>> কোম্পানির নামে নানা গুজবই মূলমন্ত্র

>> বেশিরভাগ উৎপাদনহীন ও ছোট মূলধনী কোম্পানি

>> অতিমূল্যায়িত হচ্ছে কোম্পানি, বড় ঝুঁকিতে পড়ছে পুঁজিবাজার : মির্জ্জা আজিজ

>> ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা

ওভার দা কাউন্টার (ওটিসি) মার্কেট থেকে গত ১৩ জুন পুঁজিবাজারে লেনদেন চালু হয় পেপার প্রসেসিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেডের শেয়ার। লেনদেনের দিন ৩ কোটি ৭৩ লাখ টাকার কোম্পানির শেয়ারের দাম ছিল ১৭ টাকা ৬০ পয়সা। সেখান থেকে দুই মাসের ব্যবধানে প্রতিটি শেয়ারের দাম ১৫৫ টাকা বেড়ে গত বৃহস্পতিবার (১৯ আগস্ট) দাঁড়িয়েছে ১৭২ টাকা ৬০ পয়সায়। অর্থাৎ শেয়ার প্রতি দাম বেড়েছে প্রায় ৯ গুণ। তাতে ৩ কোটি টাকার কোম্পানির বাজার মূল্য দাঁড়িয়েছে ৬১ কোটি ৬১ লাখ ৩০ হাজার টাকা। এই দাম বৃদ্ধি হয়েছে সম্পূর্ণ কারসাজির মাধ্যমে, দাম বাড়িয়ে চক্রটি শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছে। আর কিছু সাধারণ বিনিয়োগকারী অতি লোভে না বুঝেই শেয়ার কিনছেন।

স্টক এক্সচেঞ্জের তথ্য অনুসারে, স্বল্প মূলধনী এই কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ানোর পেছনে একটি চক্র রয়েছে। চক্রটি গত ১৩ জুন পুঁজিবাজারে লেনদেন শুরুর দিন থেকে প্রথম ১০ দিন সার্কিট ব্রেকারের চেয়ে বেশি দামে শেয়ার কেনার আদেশ দিয়ে রাখত। তাতে ১৩ জুন থেকে ২৩ জুন পর্যন্ত ১০ দিনে চারটি শেয়ার লেনদেন হয় অথচ শেয়ারের দাম ২০ টাকা বেড়ে ১৭ থেকে ৩৭ টাকায় দাঁড়ায়। এই সময় শেয়ারটি হলটেড ছিল।

চক্রটি ১২ জুলাই পর্যন্ত একই কায়দা অব্যাহত রাখে। ফলে শেয়ারের দাম দাঁড়ায় ৯৫ টাকা ৮০ পয়সা। এই সময় অর্থাৎ লেনদেন শুরু পর এক মাস পর্যন্ত কোম্পানির শেয়ার দিনে লেনদেন হয়েছে লাখ টাকার নিচে। অর্থাৎ কারসাজি করে শেয়ারের দাম বাড়ালেও বিক্রি হচ্ছে কম।

স্টক এক্সেচেঞ্জের সার্ভেইল্যান্স টিম দেখেছে, চক্রটি শেয়ারের দাম ১২৮ টাকা পর্যন্ত উঠিয়ে তাদের হাতে থাকা কোম্পানির দশমিক ৮১ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন। চক্রটির বেশির ভাগই প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী। চক্রটি শেয়ারের দাম প্রতিনিয়তই বাড়িয়ে বিক্রি করে দিচ্ছে। ফলে কোম্পানির শেয়ারের লেনদেনও বাড়ছে।

বিনিয়োগকারীদের সতর্ক করতে প্রাথমিকভাবে শেয়ারটির দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধির কারণ জানতে চেয়ে ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ কোম্পানি কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছে। কোম্পানি কর্তৃপক্ষ স্টক এক্সচেঞ্জকে জানিয়েছে, তাদের কাছে কোনো সংবেদনশীল তথ্য নেই। দুই মাসে শেয়ারটির দাম বৃদ্ধিকে কারসাজি হচ্ছে বলে মনে করছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। ফলে গত সপ্তাহে এই কোম্পানিসহ ৯টি কোম্পানির শেয়ার কারসাজির তদন্ত করছে বিএসইসি।

একইভাবে কারসাজির মাধ্যমে গত ১৩ জুন থেকে ১৯ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে ১১২ টাকা দাম বাড়িয়েছে বাংলাদেশ মনোস্পুল পেপার ম্যানুফ্যাকচারার কোম্পানি লিমিটেড। ৩৫-৪০টি বেনিফিশিয়ারি ওনার্স অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে কারসাজি করা হয়। তাদের কারসাজির বিষয়টি তদন্ত করছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। একই গ্রুপের এ দুটি কোম্পানি গত ১৩ জুন ওভার দ্যা কাউন্টার মার্কেট (ওটিসি) থেকে মূল মার্কেটে ফিরেছে।

দুটো স্বল্প মূলধনী কোম্পানি ছাড়াও গুজব ছড়িয়ে অ্যাপোলো ইস্পাতের শেয়ারের দাম দ্বিগুণ বাড়িয়ে শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছে কারসাজি চক্র। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের তথ্য মতে, ৯ জুন শেয়ারটির দাম ছিল ৬ টাকা ৭০ পয়সা। এরপর চক্রটি পুঁজিবাজারে গুজব ছড়ায় যে অ্যাপোলো ইস্পাত কিনে নিচ্ছে আবুল খায়ের, বিএসআরএম ও জিপিএইচ ইস্পাত কোম্পানি। আর এই খবরে কেন্দ্র করে ৯ জুন থেকে ১২ আগস্ট দুই মাসে শেয়ারটির দাম বাড়ে ৮ টাকা। গত ১২ আগস্ট শেয়ারটির দাম দাঁড়ায় ১৪ টাকা ৭০ পয়সা।

কিন্তু প্রকৃত তথ্য হচ্ছে, ঋণগ্রস্ত কোম্পানিটিকে কেউ কিনছে না। এই তথ্য বাজারে ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে শেয়ারের দাম কমতে শুরু করেছে। ১২ আগস্ট কোম্পানির শেয়ারের দাম ছিল ১৪ টাকা ৭০ পয়সা সেখান থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ১ টাকা ৩০ পয়সা কমে ১৩ টাকা ৩০ পয়সায় সর্বশেষ লেনদেন হয়েছে। অর্থাৎ শেয়ারের দাম কমছে। আর তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা।

একইভাবে কোম্পানির মুনাফা বাড়েনি, ভালো লভ্যাংশ দেওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, কোম্পানি সম্প্রসারণ হচ্ছে না তারপরও শেয়ারের দাম কারসাজি চক্রের ছোঁয়াতে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। বিনিয়োগকারীরাও এসব শেয়ার কেনার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। 

এসব কোম্পানির একটি আনোয়ারা গ্যালভানাইজিং লিমিটেড। এ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১৯ আগস্ট পর্যন্ত দাম বেড়েছে ২১২ টাকা। ১ জানুয়ারি শেয়ারের দাম ছিল ১৩১ টাকা। সেখান থেকে বেড়ে সর্বশেষ বৃহস্পতিবার লেনদেন হয়েছে ৩৪৪ টাকা।

আরমিট সিমেন্টের দাম বেড়েছে ৪০ টাকা ৩০ পয়সা। বিকন ফার্মার শেয়ারে দাম বেড়েছে ১২৪ টাকা, বার্জার পেইন্টের শেয়ারের দাম বেড়েছে ৩৩৫ টাকা, বেক্সিমকোর ৫০ টাকা, বাংলাদেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্সের ৫০ টাকা, সিভিও পেট্রোক্যামিক্যালের শেয়ার ৫২ টাকা ৩০ পয়সা, ডেল্টা লাইফের শেয়ার ৭০ টাকা, দেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার ৫১ টাকা ৩০ পয়সা, ইস্টার্ন টিউবের শেয়ার দাম ৪২২ টাকা, লিব্রা ইনফিউশনের শেয়ারের দাম ৩৭ টাকা, লিন্ডে বিডির শেয়ারের দাম ১০১ টাকা, মারিকোর শেয়ারের দাম ১৯১ টাকা, লাফার্জহোলসিমের দাম ২৪ টাকা ও হাইডেলবার্গের দাম বেড়েছে ১৭৭ টাকা।

স্বল্প মূলধনী কোম্পানির মধ্যে- কে অ্যান্ড কিউর দাম বেড়েছে ৫৯ টাকা। অ্যাপেক্স ফুডের দাম বেড়েছে ২৬ টাকা, আমান ফিডের দাম বেড়েছে ৪৪ টাকা, আরমিটের শেয়ারে দাম বেড়েছে ৪৯ টাকা, জেনেক্সের দাম বেড়েছে ৫৯ টাকা, কাট্টালি টেক্সটাইলের দাম বেড়েছে ২২ টাকা, জিমনেশিয়ামের দাম বেড়েছে ৭৪ টাকা, রহিমা ফুডের দাম বেড়েছে ১৩৮ টাকা, রহিম টেক্সটাইলের দাম বেড়েছে ১৩৭ টাকা, প্রভাতী ইন্স্যুরেন্সের দাম বেড়েছে ৯৫ টাকা, সোনালী লাইফের শেয়ারের দাম বড়েছে ৬৮ টাকা, সোনালী পেপারের দাম বেড়েছে ৮৬ টাকা, স্ট্যান্ডার্ড ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারের দাম বেড়েছে ৩৯ টাকা এবং তমিজউদ্দিন টেক্সটাইলের শেয়ারের দাম বেড়েছে ৮০ টাকা।

একইভাবে উৎপাদন বন্ধ থাকার পর পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত জাহিন টেক্সটাইলের শেয়ারের দাম ৫ টাকা থেকে বেড়ে ১০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। একই গ্রুপের আরেকটি কোম্পানি জাহিন স্পিনিংয়ের শেয়ার ৬ টাকা থেকে ১১ টাকা ৯০ পয়সায় দাঁড়িয়েছে।

এছাড়াও জেনারেশন নেক্স ফ্যাশন, তাল্লু স্পিনিং, তুংহাই নিটিং, মিথুন নিটিং, মিরাকেল ইন্ড্রস্ট্রিজসহ আরও ২৫-৩০টি কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়েছে দ্বিগুণ।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১০ সালের ধসের ক্ষত এখনো শুকায়নি। এগার বছর পর ঊর্ধ্বমুখী ধারায় ফিরছে পুঁজিবাজার। আর এই সুযোগে আবারও কারসাজি চক্র ‘কোম্পানির মালিকানা পরিবর্তন হচ্ছে’, ‘কোম্পানি উৎপাদনে ফিরছে’ ও ‘বিদেশি কোম্পানি বিনিয়োগ করছে’ বলে গুজব ছড়ায়। তারা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ছাড়িয়ে দেয় যে লোকসানি কোম্পানিকে ভালো কোম্পানি কিনে নিচ্ছে। ফলে কোম্পানির মুনাফায় বাড়বে। তাতে শেয়ারের দাম বাড়তে থাকে। শেয়ারের দাম বাড়লে এই চক্রটি শেয়ার বিক্রি করে অর্থ তুলে নেন। আর সাধারণ বিনিয়োগকারীরা লোভে পড়ে এসব কোম্পানির শেয়ার আরও বাড়বে বলে কিনছেন। এভাবেই অনেকে নতুন করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

তারা বলছেন, স্টক এক্সচেঞ্জ ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে সার্ভেইল্যান্স সফটওয়ার রয়েছে। লেনদেনের সময় কোনো ব্রোকার হাউজ থেকে কোন কোন বিনিয়োগকারী সিরিয়াল ট্রেডিং করছেন, তা আয়নার মত দেখা যায়। কিন্তু কমিশন ও স্টক এক্সচেঞ্জ দেখেও না দেখার ভান করছে। তারা কারসাজি চক্রের সদস্যদের আরও বেশি করে সুযোগ দিচ্ছে। পুঁজিবাজারে স্বার্থে কমিশন ও স্টক এক্সচেঞ্জের উচিত দ্রুত কারসাজি চক্রটি খুঁজে বের করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া।

এ বিষয়ে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহম্মদ রেজাউল করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘কিছু দুষ্ট লোক বাজারে দুষ্টুমি করতে চায়। স্থিতিশীল পুঁজিবাজারকে ঘোলাটে করতে চায়। আমরা এই চক্রের বিরুদ্ধে তৎপর রয়েছি।’

তিনি বলেন, ‘বিএসইসির পক্ষ থেকে কয়েকদিন আগে একটি কমিটি গঠন করেছি। কমিটি ৯টি কোম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধির পাশাপাশি কোম্পানির কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য গোপন করেছে কিনা তা দেখছে। এছাড়াও আর্থিক প্রতিবেদনে কোনো কারসাজি হয়েছে কিনা, কোম্পানির শেয়ারের প্রতি আয় (ইপিএস) ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হয়েছে কিনা তা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।’

রেজাউল করিম বলেন, ‘উৎপাদনে নেই, কোম্পানির প্রধান অফিসও বন্ধ তারপরও শেয়ারের দাম বাড়ছে নিশ্চয় এর পেছনে কিছু না কিছু আছে। আমরা এগুলো কঠোরভাবে দেখছি।’

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘দেশের পুঁজিবাজার অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় ভালো। এই সুযোগটি কাজে লাগিয়েছে কারসাজি চক্র। তারা ভালো কোম্পানির চেয়ে উৎপাদন বন্ধ ও স্বল্প মূলধনী কোম্পানির শেয়ার বিনিয়োগ করছে। সিরিয়াল ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে এসব কোম্পানির শেয়ারে দাম বাড়াচ্ছে, এরপর শেয়ার বিক্রি করে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। আর সাধারণ বিনিয়োগকারীরা অতি লাভের আশায় এসব কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করছে।’

তিনি বলেন, ‘বিনিয়োগকারীদের ৭০-৮০ শতাংশ ঝুঁকিপূর্ণ এসব কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আর মাত্র ২০-৩০ শতাংশ বিনিয়োগকারী লাভবান হচ্ছেন। ফলে নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত বাজার ও বিনিয়োগকারীদের রক্ষার স্বার্থে কারসাজি চক্রের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা।’

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘করোনার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দাভাব, দেশের অর্থনীতির অবস্থা খুব বেশি ভালো নেই। ব্যাংকের আমানতের সুদ হার এখন কম। ফলে সাধারণ মানুষের টাকা এখন পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ হচ্ছে। এই সুযোগে পুঁজিবাজার ফিরছে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায়।’

তিনি বলেন, ‘পুঁজিবাজারে উত্থান নিয়ে সার্বিকভাবে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। তবে বেশ কিছু কোম্পানির শেয়ারের দাম অতিমূল্যায়িত হয়েছে। এগুলোর বিষয়ে বিনিয়োগের আগে বিনিয়োগকারীদের সতর্ক থাকতে হবে। পাশাপাশি ঊর্ধ্বমুখী বাজারে যাতে কারসাজি না হয় সেই বিষয়ে বিএসইসিকে নজরদারির ক্ষেত্রে আরও কঠোর হতে হবে। কোনোভাবেই কারসাজি চক্রের হাতে পুঁজিবাজারকে ছেড়ে দেওয়া যাবে না।’

এমআই/ওএফ