কিশোরগঞ্জের ভৈরবে প্রাথমিক স্কুলে ১১ বছর শিক্ষকতা করেছেন নাঈমা জান্নাত। ২০১৮ সালে স্বামীর কর্মস্থল ঢাকার একটি স্কুলে বদলি হয়ে আসেন তিনি। নতুন কর্মস্থলে বদলি হয়ে আসার পর শিক্ষকদের জ্যেষ্ঠতার তালিকায় তার নাম আর উঠছে না। কারণ, তার আগের কর্মস্থলের ১১ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা আর কাজে আসছে না।  

লালবাগ থানা শিক্ষা অফিস থেকে জানানো হয়েছে আগামী ১০ বছরেও জ্যেষ্ঠতার তালিকায় তার নাম আসবে না। অথচ স্থানীয়ভাবে নিয়োগ পেয়ে ৭ বছরের মাথায় অন্য শিক্ষকদের নাম জ্যেষ্ঠতার তালিকায় এসেছে।

জান্নাত ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বদলি হয়ে এসে কি আমি অপরাধ করেছি? শুধু আমি নয়, সারা দেশে হাজার হাজার সহকারি শিক্ষক রয়েছেন, যারা নিজ উপজেলা থেকে অন্য উপজেলা, জেলা ও মহানগরে বদলি হওয়ার পর জ্যেষ্ঠতা পাচ্ছেন না। বদলি হওয়ার কারণে তার অতীতের সব অভিজ্ঞতা শূন্য হয়ে গেছে। অর্থাৎ বদলি হওয়া নতুন জায়গায় তিনি শূন্য থেকে চাকরি শুরু করছেন। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পদোন্নতির ক্ষেত্রে বদলির পরের অভিজ্ঞতাকে কাউন্ট করা হয় না।এটা খুবই হতাশাজনক। 

এ সমস্যায় পড়তে হয়েছে এমন অন্যান্য শিক্ষকরা বলছেন, এটা কোনো নিয়ম হতে পারে না। কোনো সরকারি চাকরিতে এমন নিয়ম নেই। প্রাথমিকে কেন এ আজব পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে। প্রাথমিকের কোনো একজন সহকারী শিক্ষক দীর্ঘদিন কোনো স্কুলে চাকরি করে অন্য স্কুলে যোগদান করলে তার অতীতের সকল অভিজ্ঞতা বাতিল! নতুন স্কুলে যোগদানের তারিখ থেকে তার জ্যেষ্ঠতার হিসাব শুরু হয়। 

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়া হয় স্থানীয়ভাবে। যেটা অন্য কোনো চাকরিতে নেই। নিয়োগে স্পষ্ট লেখা থাকে তিনি নিজ উপজেলার মধ্যে সারাজীবন চাকরি করবেন। তারপরও অনেকে বদলি হয়ে অন্যত্র চলে যান। সেই বদলি নীতিমালায় বলা থাকে, তিনি বদলি হলে আগের অভিজ্ঞতা আর গণ্য করা হবে না। এটা জেনেই তিনি বদলি হন।

জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিদ্যালয়) রতন চন্দ্র পন্ডিত ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতা অবদলিযোগ্য চাকরি। তারপরও যারা বদলি হন, অতীতের অভিজ্ঞতা গণ্য হবে না- এমন শর্ত মেনেই তারা বদলি হন। এখানে অভিযোগের কিছু নেই।

তিনি আরও বলেন, যে শিক্ষক এক উপজেলা থেকে অন্য উপজেলায় বদলি হয়ে যাচ্ছেন সেখানে বহিরাহত হিসেবে যাচ্ছেন। তার আগের কর্মস্থলের অভিজ্ঞতা হিসেবে নেওয়া হলে উপজেলার শিক্ষকরা পদোন্নতির ক্ষেত্রে বঞ্চিত হবেন। তাই বদলি হওয়ার শিক্ষকদের আগের অভিজ্ঞতা গণ্য করা হয় না। প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি না হওয়ার পক্ষে তার মত।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর সম্প্রতি সহকারী শিক্ষকদের প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি দিতে জ্যেষ্ঠতার তালিকা (গ্রেডেশন লিস্ট) চূড়ান্তকরণের কাজ হাতে নিয়েছে। এ কারণে গত জুন থেকে শিক্ষকদের অনলাইনে একটি ফরম পূরণ করতে হচ্ছে। সেখানে একটি প্রশ্ন রয়েছে- আপনি বহিরাগত শিক্ষক কি না? কবে এ উপজেলা/থানায় যোগ দিয়েছেন? প্রাথমিক শিক্ষকদের নিয়োগ করা হয় উপজেলাভিত্তিক। নিজ উপজেলার বাইরে অন্যত্র বদলি হয়ে গেলে নতুন কর্মস্থলে ওই শিক্ষককে ‘বহিরাগত শিক্ষক’ বলা হচ্ছে।

রতন চন্দ্র পন্ডিত আরও বলছেন, নিয়োগ বিধিমালায় বলা আছে তিনি তার নিজ উপজেলায় চাকরি করবেন। যেটা অন্য কোনো চাকরিতে বলা থাকে না। আর বদলি নীতিমালায় স্পষ্ট বলা আছে তিনি যেখানে যাবেন সেখানে তার আগের চাকরির অভিজ্ঞতা গণ্য হবে না।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর থেকে বলা হচ্ছে, নিয়োগটাই উপজেলাভিত্তিক। ‘বহিরাগত’ শিক্ষকদের কারণে স্থানীয় শিক্ষকরা জ্যেষ্ঠতা হারাচ্ছেন। স্থানীয়ভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত কেউ দীর্ঘদিন চাকরি করেও পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, যদি বাইরে থেকে কেউ বেশি দিনের চাকরিকাল নিয়ে আসেন। 

শিক্ষকদের গ্রেডেশন তালিকার নতুন সফটওয়্যারে বদলি হওয়া শিক্ষকদের ‘বহিরাগত’ হিসেবে দেখানো হচ্ছে এবং জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণে চাকরিতে যোগদানের তারিখের পরিবর্তে বর্তমান উপজেলায় বদলি হয়ে আসার তারিখ থেকে কার্যকাল ধরা হচ্ছে। এই বিধানকে বদলি হওয়া শিক্ষকরা অন্যায় ও অবিচার হিসেবে দেখছেন। 

ভুক্তভোগী শিক্ষকরা বলছেন, নিয়োগের সময় এই শর্ত থাকলে তারা সেভাবেই জানতেন এবং বদলি হতেন না। দেশের নাগরিকরা দেশের সব জায়গায় সমান অধিকার ও ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকারী। তবে বিশেষ চাকরিতে বিশেষ শর্ত আরোপ করলে তা নিয়োগের আগেই জানাতে হবে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি মোহাম্মদ শামছুদ্দীন মাসুদ বলেন, অনেক উপজেলায় বা মহানগরীতে স্থানীয় শিক্ষকরা দীর্ঘদিন চাকরি করেও পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এটা যেমন সত্য, তেমনি বহিরাগত শিক্ষকরাও কোনো শর্ত ছাড়াই বদলি হয়ে এসেছেন। কোথাও ১৫ বছর চাকরি করেই পদোন্নতি হয়, আবার কোথাও ৩০ বছরেও তা হয় না।

তিনি বলেন, এটার সমাধান হওয়া প্রয়োজন। আমরা চাই, উভয়ের স্বার্থ বিবেচনা করেই গ্রেডেশন তালিকা প্রণয়ন করা হোক।

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নিয়োগ বিধিমালা ২০১৯ -এ বলা হয়েছে, প্রধান শিক্ষকের ৬৫ শতাংশ পদ পদোন্নতির মাধ্যমে এবং ৩৫ শতাংশ পদ সরাসরি নিয়োগের মাধ্যমে পূরণ করা হবে। তবে, প্রধান শিক্ষক হিসেবে পদোন্নতিযোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে সরাসরি নিয়োগ দেওয়া যাবে। সহকারী শিক্ষক হিসেবে কমপক্ষে সাত বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা থাকলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে পদোন্নতি বিবেচনায় আসবে। আর সহকারী শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে সরাসরি।

এনএম/এনএফ