাৎ দ্বিগুণের বেশি দাম বেড়েছে।

দ্য ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রিজ ৭ জুলাই ২৪৫ টাকা ২০ পয়সা থেকে বেড়ে ১৮ জুলাই ২৬০ টাকা ২০ পয়সা হয়েছে। ১৫ টাকা বেড়েছে।

জেএমআই সিরিঞ্জ অ্যান্ড মেডিকেল ডিভাইস লিমিটেডের শেয়ারের দাম ২৭ জুন ছিল ৩১৭ টাকা। সেখান থেকে বেড়ে ৯ আগস্ট ৩৮৫ টাকায় দাঁড়িয়েছে। এ সময়ে ৬৮ টাকা দাম বেড়েছে শেয়ারটির।

ইন্দো-বাংলা ফার্মাসিউটিক্যালস ৩০ জুন ২০২০ সালের জন্য ৪ দশমিক ৫ শতাংশ নগদ আর ২ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছিল। আগামী ৩০ জুন সমাপ্ত বছরের লভ্যাংশ আসছে। গত ১ জুন শেয়ারটির দাম ছিল ১৭ টাকা। সেখান থেকে ৭ টাকা বেড়ে ৯ আগস্ট দাঁড়িয়েছে ২৪ টাকায়।

২০১৩ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত অরিয়ন ফার্মা শেয়ারের দাম ২৭ জুন ছিল ৫২ টাকা ৫০ পয়সা। সেখান থেকে ২৩ টাকা বেড়ে ৭৩ টাকা ৯০ পয়সায় দাঁড়িয়েছে। সর্বশেষ বছরে ৩০ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছে কোম্পানিটি।

ফার্মা এইড কোম্পানিটি ১৯৮৭ সালে তালিকাভুক্ত হয়। এক মাস দশ দিনে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বেড়েছে ৭৬ টাকা। ৩০ জুন ২০২০ সমাপ্ত বছরে শেয়ারহোল্ডারদের ৫০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেওয়া কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ২৭ জুন ছিল ৩৮১ টাকা ৪০ পয়সা। সেখান থেকে ৭৬ টাকা বেড়ে ৯ আগস্ট দাঁড়িয়েছে ৪৫৭ টাকা ২০ পয়সায়।

২০১৯ সালে তালিকাভুক্ত সিলকো ফার্মা ৩০ জুন সমাপ্ত বছরের জন্য ১০ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছে। ৩ জুলাই কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ২৩ টাকা থেকে বেড়ে সর্বোচ্চ ৩৫ টাকায় দাঁড়িয়েছে।

বহুজাতিক কোম্পানি লিবরা ইনফিউশন ৩০ জুন সমাপ্ত বছরের জন্য লভ্যাংশ ঘোষণা করবে। শেয়ারটির দাম গত ৬ জুলাই ছিল ৫২৬ টাকা। সেখান থেকে বেড়ে ৭০৯ টাকায় দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ শেয়ারটি দাম বেড়েছে প্রায় ২শ টাকা।

রেনেটা লিমিটেড ১৯৭৯ সালে তালিকাভুক্ত হয়। কোম্পানিটি ৩০ জুন ২০২০ সমাপ্ত বছরের জন্য ১৪০ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছে। গত ২ জুন কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ছিল ১২৭১ টাকা ৯০ পয়সা। সেখান থেকে বেড়ে ১৩৮৫ টাকায় দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ ১১৪ টাকা বেড়েছে।

বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ছায়েদুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনায় পুঁজিবাজারে উত্থানের পেছনে ওষুধ খাত বড় ভূমিকা রেখেছে। দেশি বড় মূলধনী কোম্পানি বেক্সিমকো ফার্মা, স্কয়ার ফার্মা, রেনেটা গত এক বছর ধরে পুঁজিবাজারে ইতিবাচক প্রবণতা ধরে রেখেছে। এসব কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগ করে ভালো মুনাফা পাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা।

এমআই/জেডএস