মাদ্রাসা ও সাধারণ শিক্ষায় যেখানে অনলাইনে সবকিছু হয়, কারিগরি কেন অ্যানালগ থাকবে— প্রশ্ন ভুক্তভোগী শিক্ষকদের / ঢাকা পোস্ট

মাদ্রাসা ও সাধারণ শিক্ষায় যেখানে অনলাইনে সবকিছু হয়, কারিগরিতে কেন অ্যানালগ থাকবে— এমন প্রশ্ন একটি কারিগরি স্কুলের প্রভাষক নিশাত সরকারের। গাজীপুরের পেলাইদ আদর্শ কারিগরি স্কুলের এ প্রভাষকের দাবি, এমপিওভুক্তির আবেদন করার পর কোনো কারণ ছাড়াই দীর্ঘদিন তাকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। তিনি জানেন না, কবে নাগাদ তাকে এমপিওভুক্ত করা হবে।

আক্ষেপ করে ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা মিথ্যা আশ্বাস দেন। ঠিক মতো কথা বলতে চান না। আমাদের অপেক্ষা করতে হয় ওয়েবসাইটে কখন আপডেট দেবে। নিয়মিত তা আপডেট হয়ও না। বলতে লজ্জা হয়, শিক্ষকতা নাকি সম্মানের পেশা! বেতনের জন্য যদি তাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়, এটা তো আমাদের জন্য লজ্জার!’

বর্তমান সরকার কারিগরি শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। এই খাতে সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনার কথা জানাচ্ছে। সন্তানকে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করতে অভিভাবকদের উৎসাহিত করছে। অথচ এই শিক্ষাব্যবস্থা এখনও যেন মান্ধাতার আমলে পড়ে আছে।

শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির ভাষায়, ‘নতুন কারিকুলামে কারিগরি শিক্ষায় জোর দিচ্ছে সরকার। কিন্তু যারা কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছেন, তারা শিক্ষকতার চেয়ে এই দক্ষতা দিয়ে অন্য চাকরি করছেন। কারণ, কারিগরিতে শিক্ষকতার চেয়ে অন্য পেশায় আয় বেশি।’ তিনি এই খাতে এমপিওভুক্তির (মাসে বেতনবাবদ সরকারি টাকা) কার্যক্রম অটোমেশনের (স্বয়ংক্রিয়তা) আওতায় আনারও ঘোষণা দেন।

বর্তমান সরকার কারিগরি শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এই শিক্ষাব্যবস্থা এখনও মান্ধাতার আমলে পড়ে আছে / ছবি- সংগৃহীত

অন্যদিকে, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ জানান, নতুন শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির ভোগান্তি কমাতে ‘বস্তা-বস্তা’ কাগজ ব্যবহারের পরিবর্তে পুরো প্রক্রিয়া অনলাইনে করার চেষ্টা চলছে।

কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য বিবেচনায় শুধুমাত্র আয়ের দিকটাই নয়, বৈষম্য ও সনাতন পদ্ধতির কারণেও অনেকে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষকতার পেশা বেছে নিতে চাচ্ছেন না।

আরও পড়ুন >> আগামী বছর থেকে ৬ষ্ঠ-৮ম শ্রেণিতে কারিগরি শিক্ষা চালু

জানা গেছে, সাধারণ শিক্ষা ও মাদ্রাসায় এমপিওভুক্তির কাজ অনলাইনে হলেও কারিগরিতে এই কাজ করতে হচ্ছে হাতে-হাতে। এক হাত থেকে আরেক হাতে যেতে সময় লাগছে বেশ। তার ওপর বস্তা বস্তা কাগজ সংগ্রহ করতে এক-দুই মাস সময় ব্যয় হচ্ছে প্রার্থীদের। এসব কাগজ সংগ্রহ করতে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যেতে হচ্ছে তাদের। আবার আবেদন করেও অধিদপ্তরের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় বসে থাকতে হচ্ছে। সাধারণ শিক্ষা ও মাদ্রাসার শিক্ষকরা অনলাইনে তাদের আবেদনের আপডেট পেলেও কারিগরিতে সেটা পাচ্ছেন না। কারণ, অ্যানালগ সিস্টেম।

সাধারণ শিক্ষা ও মাদ্রাসায় এমপিওভুক্তির কাজ অনলাইনে হলেও কারিগরিতে এই কাজ করতে হচ্ছে হাতে-হাতে। এক হাত থেকে আরেক হাতে যেতে সময় লাগছে বেশ। তার ওপর বস্তা বস্তা কাগজ সংগ্রহ করতে এক-দুই মাস সময় ব্যয় হচ্ছে প্রার্থীদের। এসব কাগজ সংগ্রহ করতে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যেতে হচ্ছে তাদের। আবার আবেদন করেও অধিদপ্তরের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় বসে থাকতে হচ্ছে। সাধারণ শিক্ষা ও মাদ্রাসার শিক্ষকরা অনলাইনে তাদের আবেদনের আপডেট পেলেও কারিগরিতে সেটা পাচ্ছেন না। কারণ, অ্যানালগ সিস্টেম

ভুক্তভোগী শিক্ষকরা বলছেন, তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তিতে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন কারিগরির দেড় হাজারের বেশি শিক্ষক। তাদের মধ্যে এখন পর্যন্ত এমপিও’র আবেদন করেছেন আটশোর বেশি। এমপিওভুক্ত হয়েছেন মাত্র ২৭ জন। এছাড়া, বেতন প্রদানসহ বিভিন্ন দিক দিয়ে অন্য দুটি শিক্ষাব্যবস্থার চেয়ে পিছিয়ে আছেন কারিগরি শিক্ষকরা। এটা সরাসরি প্রহসন!

এমপিওসহ যেসব সমস্যায় জর্জরিত কারিগরি শিক্ষা

সাধারণ ও মাদ্রাসা শিক্ষায় আবেদনের পর এমপিওভুক্তি কোন অবস্থায় আছে তা পারসোনাল আইডি ও পাসওয়ার্ড দিয়ে অনলাইনে চেক করা যায়। কোনো ত্রুটি থাকলে সেখানে নোট দেওয়া হয়। সেই অনুযায়ী কাগজ আপলোড করতে হয়। কিন্তু কারিগরিতে এই সুবিধা নেই। এখানে সবগুলো কাগজ সংগ্রহ করে একটা ফাইলে জমা দিতে হয়। এসব কাগজের মধ্যে আছে- বোর্ড থেকে ভেরিফিকেশন করে আনা সার্টিফিকেট, মার্কশিট, নিবন্ধন সার্টিফিকেট, জন্মনিবন্ধন, নিয়োগপত্র, যোগদানপত্র, কলেজের প্রথম এমপিও, শেষ এমপিও, ডিসির প্রত্যয়নপত্র, শিক্ষা অফিসারের প্রত্যয়নপত্র, ব্যাংক অ্যাকাউন্টের ক্ষেত্রে ম্যানেজারের প্রত্যয়নপত্র ইত্যাদি। এসব কাগজ একটা ফাইল করে প্রথমে পাঠাতে হয় জেলা শিক্ষা অফিসারের কাছে। তিনি স্বাক্ষর করে দিলে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর কার্যালয়ে সশরীরে গিয়ে সেই ফাইল জমা দিতে হয়।

কাগজের ক্ষেত্রেও আছে তারতম্য। ৩৩টা কাগজ জমা দিতে হয় অধিদপ্তরে। তবে এক্ষেত্রে স্ব-স্ব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীর তথ্য দিতে হয়। ফলে যাদের প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী বেশি তাদের কাগজের পরিমাণও বেশি হয়। কারও ৭১ পৃষ্ঠা, কারও ৮৫, কারও ৯০ আবার কারও ১০০ পৃষ্ঠার তথ্য দিতে হয়।

বকেয়া বেতনের দাবিতে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর ঘেরাও কর্মসূচি পালন করছে বাংলাদেশ পলিটেকনিক্যাল টিচার্স ফেডারেশন

এমপিওপ্রত্যাশী শিক্ষকদের অভিযোগ, এমপিওভুক্তির ক্ষেত্রে বারবার আশ্বাস দিয়েও সমস্যার সমাধান করছে না কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর। গত রমজানে প্রথমবার আভাস দেওয়া হয়। বলা হয়, মে মাসের মধ্যে এমপিওভুক্তির কাজ শেষ হবে। এ সময়ের মধ্যে শেষ না হলে ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে সব কাজ শেষ হবে বলে আশ্বস্ত করা হয়। কিন্তু জুলাই শেষ হলেও এমপিওভুক্তির কাজ শেষ করতে পারেনি অধিদপ্তর। কারও কারও ফাইল ছয় মাস হয়ে গেছে, তারা বারবার অধিদপ্তরে আসছেন, কিন্তু কর্তৃপক্ষের মন গলছে না।

আরও পড়ুন >> কারিগরি শিক্ষা জনপ্রিয় করতে প্রচার কর্মসূচি কৌশল প্রণয়ন

গত ফেব্রুয়ারি ও মার্চে যারা এমপিওভুক্তির আবেদন করেছেন এবং এমপিওভুক্ত হয়েছেন, তাদের বেতন হয়েছে জুন থেকে। শিক্ষকরা এরিয়ার দাবি করলেও নিশ্চুপ কর্তৃপক্ষ।

মাদ্রাসা ও সাধারণ শিক্ষায় অ্যাড-হক কমিটি দেওয়া হলেও কারিগরিতে তা নেই। এক্ষেত্রে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) থেকে সবকিছু চূড়ান্ত হলেও অধিদপ্তর থেকে কমিটি দেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ শিক্ষকদের।

এনটিআরসিএ ২০১৮ সালের আগের নীতিমালা অনুযায়ী অনেককে শিক্ষক হিসেবে সুপারিশ করেছে, কিন্তু সংশোধিত নীতিমালায় অনেক বিষয় বাদ যাওয়ায় সেসব বিষয়ে এমপিও দিচ্ছে না কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর।

বেতন দেওয়া হয় পরে

মাদ্রাসা ও সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষকরা মাসের শেষদিকে কিংবা পরবর্তী মাসের ২/৩ তারিখে বেতন পান। কিন্তু কারিগরিতে শিক্ষকরা বেতন পান আরও পরে। চলতি বছর ঈদুল আজহা ছিল ১০ জুলাই। মাদ্রাসার শিক্ষকদের জুন মাসের বেতন হয়েছে ৪ জুলাই, মাউশির অধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা বেতন পেয়েছেন ৩ জুলাই। কারিগরির শিক্ষকরা ঈদের আগে বেতনই পাননি। তাদের বেতন হয়েছে ঈদের দুই দিন পরে, ১২ জুলাই।

মাদ্রাসা ও সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষকরা মাসের শেষদিকে কিংবা পরবর্তী মাসের ২/৩ তারিখে বেতন পান। কিন্তু কারিগরিতে শিক্ষকরা বেতন পান আরও পরে। চলতি বছর ঈদুল আজহা ছিল ১০ জুলাই। মাদ্রাসার শিক্ষকদের জুন মাসের বেতন হয়েছে ৪ জুলাই, মাউশির অধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা বেতন পেয়েছেন ৩ জুলাই। কারিগরির শিক্ষকরা ঈদের আগে বেতনই পাননি

অন্যান্য মাসেও একই অবস্থা দেখা যায়। সাধারণ শিক্ষায় জুলাই মাসের বেতন হয়েছে ২ আগস্ট, মাদ্রাসায় ৩১ জুলাই; কারিগরিতে হয়েছে ৪ আগস্ট। সাধারণ শিক্ষা ও মাদ্রাসায় মে মাসের বেতন হয়েছে ৩১ মে, কারিগরিতে হয়েছে ৯ জুন। এপ্রিল মাসের বেতন সাধারণ শিক্ষায় ২৫ এপ্রিল, মাদ্রাসায় ২৭ এপ্রিল; কারিগরিতে হয়েছে ৯ মে। মার্চ মাসের বেতন সাধারণ শিক্ষা ও মাদ্রাসায় ৩১ মার্চ, কারিগরিতে হয়েছে ৬ এপ্রিল; ফেব্রুয়ারি মাসের বেতন সাধারণ শিক্ষা ও মাদ্রাসায় ৩ মার্চ, কারিগরিতে হয়েছে ৬ মার্চ; জানুয়ারি মাসের বেতন সাধারণ শিক্ষা ও মাদ্রাসায় ২৭ জানুয়ারি, কারিগরিতে হয়েছে ৭ ফেব্রুয়ারি।

ভুক্তভোগী শিক্ষকরা যা বলছেন

বাগেরহাটের ফাতিমা (রা.) মহিলা টেকনিক্যাল কলেজের গণিতের প্রভাষক আশিক জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি চাকরিতে যোগ দেই। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ঢাকায় এসে এমপিও ফাইল জমা দেই। এর মধ্যে চার মাস হয়ে গেলেও অধিদপ্তর থেকে কাগজপত্রে কোনো সমস্যা আছে কি না, এমপিও দেবে কি না, দিলেও কবে দেবে; কিছুই জানায়নি।

এমপিওভুক্তির দাবিতে আড়াই ঘণ্টা অবস্থান শেষে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর ত্যাগ করেছেন ভুক্তভোগী শিক্ষকরা। ২ আগস্ট তোলা ছবি / ঢাকা পোস্ট

‘আমি ৭১টি কাগজ জমা দিয়েছি। এসব কাগজ জোগাড় করতে আমাকে ফেব্রুয়ারি ও মার্চের পুরোটা সময় দিতে হয়েছে। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে হয়েছে। সাধারণ বা মাদ্রাসায় এমপিওভুক্তির কাজে কোনো কাগজ বোর্ডে গিয়ে ভেরিফিকেশন করে আনা লাগেনি। কিন্তু আমাদের সব সার্টিফিকেটের ক্ষেত্রে ভেরিফিকেশন করতে হয়েছে।’

তিনি বলেন, আমাদের অনেক ভাই-বোন দূর-দূরান্ত থেকে এসে চাকরি করছেন। আমাদের সমস্যাগুলো কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর না বুঝলে আমরা কী করব, কার কাছে যাব? আমি দৈনিক ১২০-১৩০ টাকা খরচ করে প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছি-আসছি। সংসারের পেছনে খরচ আছে। গণিতে অনার্স-মাস্টার্স করেছি। গ্রামে গণিতের দুটা ব্যাচ পড়াই, সেই টাকা দিয়ে এখন পর্যন্ত চলছি।

তারা এখনও মান্ধাতার আমলে পড়ে আছে

সিরাজগঞ্জের লাইটহাউজ টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিএম কলেজের গণিতের প্রভাষক রুহুল আমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের প্রধান দাবি দ্রুত এমপিওভুক্ত করা। যোগদানের তারিখ থেকে বেতন দেওয়া। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি এমপিও’র ফাইল জমা দিয়েছি। কিন্তু নিয়মিত অ্যাড-হক কমিটি না থাকায় আমার এমপিও ফাইল রিজেক্ট করা হয়েছে। আরও অনেকের ক্ষেত্রে এমনটি হয়েছে। তাই আমরা দ্রুত এসব প্রতিষ্ঠানে অ্যাড-হক কমিটি দেওয়ার কথা বলেছি।

রাজধানীর আগারগাঁওয়ে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর কার্যালয় / ফাইল ছবি

‘যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে গেলে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর হওয়া দরকার ডিজিটাল। কিন্তু তাদের কাজ দেখলে মনে হয়, তারা এখনও মান্ধাতার আমলে পড়ে আছে। তারা প্রজ্ঞাপন জারি করেছে, সবকিছু ডিজিটালাইজড করা হবে। কিন্তু সেটা তারা করছে না। বিভিন্ন সময় তারা সমস্যার সমাধান করা হবে বলে আশ্বাস দিলেও বাস্তবায়ন করছে না।’

আমি ৮৫টি কাগজ জমা দিয়েছি

আব্দুর রউফের বাড়ি বগুড়ায়। সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন পিরোজপুর প্রত্যাশী জনকল্যাণ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। তিনি বলেন, ‘আমি ৮৫টি কাগজ জমা দিয়েছি। আবেদনের কাগজপত্র সংগ্রহ করতে আমার এক মাসের বেশি সময় লেগেছে। এই সময়ে কারিগরি বোর্ড, অধিদপ্তরে বারবার যেতে হয়েছে। জেলা শিক্ষা অফিসে লেগেছে ১০ দিন। সব কাজ শেষ করে গত ৩ এপ্রিল এমপিও ফাইল জমা দেই। এরপর চারবার গিয়েছি অধিদপ্তরে। জুলাইয়ের মধ্যে এমপিও দেওয়া হবে জানালেও দেওয়া হচ্ছে না। সর্বশেষ গত ২৭ জুলাই অধিদপ্তরে যাই। তখন তারা বলে সেপ্টেম্বরে দেবে। আমরা দেখা করতে গেলে তারা দেখা দিতে চায় না।’

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ / ফাইল ছবি

এমপিওভুক্তির আবেদনে ভোগান্তির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেখানে ১০ কলামের ছক। সেগুলো পূরণ করতে সময় বেশি লাগে। কারণ, এমন অনেক নিয়ম আছে যা আমাদের জানা নেই। প্রতিষ্ঠানপ্রধানও অনেক সময় কীভাবে পূরণ করতে হবে সেটা বুঝতে পারেন না। সেই কারণে বারবার অধিদপ্তরে গিয়ে জেনে আসতে হয়।

ঠিক মতো কথাও বলতে চান না তারা

পেলাইদ আদর্শ কারিগরি স্কুলের প্রভাষক নিশাত সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি দিনাজপুর থেকে গাজীপুরে সুপারিশপ্রাপ্ত। চাইলেই আমি এক সপ্তাহের মধ্যে সব কাগজ সংগ্রহ করতে পারি না। এক মাসের মধ্যে কাগজের ফাইল রেডি করে গত ৩০ মার্চ জমা দিয়েছি। জানি না সেগুলোর কী অবস্থা!

আরও পড়ুন >> সচিবের বক্তব্যে তীব্র ক্ষোভ শিক্ষা ক্যাডারে

‘অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা মিথ্যা আশ্বাস দেন। ঠিক মতো কথা বলতে চান না। আমাদের অপেক্ষা করতে হয় ওয়েবসাইটে কখন আপডেট দেবে। নিয়মিত তা আপডেট হয় না। বলতে লজ্জা হয়, শিক্ষকতা নাকি সম্মানের পেশা! বেতনের জন্য যদি তাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়, এটা তো আমাদের জন্য লজ্জার!’

মাদ্রাসা ও সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষকরা মাসের শেষদিকে কিংবা পরবর্তী মাসের ২/৩ তারিখে বেতন পান। কিন্তু কারিগরির শিক্ষকরা বেতন পান আরও পরে / ফাইল ছবি

মাদ্রাসা ও সাধারণ শিক্ষায় যেখানে অনলাইনে সবকিছু হয়, কারিগরিতে কেন অ্যানালগ সিস্টেম থাকবে— এমন প্রশ্ন রেখে তিনি আরও বলেন, ‘এখানে জবাবদিহিতার অভাব আছে। এটা আমাদের জন্য ভোগান্তির, একই সঙ্গে প্রহসনেরও। শুধু পরিবার নয়, প্রতিষ্ঠানেও অনেক সময় লজ্জিত হতে হয়। কারণ, আমি বিনা বেতনে কাজ করি। শিক্ষার্থীদের ভালো কিছু দেওয়ার মানসিকতায় এখানে এসেছিলাম। এখন আমি নিজেই শারীরিক বা মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছি।’

ট্রেনিং এবং দেশের বাইরে যেতেই ব্যস্ত সবাই

টাঙ্গাইলের গ্রাম বাংলা বিজনেস ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড টেকনিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ মো. আরহাদ আলী জানান, ২০২০ সালের ৫ আগস্ট তিনি তার প্রতিষ্ঠানে ১৭ জন শিক্ষকের এমপিও আবেদন করেন। ২০২১ সালে ১৭ জনের মধ্যে প্রথমে ছয়জন, পরে আরও চারজনের বেতন ছাড় হয়। তবে, প্রথম ছয়জনের মধ্যে একজনের ফাইল প্রথমে ‘ওকে’ করলেও এখন পর্যন্ত তার বেতন হয়নি। এমপিও শিটে তার নাম নেই। সর্বশেষ নীতিমালা মেনে আবেদন করলেও এখন পর্যন্ত কোনো সুরাহা হয়নি। বাকি সাতজনের সব কাগজ জমা দিলেও এমপিও হচ্ছে না। ভোকেশনাল শাখায় তিনজন আবেদন করেছিলেন, তারা এখনও এমপিওভুক্ত হতে পারেননি।

আরহাদ আলীর অভিযোগ, ‘টিএসসি, পলিটেকনিক্যাল ও ডিপ্লোমা নিয়েই পড়ে থাকে তারা (কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর)। ট্রেনিং এবং দেশের বাইরে যেতেই ব্যস্ত সবাই। আমাদের কাজের প্রতি তাদের কোনো মন নেই।’

যা বলছে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ওমর ফারুক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এমপিওসহ সব কাজ অনলাইনে সম্পন্ন করার চেষ্টা চলছে। বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল একটা অ্যাপ যাচাই করছে, সেজন্য একটা কমিটি গঠন করা হয়েছে। আশা করছি আগামী তিন মাসের মধ্যে সবকিছু অনলাইনের আওতায় নিয়ে আসতে পারব।’

এমপিও’র বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা তো বসে নেই। আমাদের লোকের অভাব আছে, রাতেও কাজ করতে হচ্ছে। শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও আমি অধিদপ্তরে সময় দিচ্ছি। আশা করছি, চলতি মাসের মধ্যে এমপিওভুক্তির কাজ শেষ হয়ে যাবে। আগামী মাসেই বাদ পড়া শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত করতে পারব।’

এএজে/এমএআর