ফারাজ হাবীব খান

ফারাজ হাবীব খান। জন্ম ও বেড়ে ওঠা গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া উপজেলায়। শিক্ষার হাতেখড়ি সেখানেই। পরে পড়াশোনা করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে। ছোটবেলা থেকেই সাহিত্যপ্রেমী ছিলেন ফারাজ। প্রথমে বিসিএসকে বেছে না নিলেও পরে বাবার স্বপ্ন (মারা গেছেন) ও মায়ের অনুপ্রেরণায় ৪১তম বিসিএস-এ অংশ নিয়ে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন তিনি। 
 
সম্প্রতি তিনি ঢাকা পোস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে উন্মোচন করেছেন জীবনের বিচিত্র অধ্যায়ের। তার সে গল্প জানাচ্ছেন ঢাকা পোস্টের নিজস্ব প্রতিবেদক মুছা মল্লিক।

ঢাকা পোস্ট : আপনার নিজের সম্পর্কে কী বলে শুরু করতে চান?
ফারাজ হাবীব খান : আমি পরম সৌভাগ্যবানদের একজন। আল্লাহ আমাকে সম্মানিত করেছেন, জীবনের সর্বত্র স্রষ্টার ভালোবাসার উপস্থিতি সহজাতভাবেই উপলব্ধি করি। সৃষ্টিকর্তা আমাকে পৃথিবীর সেরা বাবা-মা দিয়েছেন। মানুষ আমাকে ভালোবাসে, এই আমার পরম প্রাপ্তি।

ঢাকা পোস্ট :  আপনার ছোটবেলার গল্প শুনতে চাই। 
ফারাজ হাবীব খান : ছোটবেলা থেকেই আমি অন্তর্মুখী। গ্রামে বড় হলেও হৈ হুল্লোড়, মাছ ধরা, দুরন্তপনা-এসব নিয়ে আমার তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না। আমার আলাদা জগৎ ছিল। সেটা হলো বইয়ের জগৎ, রং তুলির জগৎ, কল্পনার জগৎ। আমার সেই জগতে রাজত্ব করতেন সুকুমার রায়, জাফর ইকবাল, রবীন্দ্রনাথ, জুলভার্ন আর মার্ক টোয়েনেরা। সে জগৎ সৃষ্টি করে আমার মধ্যে মেধা ও মননের বীজ রোপণ করেছিলেন আমার বাবা।

ঢাকা পোস্ট :  চাকরির এত ক্ষেত্র থাকতে বিসিএসকে কেন বেছে নিলেন?
ফারাজ হাবীব খান : প্রথমে বিসিএস বেছে নেইনি; বরং প্রাণপণে চাইছিলাম বিসিএসের কঠিন পথে না এসে অন্যকিছু করতে। যেমন উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ যাওয়া বা অন্য চাকরি করা। দেশে করোনা এলো, ব্যাপক ধাক্কা দিলো আমাকে। ঘরবন্দি, চাকরি নেই, বাবা নেই, উপার্জন নেই, ঘরে বৃদ্ধ মা! অনেকটা বাধ্য হয়েই বিসিএস এর যুদ্ধক্ষেত্রে নামলাম।

ঢাকা পোস্ট :  প্রশাসন ক্যাডারে কেন এলেন?
ফারাজ হাবীব খান : আমার বাবা তার জীবনের যৎসামান্য উপার্জন ব্যয় করতেন হতদরিদ্র, শোষিত মানুষের কল্যাণের জন্য। ছোটবেলা থেকেই ধাক্কা খেতে খেতে আমি শিখেছি। আমি জানি সাধারণ মানুষের ভোগান্তি আর বঞ্চনার কথা। মহান আল্লাহ আমাকে সুযোগ দিয়েছেন। প্রশাসন ক্যাডারে থেকে সাধারণ মানুষের জন্য অনেক কিছু করা সম্ভব। সেই থেকেই এ ক্যাডারে এসেছি। 

ঢাকা পোস্ট : লম্বা সিলেবাস; প্রস্তুতি কীভাবে নিয়েছিলেন?
ফারাজ হাবীব খান : আমি বড় বড় বই না পড়ে ছোট বই পড়তাম। প্রচলিত গাইড বই না পড়ে প্রচুর মৌলিক বই, নিবন্ধ, সংবাদপত্র ও ইন্টারনেটের সাহায্য নিয়েছিলাম। লেখনিতে ভিন্নতা আনতে প্রচুর নোট করতাম। পর্যাপ্ত তথ্য, উদ্ধৃতি, চিত্র ও বিশ্লেষণী ক্ষমতার সাহায্যে রচনা, সাহিত্য, বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলিতেও খুব ভালো নম্বর তোলার চেষ্টা করেছিলাম।

ঢাকা পোস্ট : সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ার পর কেমন অনুভূতি ছিল?
ফারাজ হাবীব খান : হাউমাউ করে কাঁদছিলাম মাকে জড়িয়ে। কৃতজ্ঞতা হিসেবে তাৎক্ষণিক নামাজে দাঁড়িয়েছিলাম। সৃষ্টিকর্তা প্রতিটি মানুষের অন্তর জানেন। তার কাছে ফাঁকি চলে না। যে কথা অন্তরের নিভৃতে কাউকে বোঝাতে পারিনি সে কথা রব্বে কারীম শুনেছেন। তার কাছেই সেজদাবনত হয়েছিলাম। বান্দার জীবনে মালিক ছাড়া আর কে আছে? 

ঢাকা পোস্ট : শিক্ষার্থীদের বিসিএস নিয়ে ব্যাপক উদ্দীপনা দেখা যায়। বিষয়টি কীভাবে দেখেন?
ফারাজ হাবীব খান : আমি নিজেও এ পথে আসতে চাইনি, বাধ্য হয়ে আসতে হয়েছে। কারো হাতে বিকল্প থাকলে (ব্যবসা, অন্য চাকরি, বিদেশ যাওয়া, উদ্যোক্তা হওয়া) সেটি গ্রহণ করা উচিত। কারণ, বিসিএস এক অনিশ্চিত ও সময়সাপেক্ষ যাত্রা। এখানে হতাশা আর ব্যর্থতার হারই বেশি। অনেকজনকে দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ থেকেই বিসিএস পড়া শুরু করে। তাদের না হয় বিসিএস, না হয় একাডেমিক পড়াশোনা।

ঢাকা পোস্ট : জীবনের ব্যর্থতার গল্প শুনতে চাই! 
ফারাজ হাবীব খান : চাকরি পাওয়ার আগ পর্যন্ত প্রতিটি গল্পই ব্যর্থতার। আমি খুব বেশি চাকরির পরীক্ষা দেইনি। তবুও প্রতিটি পরীক্ষা দেওয়ার পর আকাশ পানে চেয়ে বলতাম- প্রভু, আর কতদিন ফাইল হাতে এভাবে চলব? আল্লাহর অশেষ কৃপায় আমি মাত্র ৩টি ভাইভায় অংশগ্রহণ করি এবং ৩টিতেই সফল হই।

ঢাকা পোস্ট :  বিসিএস দিতে যারা আগ্রহী, তাদের জন্য কি পরামর্শ থাকবে?
ফারাজ হাবীব খান : বিসিএসে সফল হতে চাইলে শুধু প্রচলিত গাইড বই আর মুখস্থ বিদ্যা কার্যকর নয়। দরকার একাগ্রতা, সৃজনশীলতা আর প্রচণ্ড ধৈর্য! শুধু রাতদিন পড়লেই বিসিএস হয় না। তাই স্রোতে গা ভাসানোর আগে নিজেকে যাচাই করা জরুরি। নতুনদের বলতে চাই- বই পড়ুন। গাইড বই নয়, শুধু পাঠ্যবই নয়। মৌলিক বই, সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন, যা পান পড়ুন। সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়াও ইন্টারনেটের চমৎকার ব্যবহার আছে। প্রচুর বই আছে, নিবন্ধ আছে, সেগুলো পড়ুন। সংবাদপত্র পড়ুন। স্বকীয় কিছু ভাবুন। নিজে নোট করে পড়ুন।

ঢাকা পোস্ট :  ভাইভার প্রস্তুতি কেমন ছিল?
ফারাজ হাবীব খান : নিয়মিত বাংলা ও ইংরেজি পত্রিকা পড়তাম। প্রচলিত গাইড বই পড়ে ভাইভায় ভালো করা সম্ভব নয়। সাহিত্য, রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ে বই পড়তাম ও নোট নিতাম। ভাইভায় ভালো করতে শব্দচয়ন, উচ্চারণ, উপস্থাপন এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সম্যক ধারণা থাকা আবশ্যক।

ঢাকা পোস্ট : পর্দার আড়াল থেকে কেউ অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করে গেছেন? 
ফারাজ হাবীব খান : চারজনের কথা বলব। আমার বাবা, যিনি স্বপ্ন দেখতেন তার ছেলে ক্যাডার হবে। বিষণ্ন পৃথিবীতে আমার অনুপ্রেরণাদাত্রী আমার মা। বিসিএস ভাইভার দিনে মা রোজা রেখেছিলেন। আমার হতাশা, যন্ত্রণা, একাকিত্ব, আর কান্নার সাক্ষী আমার মা, যিনি আমার সঙ্গে কাঁদতেন, মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেন-সব ঠিক হয়ে যাবে। বাকি দুজন আমার চাচা-চাচি। সন্তানের মতোই তারা আমার লালন পালন করেছেন। বিসিএস লিখিত পরীক্ষার রাতগুলোতে তারা না ঘুমিয়ে আমার খোঁজ নিয়েছেন, বার বার চা-নাস্তা-কফি বানিয়েছেন, পরীক্ষার হলে পৌঁছে দিয়েছেন। তাদের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা। এছাড়া আমার ভাই-বোন, অন্যান্য চাচা-ফুপু, এলাকাবাসীর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ, যারা আমাকে সমর্থন আর উৎসাহ দিতেন। এই মানুষগুলো পাশে না থাকলে ফারাজ হাবীব খান থেকে সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফারাজ হাবীব খান হয়ে ওঠার গল্পটাই হয়তো হতো না। 

ঢাকা পোস্ট : জীবনের কঠিন সময়ের গল্প শুনতে চাই।
ফারাজ হাবীব খান : জীবনের অধিকাংশ সময়ই কঠিন ছিল। বাবার আর্থিক সচ্ছলতা ছিল না, ফলে প্রাইভেট পড়ার সুযোগ তেমন হয়নি। এইচএসসির জৈব রসায়ন, বলবিদ্যা, ক্যালকুলাসের মতো জটিল বিষয়গুলো একা একা পড়তে খুব কষ্ট হতো। মা বাবা গ্রামে থাকায় এইচএসসি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা করেছি ঢাকায় চাচার বাসায় থেকে। অন্তর্মুখী ও চুপচাপ স্বভাবের হওয়ায় বন্ধু বান্ধব তেমন ছিল না। আমার সময় কাটতো একাকিত্ব ও বিষণ্নতায়। ২০১৪ সালে স্নাতক পরীক্ষার মধ্যে আমার বাবা মারা যান। পড়াশোনার পাশাপাশি ছাত্র পড়ানো শুরু করি। নিজে চলতাম, কিছু টাকা মাকে দিতাম। মা গ্রামে একা থাকতেন, খারাপ লাগতো। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করার পর বুঝতে পারছিলাম না কি করবো, কোথায় যাব! করোনা মহামারিতে বইপত্র নিয়ে গ্রামে চলে যাই। লকডাউনের দীর্ঘদিন ঘরে বসে নোট করতাম, কখনো পড়তাম, কখনো হতাশ হতাম। বন্ধু নেই, চাকরি নেই, উপার্জন নেই, স্বপ্ন নেই, পৃথিবী আবার স্বাভাবিক হবে তার নিশ্চয়তা নেই! শুধু পাশে ছিল মহান আল্লাহর কৃপা আর মায়ের সমর্থন। 

ঢাকা পোস্ট : প্রশাসন ক্যাডারে নিজেকে কোথায় দেখতে চান?
ফারাজ হাবীব খান : জীবন যেখানে নিয়ে যায়। তবে অসহায় মানুষের মুখে হাসি দেখতে চাই, সে লক্ষ্যে কাজ করতে চাই।

ঢাকা পোস্ট : আমাদের সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। 
ফারাজ হাবীব খান : আপনাকেও ধন্যবাদ। ঢাকা পোস্টের জন্য শুভকামনা। 

এমএম/জেডএস