দেশের পুঁজিবাজারে প্রবাসী ও বিদেশিদের বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রে রোড শো করেছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। বাজারে ভালো কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত করতে নিয়েছে বিশেষ উদ্যোগও। তারপরও বাজার ছাড়ছেন প্রবাসী (এনআরবি) ও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা।

গত বছর (২০২১ সালে) ৭০ হাজার বিওধারী প্রবাসী ও বিদেশি বাজার ছাড়েন। একই সময়ে প্রবাসী ও বিদেশিরা বাজার থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকা তুলে নেন। বাজার ছাড়ার পেছনে দুটি কারণ রয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। 

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কিছু প্রবাসী বিনিয়োগকারী শুধু বিও অ্যাকাউন্ট নিয়ে আইপিওতে পুঁজিবাজারে আসা কোম্পানির শেয়ারে আবেদন করতেন। আইপিওর নতুন নিয়মের ফলে তারা বিও অ্যাকাউন্টগুলো বন্ধ করেছেন। এখন বাজারে প্রকৃত প্রবাসী ও বিদেশি বিনিয়োগকারীরাই রয়েছেন।

অন্যদিকে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, গত এক থেকে দেড় বছরে বেশ কিছু কোম্পানির শেয়ারের দাম অতিমূল্যায়িত হয়েছে। যৌক্তিকমূল্যের চেয়ে বেশি দাম পাওয়ায় বিদেশিরা তা বিক্রি করে দিচ্ছেন।

বিএসইসির সূত্র মতে, প্রবাসী ও বিদেশি বিনিয়োগকারী ২০২০ সালে শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে ৬ হাজার কোটি টাকা তুলে নেন। ২০২১ সালে বাজার থেকে তুলে নেওয়া অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকা। 

এদিকে বাজারের গভীরতা বাড়াতে ২০২১ সালে বন্ড ও প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) এবং বোনাস শেয়ারের মাধ্যমে শতাধিক কোম্পানির উদ্যোক্তাদের প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা উত্তোলনের অনুমোদন দেয় বিএসইসি। তারপরও বাজারে বিনিয়োগকারীদের সাড়া মিলছে না আশানুরূপ। 

বিএসইসির তথ্য মতে, ২০২১ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) মোট ৩ লাখ ৫৪ হাজার ৫২ কোটি ৮৬ লাখ টাকার শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের ইউনিটের লেনদেন হয়েছে। এই সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকার লেনদেনের মধ্যে প্রবাসী ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের লেনদেন হয়েছে মাত্র ৭ হাজার ৭৬৪ কোটি ২১ লাখ ৭০ হাজার ৭৪৫ টাকা। এই সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকার লেনদেনের মধ্যে প্রবাসী ও বিদেশিরা ৫ হাজার ২০৬ কোটি ২০ লাখ ৫৮ হাজার ৯২১ টাকার শেয়ার বিক্রি করে ফেলেছেন। তার বিপরীতে মাত্র ২ হাজার ৫৫৮ কোটি ২ লাখ ১১ হাজার ৮২৩ টাকার শেয়ার কিনেছেন প্রবাসী বিদেশীরা।

এ চিত্র শুধু ২০২১ সালের নয়। ২০২০ সালেও প্রবাসী ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের লেনদেন হয়েছিল ১০ হাজার ৩৮৭ কোটি ৬৫ লাখ ৫৫ হাজার ৭২৫ টাকার শেয়ার। ওই বছরেরও প্রবাসীরা ৬ হাজার ৪৯৬ কোটি ৮৮ লাখ ২১ হাজার ১৬১ টাকার শেয়ার বিক্রি করেন। তার বিপরীতে শেয়ার কেনেন ৩ হাজার ৮৯০ কোটি ৭৭ লাখ ৩৪ হাজার ৫৬৪ টাকার। অর্থাৎ গত দুই বছর ধরে শেয়ার বিক্রি করে পুঁজিবাজার থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন বিদেশিরা।

সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) তথ্য মতে, ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রবাসী বিদেশিদের বিও হিসাব ছিল ১ লাখ ৫৫ হাজার ৮৫৯টি। ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব দাঁড়িয়েছে ৮৬ হাজার ৩৬১টিতে। অর্থাৎ গত এক বছরে প্রবাসী ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব কমেছে ৬৯ হাজার ৪৯৮টি।

শেয়ার বিক্রি করে পুঁজিবাজার ছাড়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জর (ডিএসই) চিফ অপারেটিং অফিসার ও মুখপাত্র এম সাইফুর রহমান মজুমদার।

তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত এক বছরের বেশি সময়ে বাজার ছিল ঊর্ধ্বমুখী। তারপরও বিদেশিরা শেয়ার বিক্রি করছেন বেশি। কিন্তু কী কারণে শেয়ার বিক্রি করছেন, তা ঠিক আমার জানা নেই।

ডিএসইর পরিচালক শাকিল রিজভী ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিদেশিরা কখনো লোকসান দিতে চান না। তারা শেয়ারের দাম কম থাকলে কিনেন আর বেশি হলে বিক্রি করে দেন। ৪-৫ বছর আগে তারা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেছে, এখন শেয়ারের দাম বাড়ায় বিক্রি করছেন। এটাই তো বুদ্ধিমানের কাজ।

বাজারের গভীরতা বাড়াতে ২০২১ সালে বন্ড ও প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) এবং বোনাস শেয়ারের মাধ্যমে শতাধিক কোম্পানির উদ্যোক্তাদের প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা উত্তোলনের অনুমোদন দেয় বিএসইসি। তারপরও বাজারে বিনিয়োগকারীদের সাড়া মিলছে না আশানুরূপ।

বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আবেদন করলেই সবাই শেয়ার পাবেন। আইপিওর নতুন নিয়মের ফলে এখন প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের একটি বড় অংশ বিও হিসাব বন্ধ করে দিয়েছেন। তারা এই বিও হিসাবগুলো দিয়ে আইপিওতেই আবেদন করতেন। এর পাশাপাশি কিছু বিনিয়োগকারী মুনাফা বেশি পেয়েছেন বলে শেয়ার বিক্রি করেছেন।

তিনি বলেন, বিশ্বের অন্য যেকোনো পুঁজিবাজার থেকে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার ভালো রিটার্ন দিচ্ছে। আমরা বাজারের এ বিষয়টি বিদেশি ও প্রবাসীদের কাছে রোড শোর মাধ্যমে তুলে ধরছি। প্রবাসী ও বিদেশিদের ব্যাপক সাড়াও পাচ্ছি। আশা করছি, শেয়ার বিক্রি করে চলে যাওয়ার পরিবর্তে বাজারে বিদেশিরা শেয়ার কিনতে আসবেন।

ইউসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ রহমত পাশা ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিদেশিরা স্বল্প মেয়াদের চেয়ে দীর্ঘে মেয়াদি বিনিয়োগ বেশি করেন। তাই তারা কোম্পানির শেয়ারের বিনিয়োগের চেয়ে মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করেন বেশি। জেনে-বুঝে বিনিয়োগ করেন, ১৫-২০ শতাংশ মুনাফা করেন। এখন হয়তো সে রকম কোম্পানি পাচ্ছেন না, তাই তারা বিনিয়োগ করছেন না।

নতুন কোম্পানির অভাবে শেয়ার বিক্রি করছেন বিদেশিরা

বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাজারে ভালো কোম্পানির চেয়ে খারাপ কোম্পানির শেয়ারের দাম বেশি। শুধু তাই নয়, দীর্ঘমেয়াদে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য ভালো কোম্পানি খুব কম রয়েছে। নতুন কোম্পানি না পাওয়ায় বিদেশিরা শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ও বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, পুঁজিবাজারের বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসির দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে এসেছে। ফলে বাজারের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বিদেশিরা সন্দিহান। এছাড়াও দেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অস্থিরতা লক্ষ্য করা গেছে। এ অবস্থায় বিদেশিদের কেউ কেউ মার্কেট ওয়াচ করছেন। আবার কেউ কেউ শেয়ার বিক্রি করে সেফ জোনে চলে যাচ্ছেন।

এমআই/এসকেডি