পরিবারের চাওয়ায় বিসিএসে অংশ নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট হলেন তানভীর

মো. তানভীর ইসলাম সাগর। জন্ম ও বেড়ে ওঠা সিরাজগঞ্জ জেলায়। পড়াশোনার হাতেখড়ি সেখানেই। পরে পড়াশোনা করেছেন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ডেন্টাল সার্জারিতে। ছোটবেলা থেকে ক্রিকেটার হতে চাইলেও সে স্বপ্নের পথে একসময় আর হাঁটা হয়নি।
পড়াশোনা শেষে প্রশাসনের সুযোগ-সুবিধা ও সামাজিক মর্যাদা বিবেচনায় এবং পরিবারের চাওয়ায় ৪১তম বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেন। প্রথমবারেই প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিপ্রাপ্ত হয়েছেন তানভীর।
বিজ্ঞাপন
তার মতে, বিসিএসের দীর্ঘ পরিক্রমায় অনেক ধৈর্যশীল, পরিশ্রমী ও আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। বিসিএস ভাগ্যবান ধৈর্যশীল মেধাবীদের জন্য।
সম্প্রতি ঢাকা পোস্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তানভীর উন্মোচন করেছেন জীবনের বাঁকে বাঁকে ঘটে যাওয়া সফলতা ও ব্যর্থতার নানা অধ্যায়। তার মুখোমুখি হয়েছিলেন ঢাকা পোস্টের নিজস্ব প্রতিবেদক মুছা মল্লিক।
ঢাকা পোস্ট : শুরুতে আপনার সম্পর্কে শুনতে চাই।
তানভীর : আমি পেশায় একজন ডেন্টাল সার্জন। আমি ২০১৯ সালে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ডেন্টাল ইউনিট থেকে বিডিএস পাস করি। তারপর এক বছর ইন্টার্নশিপ করি এবং পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন ট্রেনিং হিসেবে মিটফোর্ড হাসপাতালে জয়েন করি। আমি উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিই ঢাকার নটরডেম কলেজ থেকে এবং মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি শাহজাদপুর সরকারি মডেল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। নিজের সম্পর্কে বলতে গেলে আমি সব সময় আত্মবিশ্বাসী।
ঢাকা পোস্ট : আপনার বেড়ে ওঠা এবং শৈশবের স্মৃতি নিয়ে জানতে চাই।
তানভীর : আমি ছোটবেলায় অত্যন্ত দুরন্ত, ডানপিটে ও প্রাণোচ্ছল ছিলাম। পড়াশোনার পাশাপাশি খুব ক্রিকেট খেলতাম। একসময় ভাবতাম ক্রিকেটার হব। যদিও সেই ইচ্ছা পরে ধরে রাখতে পারিনি। খেলাধুলার পাশাপাশি একাডেমিক ফলাফলে সাফল্যের ধারা অব্যাহত ছিল।
ঢাকা পোস্ট : এত চাকরি থাকতে বিসিএসকে কেন বেছে নিলেন?
তানভীর : বর্তমান তরুণ প্রজন্মের কাছে বিসিএস একটি স্বপ্নের মতো। চাকরির নিরাপত্তা, আকর্ষণীয় বেতন কাঠামো ও সামাজিক মর্যাদার কারণে আমি বিসিএসকে বেছে নিয়েছি।
ঢাকা পোস্ট : প্রশাসন ক্যাডারে কেন আসলেন?
তানভীর : প্রশাসন ক্যাডারে পদোন্নতি বেশ ভালো, কাজে বৈচিত্র্য বেশি। তাই সব সেক্টরের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করার সুযোগ থাকে, পাশাপাশি সামাজিক মর্যাদাও বেশি, তাই এই ক্যাডারে আসা।
ঢাকা পোস্ট : বিসিএসের জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন?
তানভীর : আমার ইন্টার্নশিপ শেষ হওয়ার পর বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার জন্য খুব কম সময় পেয়েছিলাম। তবে এ যাত্রায় অনুপ্রেরণা দিয়েছেন আমার বড় ভাই, যিনি ৩৬তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে কর্মরত রয়েছেন। ভাইয়ের পরামর্শে আমি বিসিএসের এক সেট বই কিনি এবং পড়াশোনা শুরু করি। প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় আমার সাফল্যের মূলমন্ত্র ছিল প্রচুর পরিমাণে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ ও বারবার রিভিশন দেওয়া। লিখিত পরীক্ষার আগে সব নোট করে পড়তাম। ভাইভার জন্য প্রতিদিনের পত্রিকা ও ভাইভার মৌলিক বইগুলো পড়েছিলাম।
ঢাকা পোস্ট : ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ার বিষয়টি জানার পর কেমন অনুভূতি ছিল?
তানভীর : নিঃসন্দেহে এটি ছিল আমার জীবনের সেরা মুহূর্তের একটি। যদিও আমি আত্মবিশ্বাসী ছিলাম আমার ফলাফল নিয়ে, তবুও ফলাফল দেখার পর আবেগপ্রবণ হয়ে গিয়েছিলাম।
ঢাকা পোস্ট : বর্তমানে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিসিএস নিয়ে ব্যাপক উদ্দীপনা দেখা যায়। এমনকি কেউ কেউ বিসিএসকে জীবনের একমাত্র লক্ষ্য মনে করেন। এমনটা কি হওয়া উচিত?
তানভীর : এটা সত্য যে বর্তমান সময়ে বিসিএস নিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে ব্যাপক আগ্রহ দেখা যায়। তবে বিসিএসকে জীবনের একমাত্র লক্ষ্য মনে করা উচিত নয়। একটি বিসিএসে মাত্র এক থেকে দুই শতাংশ শিক্ষার্থীর চাকরির ব্যবস্থা হয়ে থাকে। বাকিরা ফিরে খালি হাতে। তাই শুধু বিসিএসকে একমাত্র লক্ষ্য না ভেবে অন্য চাকরি ও নিজ নিজ পঠিত বিষয়ে দেশে-বিদেশে গবেষণা বা উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে। পাশাপাশি উদ্যোক্তা হিসেবেও নিজেকে গড়ে তোলা যেতে পারে।
ঢাকা পোস্ট : আপনার সফলতার পেছনে নিশ্চয়ই ব্যর্থতার গল্পও লুকিয়ে আছে। এমন কিছু ব্যর্থতার গল্প শুনতে চাই।
তানভীর : পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি না পাওয়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি পরীক্ষায় কাঙ্ক্ষিত সাফল্য না পাওয়া আমার জীবনের কিছু ব্যর্থতা, আমি হেরেছি। তবে সফল হওয়ার তাড়নার সামনে সেই হার স্থায়ী হতে পারেনি। অসময়ের অন্ধকারকে আলোয় রূপ দিতে পারলেই সাফল্যে ধরা দেয়। বহু দূর হেঁটে ক্লান্ত হলেও হাল ছাড়লে চলবে না। আপনাকে প্রতিনিয়তই হারতে হবে জীবনের বাঁকে বাঁকে। তবুও সফলতার শেষ সীমারেখা অবধি পৌঁছাতেই হবে।
ঢাকা পোস্ট : চিকিৎসা বিজ্ঞানে পড়াশোনা করেও প্রশাসনে কেন এলেন?
তানভীর : প্রশাসনের সুযোগ-সুবিধা ও সামাজিক মর্যাদা আমাকে ব্যাপকভাবে আকৃষ্ট করে। পাশাপাশি আমার পরিবারের সদস্যদেরও চাওয়ায় প্রশাসন ক্যাডারে এসেছি।
ঢাকা পোস্ট : বিসিএস দিতে যারা আগ্রহী তাদের জন্য কী পরামর্শ থাকবে?
তানভীর : বিসিএস একটি দীর্ঘ যাত্রা। তাই যারা বিসিএস দিতে আগ্রহী তাদের প্রতি পরামর্শ থাকবে– যেন সব সময় ধৈর্য ধারণ করে ও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন না করা পর্যন্ত পরিশ্রম চালিয়ে যায়। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের বইগুলো পুনরায় আয়ত্তে আনতে হবে। নিয়মিত পত্রিকা পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। নিজের দুর্বল বিষয়গুলো কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করতে হবে, প্রয়োজনে শিক্ষকদের সহায়তা নিতে হবে।
ঢাকা পোস্ট : তাদের ভাইভার জন্য প্রস্তুতি কেমন হতে হবে?
তানভীর : ভাইভা নিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন বেশ কিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিয়েছেন। এখন আর প্রার্থীকে তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ক্যাডার ভিত্তিক পড়াশোনা, নিজ জেলা, ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন করা হবে না। একজন ভাইভা প্রার্থীকে অবশ্যই সঠিক পোশাক পরিচ্ছদ পরিধান করা, ভাইভা বোর্ডে কোনটি আচরণীয় আর কোনটি আচরণীয় নয় তা জানা, কোনো প্রশ্ন না জানলে সাবলীলভাবে দুঃখিত বলার অভ্যাস গড়ে তোলা, নিজের পঠিত বিষয়ের সামগ্রিক ধারণা নিয়ে যাওয়া, সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া নানা বিষয়, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বিশদ ধারণা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রচিত বইগুলো, সরকারের নানা সাফল্য ও মেগা প্রজেক্ট, সংবিধান ও আইনকানুন সম্পর্কে সামগ্রিক ধারণা, ইংরেজিতে কিছু বলার চর্চা করতে হবে। পাশাপাশি ঝুঁকি এড়াতে নিজ জেলা ও ক্যাডার ভিত্তিক পড়াশোনা করতে হবে।
ঢাকা পোস্ট : আপনার সাফল্যের পেছনে পর্দার আড়ালে থেকে কেউ কি অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করে গেছেন? কার কথা বেশি মনে পড়ে?
তানভীর : আমার মা-বাবা,ভাই-বোন, স্কুলকলেজের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকমণ্ডলী আমার অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করেছেন। তবে আমার বড় দুই ভাই মো. আমিনুল ইসলাম ও প্রকৌশলী মো. রুহুল আমিন বেশি অনুপ্রাণিত করেছেন।
ঢাকা পোস্ট : নতুনদের উদ্দেশে কি পরামর্শ থাকবে?
তানভীর : বিসিএসের এই দীর্ঘ পরিক্রমায় অনেক ধৈর্যশীল, পরিশ্রমী ও আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। এটা মনে রাখতে হবে যে, বিসিএস ভাগ্যবান ধৈর্যশীল মেধাবীদের জন্য।
ঢাকা পোস্ট : জীবনের কঠিন সময়ের গল্প শুনতে চাই।
তানভীর : বিসিএসের ভাইভা থেকে চূড়ান্ত ফলাফল পাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সময়টা ছিল আমার জীবনের কঠিন সময়ের কিছু অংশ। এসময় প্রতিটি দিন নানারকম উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় কাটত।
ঢাকা পোস্ট : প্রশাসন ক্যাডারে নিজেকে কোথায় দেখতে চান?
তানভীর : নিজেকে একজন দক্ষ প্রশাসক হিসেবে দেখতে চাই। পাশাপাশি পড়াশুনা চালিয়ে যেতে চাই। জনগণের সেবক হওয়াটাই আমার একমাত্র লক্ষ্য।
/এমএম/এসএসএইচ/