মাদ্রাসা বোর্ড চেয়ারম্যান
১৫ বছর ধরে মাদ্রাসা শিক্ষাকে ‘সন্দেহে’র কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে
দেশের সরকারি-বেসরকারি মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে কমেছে। শহরাঞ্চলের কিছু বড় মাদ্রাসা তুলনামূলক স্থিতিশীল থাকলেও গ্রাম ও মফস্বলের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থী সংকটে ভুগছে। অনেক মাদ্রাসায় আসন খালি থাকছে বছরের পর বছর। শ্রেণিকক্ষ অলস পড়ে আছে আর অভিভাবকদের আস্থাহীনতায় দিন দিন কমছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা।
এ বিষয়ে মাদ্রাসা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মিঞা মো. নূরুল হকের মূল্যায়ন আরও সুস্পষ্ট। তার মতে, শুধু অবকাঠামো নয়, সমাজে দীর্ঘদিন ধরে তৈরি হওয়া সন্দেহ, অবিশ্বাস ও অবমূল্যায়নের সংস্কৃতি মাদ্রাসা শিক্ষার মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে গত ১৫ বছর ধরে চাকরির ক্ষেত্রে বঞ্চনা, সার্টিফিকেটকে ‘অকেজো’ তকমা দেওয়া এবং মাদ্রাসাকে সরকারিভাবে সন্দেহের চোখে দেখার প্রবণতা শিক্ষার্থী কমায় সরাসরি প্রভাব ফেলেছে।
বিজ্ঞাপন
তিনি বলেন, দাখিল পাস করে প্রতিবছর দেড় থেকে দুই লাখ শিক্ষার্থী মাদ্রাসার আলিম শ্রেণিতে ভর্তি না হয়ে সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে কলেজে গিয়ে ভর্তি হচ্ছে। যা সংকটের গভীরতাকে আরও স্পষ্ট করছে।
সম্প্রতি ঢাকা পোস্টের সঙ্গে ‘একান্ত আলাপে’ প্রফেসর নূরুল হক এসব কথা বলেন।
বিজ্ঞাপন
তিনি মনে করেন, মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই সামাজিকভাবে নানা ভুল ধারণা প্রচলিত রয়েছে। এ ছাড়া এখানে শিক্ষার মান নিয়েও কিছু কিছু প্রশ্ন আছে। যদি মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষার মান নিশ্চিত করা যায় এবং মাদ্রাসার সনদকে গুরুত্ব দেওয়া হয় তাহলে শিক্ষার্থীর ঘাটতি কমিয়ে আনা সম্ভব হতে পারে।
বোর্ড চেয়ারম্যান বলেন, গত ১৫ বছর পুলিশ, আর্মি, বিজিবিসহ বিভিন্ন সরকারি ও আধা সরকারি চাকরিতে মাদ্রাসার সার্টিফিকেটধারীরা বঞ্চিত হয়েছে। পাশাপাশি সমাজে মাদ্রাসা শিক্ষাকে ঘিরে এক ধরনের সন্দেহ উৎপাদন করা হয়েছে। ‘জঙ্গি তৈরির কারখানা’— উপাধি দিয়ে নেতিবাচক প্রচারণার কারণে এমন একটি ধারণা তৈরি হয়েছে যে, মাদ্রাসা থেকে প্রাপ্ত সার্টিফিকেট কোনো কাজে আসে না। ফলে শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ দাখিল পাস করার পর মাদ্রাসায় না থেকে কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে চলে যাচ্ছে।
উদাহরণ হিসেবে মিঞা মো. নূরুল হক উল্লেখ করেন, চলতি বছর দাখিলে (মাধ্যমিক) পরীক্ষার্থী ছিল প্রায় ২ লাখ ৯৪ হাজার। অথচ আলিমে (উচ্চ মাধ্যমিক) পরীক্ষা দিয়েছে মাত্র ৮৬ হাজার শিক্ষার্থী। প্রায় ২ লাখ শিক্ষার্থীর একটা ‘গ্যাপ’ তৈরি হয়েছে। এদের একটা বড় অংশই কলেজের সাধারণ শিক্ষার দিকে চলে গেছে। আর কিছু শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে।
বোর্ড চেয়ারম্যান মনে করেন, মাদ্রাসা শিক্ষার মান (কোয়ালিটি) নিশ্চিত করা গেলে পরিবার ও সমাজের নেতিবাচক মনোভাব পাল্টানো সম্ভব। আস্থা বাড়লে শিক্ষার্থীরা মাদ্রাসা থেকেই উচ্চশিক্ষা নিতে আগ্রহী হবে।
মিঞা মো. নূরুল হক বলেন, যখন শিক্ষার মান নিশ্চিত হবে, তখন শিক্ষার্থীর অভাব হবে না। মানুষ বুঝবে মাদ্রাসা শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থী যেমন ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করে, তেমনি চাকরির যোগ্যতাও অর্জন করতে পারে। সেজন্য আমি মনে করি, মাদ্রাসা শিক্ষার ওপর সামাজিক ও সরকারি আস্থা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। সেটা সরকারি-বেসরকারি সব পক্ষ থেকেই দরকার। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মাদ্রাসা শিক্ষার মান বৃদ্ধি, সচেতনতা সৃষ্টি ও নেতিবাচক ধারণাগুলো দূর করা।
তিনি বলেন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য ফ্রি বই, মিড-ডে মিল এবং উপবৃত্তির মতো সুবিধা রয়েছে। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও যদি এ ধরনের সুযোগ-সুবিধা পায়, তাহলে তাদের শিক্ষার মান ও অংশগ্রহণের সুযোগ আরও বৃদ্ধি পাবে এবং তারা দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে অন্যদের সঙ্গে সমানভাবে এগিয়ে যেতে পারবে।
দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে মাদ্রাসা শিক্ষার মান উন্নয়নে সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন উল্লেখ করে বোর্ড চেয়ারম্যান বলেন, আমি এমন এক সময় দায়িত্ব পালন করছি যখন দীর্ঘদিনের সংকোচন নীতি মাদ্রাসা শিক্ষার গতি ও মানকে পিছিয়ে দিয়েছিল। আমি চাই স্থায়ী পরিবর্তন– শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে হবে। মূল কাজ করবেন মাঠের শিক্ষকরা। তাদের মোটিভেশনই সবচেয়ে বড় বিষয়। সেজন্য আমি নিজেও নিয়মিত মাঠপর্যায়ে কাজ করছি। শুক্রবার ও শনিবার বিভিন্ন মাদ্রাসা পরিদর্শন করছি এবং শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করছি। কারণ, সরকার যত পরিকল্পনাই করুক না কেন, বাস্তবায়ন করবেন শিক্ষকরা। তাই তাদের সচেতন, অনুপ্রাণিত ও দক্ষ হতে হবে।
শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার প্রতি জোর দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে মিঞা মো. নূরুল হক জানান, এ বছর বোর্ড পরীক্ষার সময় কড়া নজরদারি করা হয়েছে এবং খাতা মূল্যায়নেও যথাযথ প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়েছে। বেশি বা কম নম্বর দেওয়ার পুরোনো অসুস্থ প্রতিযোগিতা আর চলবে না। খাতা পড়ে যার যা প্রাপ্য, তাই দেওয়া হবে। পাসের হার কমলেও সমস্যা নেই কিন্তু ছাত্রদের বুঝতে হবে পড়াশোনা ছাড়া ভালো নম্বর পাওয়া সম্ভব নয়।
‘আমাদের এই পদক্ষেপকে শিক্ষাব্যবস্থায় নতুন এক যুগের সূচনা হিসেবে মনে করছি। যেখানে শিক্ষার্থীরা যোগ্যতার ভিত্তিতে সঠিক মূল্যায়ন পাবে আর শিক্ষকরা উৎসাহ ও দায়িত্ববোধ নিয়ে পাঠদান করবেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি মাদ্রাসা শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’
মাদ্রাসা শিক্ষায় ইতিবাচক পরিবর্তনে সারা দেশের সব শিক্ষককে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আপনারাই (শিক্ষকরা) মাদ্রাসা শিক্ষার মূল শক্তি। সততা, নিষ্ঠা ও উদ্যম দিয়ে পাঠদান করলে শিক্ষার্থীরা বাস্তবতাকে বোঝার পাশাপাশি প্রকৃত যোগ্যতা অর্জন করবে। প্রত্যেক শিক্ষক যেন নিজের দায়িত্বকে শুধু কর্তব্য নয় বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ার একটি সুযোগ হিসেবে দেখেন, এটাই আপনাদের প্রতি আমার চাওয়া।
আরএইচটি/এসএসএইচ