এসএসসি-সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে গতকাল। ২ লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ জন শিক্ষার্থী এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে; আগের বছরের তুলনায় এ সংখ্যা ৮৬ হাজার ২৬২ জন বেশি। 

বছরে বছরে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়লেও শিক্ষার মান কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ের নয় বলে অভিযোগ রয়েছে। শিক্ষার মানের সূচকে বিশ্বের ১৩৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩২ এবং দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। 

শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন শিক্ষাবিদরাও। তারা বলছেন, দেশে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার সম্প্রসারণ হলেও শিক্ষার গুণগত মানের ক্রমাগত অবনতি হচ্ছে। এ ছাড়া শিক্ষা ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট ও বিস্তৃত শিক্ষানীতির অভাব যেমন রয়েছে তেমনি সরকারের সঠিক পরিকল্পনা এবং দক্ষ শিক্ষকের অভাবও সুস্পষ্ট। করোনায় শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি রয়েছে৷ এর পাশাপাশি সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা হওয়াতে জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেশি হওয়াতে অনন্দের কিছু নেই। শিক্ষার্থীরা কী শিখতে পেরেছে এটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যেসব শিক্ষার্থী শিখন ঘাটতি রেখেই জিপিএ-৫ পাচ্ছে তাদের পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষায়  একটি সংকট দেখা দিতে পারে।  

২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২০১৮ সালে ১ লাখ ১০ হাজার ৬২৯ জন শিক্ষার্থী এসএসসিতে জিপিএ-৫ পায়। ২০১৯ সালে পায় ১ লাখ ৫ হাজার ৫৯৪ জন। ২০২০ সালে এ সংখ্যা ১ লাখ ৩৫ হাজার ৮৯৮ জন, ২০২১ সালে ১ লাখ ৮৩ হাজার ৩৪০ জন আর ২০২২ সালে ২ লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ জন।  

এসএসসি ও সমমানে জিপিএ-৫ বৃদ্ধির সাথে সাথে শিক্ষার মান কতটা বেড়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও প্রবীণ শিক্ষাবিদ ড. মনজুর আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, জিপিএ-৫ ও পাসের হার দুটোই বিগত দিনে স্বপ্নের মতো বেড়েছে। কিন্তু আমাদের শিক্ষার মান পড়ে গেছে। যা বেড়েছে তা পরিমাণগত। কিন্তু গুণগত উৎকর্ষের মাপকাঠিতে আমাদের শিক্ষার মান বেশ খারাপ। বছর বছর পাস এবং জিপিএ-৫ এর সংখ্যা বাড়ছে কিন্তু সে অনুযায়ী গুনগত শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারছি না আমাদের পলিসি জটিলতার কারণে। যেই পরীক্ষায় অংশ নিলেই পাস এমনকি জিপিএ-৫ পাওয়া যায় সেই পরীক্ষার কোনো মূল্য নেই। শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন শুধু জিপিএ-৫ দিয়ে হবে না বরং একজন শিক্ষার্থী কতটা শিখতে পেরেছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ৷ 

তিনি আরও বলেন, গোটা শিক্ষা ব্যবস্থায় সামগ্রিক পরিকল্পনায় কোনো সমন্বয় নেই। ভবিষ্যতে কতজন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসবে, কত শিক্ষক লাগবে, অবকাঠামো কতটুকু প্রয়োজন হবে, আর্থিক বরাদ্দ কী পরিমাণ দরকার হবে, কত বছরে কী মান আমরা অর্জন করতে চাই- এসব বিষয়ে সুষ্ঠু কোনো পরিকল্পনা নেই। একটার সঙ্গে আরেকটার কোনো সমন্বয় নেই।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, উল্লেখযোগ্য হারে জিপিএ-৫ বাড়লেও শিক্ষার মান কতটা বেড়েছে এ নিয়ে প্রশ্ন সকলের। তবে পরীক্ষার ফলাফলের সাথে আমরা শিক্ষার মানকেও সমানতালে এগিয়ে নিতে পেরেছি কি না এ নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে৷ 

তিনি বলেন, আমাদের দেশের প্রাথমিক শিক্ষার ভিত খুব দুর্বল। এই দুর্বল ভিত থেকে উঠে আসা শিক্ষার্থীরা এক পর্যায়ে কঠিন সমস্যার মুখে পড়েন। সে কারণে আগে প্রাথমিক শিক্ষার মানদণ্ড শক্ত করা জরুরি। জিপিএ-৫ এর সংখ্যা বৃদ্ধি না করে বরং শিক্ষার্থীদের বাস্তবিক জ্ঞান এবং তারা কতটা রপ্ত করতে পেরেছে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। একইসাথে মানবিক মূল্যবোধ, সততা, দেশপ্রেম এবং গভীর জীবনবোধ সম্পন্ন মানুষ হওয়ার দিকেও খেয়াল রাখা জরুরি৷

ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর আবদুল মান্নানের কথাতেও একই শঙ্কা। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, জিপিএ ৫ বাড়লেও শিক্ষায় মান কমার ঘটনাটি উদ্বেগজনক। কেননা জনসংখ্যার যে বিপুল অংশ তরুণ, যারা জাতিকে ‘তারুণ্যের ডিভিডেন্ড’ দেবে বলে আমরা প্রত্যাশা করছি, তারাই ক্রমাগত জাতির জন্য বোঝা হয়ে উঠছে। মানহীন শিক্ষা নিয়ে বেড়ে ওঠা এই বিপুল জনগোষ্ঠী একসময় দেশের জন্য ভার হয়ে উঠতে পারে।

তিনি বলেন, জিপিএ-৫ আসলে কোনো দেশের শিক্ষার মানদণ্ড নির্ধারণ করতে পারে না। পৃথিবীর উন্নত কোনো দেশে জিপিএ-৫ কে এতটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না, যতটা গুরুত্ব দেওয়া হয় বাংলাদেশ এবং পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে।  আমাদের এই বদ্ধমূল চিন্তার খোলস থেকে বের হয়ে আসতে হবে। শুধু ভালো জিপিএর পেছনে না ছুটে শিক্ষার্থীদের আরও বেশি দক্ষ করে তুলতে হবে। পাসের হার বাড়লেই আমরা বলতে পারব না শিক্ষার মান বেড়েছে। এই যে এ বছর এত শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেল তাদের সবার মান তো এক নয়। আর শিক্ষার মান বাড়াতে বাংলাদেশের মানের শিক্ষা নয়, আমাদের প্রয়োজন বিশ্বমানের শিক্ষা।

এমএম/এনএফ