এক বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

করোনা মহামারির কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ রয়েছে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এতে চরম ক্ষতির সম্মুখীন  হচ্ছে চার কোটির বেশি শিক্ষার্থী। উচ্চশিক্ষায় সেশনজট আর প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে তৈরি হচ্ছে পরীক্ষাজট। এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে দ্রুতই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন শিক্ষক-অভিভাবক ও বিশিষ্টজনরা। যদিও ভিন্ন মতও পোষণ করেছেন কেউ কেউ।

এদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরাও। এ দাবিতে তারা রাজপথে আন্দোলনেও নেমেছেন। সোমবার (২৪ মে) জাতীয় প্রেসক্লাবে ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজ, ঢাকা সিটি কলেজসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন সংশ্লিষ্ট কলেজের শিক্ষার্থীরা। এ সময় দ্রুত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা না হলে বড় ধরনের আন্দোলনের হুমকি দেন তারা।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পক্ষে সম্প্রতি বিভিন্ন মাধ্যমে কথা বলেন দেশের বিশিষ্টজনেরা। পক্ষে আছেন সরকারের উচ্চ পর্যায়ে থাকা বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও। প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা মসিউর রহমান এ বিষয়ে বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার বিষয়টি অবশ্যই ভেবে দেখা দরকার। 

অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া জরুরি। সেটি যে প্রক্রিয়া অবলম্বন করেই হোক না কেন। সেটি হতে পারে ক্রম করে অথবা গ্রুপ করে। কিংবা এক দিন পরপর ক্লাস নিয়ে। বেসরকারি বিভিন্ন জরিপে বেশিরভাগ শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার ব্যাপারে শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন মহলের দাবির ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয় অবগত আছে। এখন পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ বা খোলা রাখার বিষয়ে যেসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে তা করোনা মোকাবিলায় সরকার গঠিত পরামর্শক কমিটি ও আন্ত:মন্ত্রণালয়ের মতামত নিয়ে করা হয়েছে। এ মুর্হূতে কী করণীয় তা খুব দ্রুতই জানানো হবে। শিক্ষামন্ত্রী দুএকদিনের মধ্যে এ ব্যাপারে ব্রিফিং করবেন।

৯৭ ভাগ অভিভাবক স্কুল খোলার পক্ষে

বেসরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠান করোনাকালে শিক্ষার ক্ষতি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার বিষয়ে সম্প্রতি একটি জরিপ পরিচালনা করে। এর মধ্যে পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) যৌথ গবেষণা জরিপের ফলাফলে বলা হয়, দেশের ৯৭ দশমিক ৭ শতাংশ প্রাথমিক শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলেছেন, স্কুল খুললে তারা সন্তানদের স্কুলে পাঠাবেন। আর মাধ্যমিকের ৯৬ শতাংশ অভিভাবক সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর পক্ষে মত দিয়েছেন।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার মোর্চা গণস্বাক্ষরতা অভিযান পরিচালিত ‘এডুকেশন ওয়াচ’এক প্রতিবেদনে জানায়, দেশের ৭৬ শতাংশ অভিভাবক মনে করেন এখন স্কুলে খুলে দেওয়া উচিত। ৮০ শতাংশ এনজিও কর্মী মনে করেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখন খুলে দেওয়া যায়। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে স্কুল খুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে আরও ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন ৫৮ শতাংশ শিক্ষার্থীর অভিভাবকরা।

‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশে’র করা এক অনলাইন জরিপে বলা হয়, ৫৪ দশমিক ৭ শতাংশ অভিভাবক সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে নিরাপদবোধ করছেন না। তবে ৬৮ শতাংশ শিক্ষক স্কুলে যেতে নিরাপদ মনে করছেন। অভিভাবক ও শিক্ষক ছাড়া অন্যান্যদের মধ্যে ৬০ দশমিক ৫০ শতাংশ মানুষ স্কুল খোলা উচিত বলে মনে করেন।

তিন কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া উচিত

গত বছরের মার্চ থেকে বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষাখাতে তিনটি প্রধান সংকট সামনে এসেছে। এগুলো হলো- শিখন ঘাটতি, শিক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি এবং শিক্ষার বিভিন্ন স্তরের বৈষম্য। তাই এ তিন সংকট দ্রুত কাটিয়ে উঠতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া উচিত বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান।

তিনি বলেন, দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের মধ্যে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। বন্ধের সময় শিক্ষার্থীদের বিকল্প উপায়ে পাঠদান করতে গিয়ে অভিভাবকদের ব্যয় বেড়েছে।

ব্যয় বাড়লেও শিক্ষার ঘাটতি দূর হচ্ছে না। তাই শিক্ষার ঘাটতি ঠেকানো, শিক্ষার্থীদের ক্লাসরুমে ফিরিয়ে আনা এবং অভিভাবকদের আশঙ্কা দূর করতে পুনরায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া প্রয়োজন। এ মুহূর্তে তা করতে না পারলে শিক্ষার সুদূরপ্রসারী ক্ষতি অদূর ভবিষ্যতেও পূরণ করা সম্ভব হবে না।

অগ্রাধিকার পাবে এসএসসি-এইচএসসি ব্যাচ

গত বছর করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর শিক্ষাই সবচেয়ে বড় ক্ষতিগ্রস্ত খাত। এর মধ্যে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাচ হলো ২০২১ সালের এসএসসি-এইচএসসি ব্যাচ। এবার এসএসসি পরীক্ষার্থীরা পাক নির্বাচনি বা নির্বাচনি কোনো পরীক্ষা দিতে পারেনি।

২০২১ সালের এসএসসি ব্যাচটি করোনার আগে দশম শ্রেণিতে ক্লাস করতে পেরেছে মাত্র আড়াই মাস। এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা দ্বাদশ শ্রেণিতে অটো পাস নিয়ে উঠেছে। দ্বাদশ শ্রেণিতে একদিনও সরাসরি ক্লাস করতে পারেনি তারা। এ কারণে সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচিতে তাদের পরীক্ষা নেওয়া হবে।

শিক্ষাবোর্ড সংশ্লিষ্টরা জানান, গত এক যুগ ধরে স্বাভাবিক সময়ে প্রতি বছর ফেব্রুয়ারিতে এসএসসি ও এপ্রিলে এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হয়। কিন্তু গত বছর করোনায় এইচএসসি পরীক্ষা না নিয়ে অটোপাস দিতে বাধ্য হয় সরকার। আর এ বছর পরীক্ষা নেওয়ার কথা ভাবলেও চলমান পরিস্থিতিতে সঠিক সময়ে পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হয়নি। যথাক্রমে ৬০ দিন ও ৮৪ দিনের সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে জুন-জুলাইয়ে মাধ্যমিক ও সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা নেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। তবুও এখন এই দুই পাবলিক পরীক্ষা নিয়ে অনিশ্চয়তা আর ধোঁয়াশা কাটছে না। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মতো এসএসসি ও এইচএসসি-২০২১ ব্যাচের পরীক্ষার্থীরাও পড়ছে সেশন জটে। তাদের সময়ের এই ঘাটতি নিয়ে চিন্তিত পরীক্ষার্থী-অভিভাবকরা।

এ বিষয়ে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয়ক ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নেহাল আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনায় যা ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ করা খুব কঠিন। তবে এটা যাতে আর দীর্ঘ না হয় সেজন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিয়ে ক্লাস রুমে পড়িয়ে পরীক্ষা নেওয়ার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের অবশ্যই সময়ের অপচয় হচ্ছে। আমি মনে করি, সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করে এবং যুক্তিসঙ্গত রুটিন তৈরি করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পরীক্ষা নেওয়া উচিত।

 এনএম/এসকেডি/জেএস