প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধ এবং অপুষ্টি দূর করতে চালু করা ‘দারিদ্র্য-পীড়িত এলাকায় স্কুল ফিডিং’ প্রকল্পের মেয়াদ চলতি মাসে শেষ হচ্ছে। প্রকল্পের অধীনে ৩০ লাখ শিক্ষার্থীকে প্রতিদিন ৩৩৮ কিলো ক্যালোরি শক্তির বিস্কুট বিতরণ করা হয়। এতে অতিদরিদ্র পরিবারের দৈনিক খাদ্য ব্যয় ৪ দশমিক ০৪ শতাংশ কমেছে।

শিক্ষার্থীদের খাবার দেওয়া নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের (ডিপিই) নতুন কোনো প্রকল্প অনুমোদন না হওয়ায় চলমান এই প্রকল্পটির মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের সচিবের উদাসীনতায় এখন পর্যন্ত প্রস্তাবটি একনেকে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন অন্য কর্মকর্তারা। মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাবটি অনুমোদন না হলে আগামী মাস থেকে এই বিপুল পরিমাণ শিক্ষার্থীর অপুষ্টির শিকার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমনকি তাদের শিক্ষা জীবনেরও ইতি ঘটতে পারে।

প্রাথমকি ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে।

জানা গেছে, দেশের দারিদ্র্য-পীড়িত ১০৪টি উপজেলায় ২০১০ সাল থেকে ৩০ লাখ শিক্ষার্থীকে প্রতিদিন ৭৫ গ্রামের এক প্যাকেট বিস্কুট বিতরণ করা হয়। প্রকল্পটি প্রথম দফায় ২০১০ সালের ১ জুলাই থেকে ২০১৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাস্তবায়ন করা হয়। পরে সংশোধন করে গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এর মেয়াদ বাড়ানো হয়। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ১১৪২ কোটি ৭৯ লাখ ৯১ হাজার টাকা। এরমধ্যে জিওবি ৫৯৭ কোটি ৭০ লাখ ৫৭ হাজার ও প্রকল্প সাহায্য ৫৪৫ কোটি ৯ লাখ ৩৪ হাজার টাকা।

বিস্কুট বিতরণের সফলতা থেকে সারাদেশের প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের দুপুরে খাবর দিতে প্রণয়ন করা হয় জাতীয় স্কুল মিল নীতিমালা-২০১৯। নীতিমালা অনুযায়ী ‘প্রাইমারি স্কুল মিল’ প্রকল্পটি গত ১ জুন একনেকে উত্থাপন করা হয়। শিক্ষার্থীদের দুপুরের খাবর খিচুড়ি দেওয়ার প্রস্তাব করায় প্রধানমন্ত্রী ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) সংশোধনে নির্দেশ দিয়েছেন।

দারিদ্র্য-পীড়িত এলাকায় স্কুল ফিডিং প্রকল্পটি গত ডিসেম্বরে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ‘প্রাইমারি স্কুল মিল’ প্রকল্পটির অনুমোদনের বিলম্ব হওয়ার কারণে ব্যয় না বাড়িয়ে চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত আরেক দফা মেয়াদ বাড়ানো হয়। করোনার কারণে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে স্কুল বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা যাতে ঝরে না পড়ে সেজন্য চলমান প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল। মহামারির মধ্যেও শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিস্কুট বিতরণ করেছেন।

গত ১০ জুন প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাবে বলা হয়েছে, চলমান স্কুল মিল প্রকল্পটি ৩০ জুন শেষ হয়ে যাবে। নতুন প্রকল্প অনুমোদন না হওয়ায় আগামী মাস থেকে শিক্ষার্থীদের মাঝে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা সম্ভব হবে না। এতে শিশুদের স্বাস্থ্যের অপূরণীয় ক্ষতি হবে। এছাড়া স্কুল ফিডিং কার্যক্রম পর্যালোচনা করে বাস্তবায়নযোগ্য এবং ব্যয় প্রাক্কলনের যথার্থতা যাচাই করতে অন্তত এক বছর সময় লাগবে। এ পরিস্থিতিতে চলমান প্রকল্পের মেয়াদ শেষে খরচ না হওয়া ৪৭৩ কোটি ৯ লাখ টাকা দিয়ে আগামী এক বছর শিক্ষার্থীদের উচ্চ পুষ্টিমান সমৃদ্ধ বিস্কুট বিতরণ করা সম্ভব হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, মন্ত্রণালয় প্রস্তাব পেয়েও ডিপিপি সংশোধনের মাধ্যমে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়নি। খোদ মন্ত্রণালয়ের সচিব এখানে বাধা হয়ে আছেন বলে জানান তিনি। ওই কর্মকর্তা জানান, সচিব চান বিকাশ ও রকেটসহ অন্যান্য এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সরাসরি শিক্ষার্থীদের খাবারের টাকা দেওয়া হোক। এর নেপথ্যে সচিবের ‘কমিশন’ বাণিজ্য থাকতে পারে বলে সন্দেহ করছেন তারা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) মো. রুহুল আমিন বলেন, আমরা ভেবেছিলাম চলমান প্রকল্প শেষ হওয়ার আগেই নতুন প্রকল্পটি অনুমোদন হবে। কিন্তু সেটি হয়নি। প্রধানমন্ত্রী ডিপিপি সংশোধনের নির্দেশ দিয়েছেন। ডিপিপি সংশোধন করতে সময় লাগবে। আবার এ মাসে চলমান প্রকল্পের মেয়াদও শেষ হয়ে যাবে।

বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর মন্তব্য করে তিনি এ প্রতিবেদককে প্রতিমন্ত্রী বা সচিবের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। এ বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব গোলাম মো. হাসিবুল আলমের বক্তব্য চাইলে তিনি এ প্রসঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেনকে তার দফতরে পাওয়া যায়নি। একাধিকবার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি।

প্রকল্পভুক্ত এলাকার শিক্ষকরা জানিয়েছেন, এটি সরকারের একটি সফল প্রকল্প। আগামী মাস থেকে বন্ধ হয়ে গেলে শিশু শিক্ষার্থীদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এছাড়া বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে সারাদেশে স্কুল মিল চালুর অঙ্গীকার ছিল। সেটি বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। করোনার কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় দরিদ্র বহু শিক্ষার্থী এরইমধ্যে ঝরে পড়ছে। দরিদ্র হলেও বিস্কুট পাওয়ার আশায় এখনও বহু শিক্ষার্থী পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। বিস্কুট বিতরণ বন্ধ হলে তাদের আর লেখাপড়ায় ধরে রাখা যাবে না। পরিবারের খাদ্য সংকটের কারণে তারা কাজে যোগ দেবে।

যতদিন নতুন প্রকল্প অনুমোদন না হয় ততদিন প্রকল্পটি চালু রাখার দাবি জানিয়েছেন শিক্ষকরা।

এনএম/এমএইচএস/জেএস