হীরক জয়ন্তী উৎসব
প্রাক্তন-বর্তমানদের মিলনমেলায় হলি ক্রস কলেজে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস
তেজগাঁওয়ের হলি ক্রস কলেজের আজকের সকাল ছিল অন্য দিনের চেয়ে অনেক আলাদা। নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষা আর পড়াশোনার রুটিনে খানিকটা ছেদ ফেলে সকাল থেকে পুরো কলেজ মেতে ওঠে প্রতিষ্ঠার ৭৫তম বর্ষপূর্তির উদযাপন ঘিরে৷ কলেজ প্রাঙ্গণটিতে ঢুকতেই চোখে পড়ে রঙিন ফেস্টুন, ফুলে সাজানো গেট আর ছাত্রীদের মুখে উৎসবের হাসি।
শনিবার সকাল থেকে সবাই রয়েছে অপেক্ষার এক বিশেষ মুহূর্তের। সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে শুরু হয় কলেজ প্রাঙ্গণ থেকে বর্ণাঢ্য র্যালি। অংশ নেন বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ অসংখ্য অতিথি।
বিজ্ঞাপন
র্যালি শেষে কলেজ মাঠে আয়োজন করা হয় ‘হলি ক্রস দিবস’ উদযাপন অনুষ্ঠান। সাজানো মঞ্চে একে একে বক্তব্য দেন অধ্যক্ষ সিস্টার শিখা লেটিসিয়া গমেজ, পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি আর্চবিশপ বিজয় এন. ডিক্রুজ এবং প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা।
বিজ্ঞাপন
কলেজ অধ্যক্ষ সিস্টার শিখা লেটিসিয়া গমেজ বলেন, আমরা খুবই আনন্দিত ও গর্বিত যে স্বনামধন্য হলি ক্রস কলেজ ৭৫ বছর পেরিয়ে আজ ৭৬ বছরে পদার্পণ করেছে। এই দীর্ঘ ইতিহাসে হলি ক্রস নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে যে ভূমিকা রেখেছে, তার তুলনা কেবল হলি ক্রসের সঙ্গেই করা যায়। আমরা শুধু শিক্ষা দিই না, দিই মানবিক মূল্যবোধ, শ্রদ্ধাবোধ ও ব্যক্তিত্বের বিকাশের শিক্ষা। প্রতিটি ছাত্রীকে আমরা যত্ন, ভালোবাসা ও সেবার মধ্য দিয়ে গড়ে তুলি।
তিনি আরও বলেন, আমরা আমাদের ঐতিহ্য ধরে রাখছি। আমাদের শিক্ষার্থীরা যেন নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ পরিবেশে বেড়ে ওঠে, সেই প্রতিশ্রুতিই আমরা দিচ্ছি। হলি ক্রস কখনোই তার মূল্যবোধে আপস করবে না। সমাজের ধারা বদলাতে পারে, কিন্তু মানবিক বোধের মর্ম অম্লান থাকবে। আমরা স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটা মাছের মতো—চ্যালেঞ্জ যতই আসুক, আমরা এগিয়ে যাব।
হলি ক্রস কলেজের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি আর্চবিশপ বিজয় এন. ডিক্রুজ বলেন, নারী শিক্ষা জগতে হলি ক্রস একটি দৃষ্টান্ত। আমরা শুধু পাঠ্যবই শেখাই না, মানুষকে মানুষ হতে শেখাই। নারী যেন তার মর্যাদা নিয়ে পৃথিবীর বুকে দাঁড়াতে পারে, নেতৃত্ব দিতে পারে, সমাজে পরিবর্তন আনতে পারে—এই চেতনায় আমরা কাজ করছি।
তিনি জানান, আগামী ডিসেম্বরের ১৮, ১৯ ও ২০ তারিখে বড় পরিসরে ৭৫তম বর্ষপূর্তির মহোৎসব আয়োজন করা হবে। সেখানে প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা একত্রিত হবেন৷ এটি হবে ভালোবাসা, স্মৃতি ও ঐক্যের মহামিলন।
আধুনিক যুগে নারী শিক্ষার চ্যালেঞ্জ অনেক উল্লেখ করে আর্চবিশপ বিজয় এন. ডিক্রুজ আরও বলেন, সমাজে নারীর অধিকার এখনো সংকুচিত, বিভিন্নভাবে অবহেলিত। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি, শিক্ষা হলো মুক্তির একমাত্র পথ। তাই আমরা চাই আমাদের শিক্ষার্থীরা হোক আত্মবিশ্বাসী, নৈতিক এবং নেতৃত্বগুণে সমৃদ্ধ।
উৎসবের এই আয়োজন ঘিরে শিক্ষার্থীরাও ছিল বেশ উচ্ছ্বসিত। দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী নাদিয়া ইসলাম বলেন, এই কলেজে পড়া মানেই শুধু ভালো রেজাল্ট নয়, একজন সচেতন মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠা। আমরা এখানে শিখি কিভাবে একজন মানবিক ও দায়িত্বশীল মানুষ হতে হয়। আজকের হীরক জয়ন্তী উদযাপন আমাদের জন্য গর্বের দিন। আমরা সবাই একসাথে উৎসবের আনন্দ উদযাপন করছি৷
একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী রুবাইয়া তাসনিম বলেন, আজকের উৎসব আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, আমরা একটি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানে আছি৷ যেখানে নারী শিক্ষার গুরুত্ব সবসময় অগ্রাধিকার পায়। সত্যিই অনেক ভালোলাগা কাজ করছে৷
হীরক জয়ন্তী উৎসবের উদ্বোধনী পর্বে উপস্থিত ছিলেন প্রাক্তন শিক্ষার্থীরাও। হলি ক্রস কলেজের প্রাক্তন ছাত্রী এবং অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফাহমিনা হাসিন বলেন, আজ এখানে ফিরে আসতে পেরে সত্যিই খুব ভালো লাগছে। এই কলেজ আমাদের শুধু পাঠ্যবইয়ের শিক্ষা দেয়নি, আমাদের মানবিক মূল্যবোধ, আত্মবিশ্বাস এবং নেতৃত্ব প্রদানের শিক্ষা দিয়েছে। ৭৫ বছরের এই যাত্রা দেখিয়ে দিয়েছে যে, হলি ক্রস শুধু শিক্ষার ক্ষেত্রেই নয়, নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রেও অনন্য ভূমিকা রেখে এসেছে। আজকের অনুষ্ঠান আমাদের প্রাক্তনদের জন্য এক নস্টালজিক মুহূর্ত। যেখানে আমরা আবার আমাদের কলেজ পরিবারের সঙ্গে একত্রিত হতে পেরেছি।
উল্লেখ্য, ১৯৪৯ সালে তেজগাঁওয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় হলি ক্রস কলেজ। অল্প কিছু শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু হলেও সময়ের পরিক্রমায় এটি আজ দেশের অন্যতম সেরা নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কলেজটি ক্যাথলিক চার্চ পরিচালিত হলেও এখানে ধর্ম, জাতি বা সম্প্রদায় নির্বিশেষে সবাই সমানভাবে শিক্ষা লাভ করে। প্রতি বছর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় অসাধারণ ফলাফল, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং নেতৃত্বে এগিয়ে থাকা শিক্ষার্থীরা এই প্রতিষ্ঠানের গৌরব বহন করছে।
আরএইচটি/এনএফ