প্রাথমিকের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মাঝে বিস্কুট বিতরণ তথা ‘দারিদ্র্য-পীড়িত এলাকায় স্কুল ফিডিং প্রকল্পে’র মেয়াদ ছয় মাস বাড়লেও নতুন করে কার্যক্রম শুরু হয়নি। এরই মধ্যে বর্ধিত সময়ের তিন মাস অতিক্রম করলেও বৃহস্পতিবার (২ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত প্রকল্পের অর্থ ছাড় হয়নি। ফলে প্রাথমিকের ৩০ লাখ শিক্ষার্থী উচ্চপুষ্টিমানের বিস্কুট না পেয়ে অপুষ্টির শিকার হচ্ছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এসব শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ কর্মকর্তার কারণে প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হচ্ছে না। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ায় কার্যক্রম শুরু করতে সময় ক্ষেপণ করছেন। এমনকি মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবকে দিয়ে ফোন করে প্রকল্পে কর্মরত প্রশাসন ক্যাডারের দুই শীর্ষ কর্মকর্তাকে সরে যেতে বলেছেন।

জানা গেছে, গত ১৭ আগস্ট শর্তসাপেক্ষে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় পরিকল্পনা কমিশন। এর এক সপ্তাহ পর প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্তের কথা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরকে (ডিপিই) জানায় মন্ত্রণালয়। ওই চিঠি পেয়ে ডিপিই প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায়। কিন্তু মন্ত্রণালয় বুধবার (১ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ নেয়নি। 

মন্ত্রণালয় ও ডিপিই সূত্রে জানা গেছে, কোনো প্রকল্পের মেয়াদ বাড়াতে হলে প্রধানমন্ত্রীর সম্মতির জন্য ফাইল পাঠাতে হয় না। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব পাঠালে তা পর্যালোচনা করে অনুমোদন দেওয়া হয়। এর আগে ‘দারিদ্র্য পীড়িত এলাকায় স্কুল ফিডিং প্রকল্প’র মেয়াদ বাড়ানোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর মতামতের জন্য প্রস্তাব পাঠানো হয়নি। এবার প্রকল্পের মেয়াদ বাড়াতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্মতি চেয়ে প্রস্তাব পাঠায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।

গত ৭ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর সম্মতির বিষয়টি জানিয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। এরপর প্রকল্পের মেয়াদ বাড়াতে ডিপিইকে ফের প্রস্তাব পাঠাতে নির্দেশ দেয় মন্ত্রণালয়। এভাবে সময় নষ্ট করা হয়। 

গত ১ জুন একনেক সভায় প্রধানমন্ত্রী ‘প্রাইমারি স্কুল মিল প্রকল্প’ অনুমোদন না দিয়ে ডিপিপি সংশোধনের প্রস্তাব দেন। নতুন প্রকল্পের ডিপিপি সংশোধন করতে অন্তত এক বছর সময় লাগবে। এই সময়ে বিস্কুট বিতরণ প্রকল্পের সুবিধাভোগী ৩০ লাখ শিক্ষার্থী অপুষ্টি ও ঝরে পড়ার আশঙ্কা থেকে ডিপিই ব্যয় না বাড়িয়ে আরও এক বছর প্রকল্পের মেয়াদ বাড়াতে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠায়।

গত ১০ জুন প্রস্তাবটি পাঠানো হলেও মন্ত্রণালয়ের সচিব পরিকল্পনা কমিশনে না পাঠিয়ে সময়ক্ষেপণ করেন। এ নিয়ে একটি দৈনিক পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের পর প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন দ্রুত ব্যবস্থা নিতে সচিবকে নির্দেশ দেন। সচিব কৌশলে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর মতামতের জন্য ফাইল পাঠান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। একই সঙ্গে এক বছরের পরিবর্তে ছয় মাসের নতুন প্রস্তাব পাঠাতে বাধ্য করে ডিপিইকে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্পের মেয়াদ বাড়াতে হলে যৌক্তিকতা তুলে ধরে পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব পাঠাতে হয়। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ায়। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রস্তাব পাঠালে সেখানকার উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা সচিবের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

অভিযোগ রয়েছে বিকাশ, রকেটসহ এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের মোবাইলে সরাসরি টাকা পাঠাতে চেয়েছিলেন সচিব। অভিভাবকদের ফোনে সরাসরি টাকা পাঠালে শিশুদের পুষ্টির চাহিদা পূরণ হবে না। অভিভাবকরা নিজেদের প্রয়োজনে খরচ করে ফেলবেন। এর নেপথ্যে ছিল সচিবের কমিশন বাণিজ্যে! প্রতিমন্ত্রীর চাপে শেষ পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ ছয় মাস বাড়লেও সচিব এখন কার্যক্রম শুরু করতে টালবাহানা করছেন। ফলে ৩০ লাখ শিক্ষার্থী পুষ্টিকর বিস্কুট থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব গোলাম মো. হাসিবুল আলম বলেন, প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর অনুমোদন হলেও অর্থ মন্ত্রণালয় অর্থ ছাড় না করায় কার্যক্রম শুরু করা যাচ্ছে না। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় অর্থ ফ্রিজ হয়ে আছে। এটি ছাড় করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, দেশের দারিদ্র্য-পীড়িত ১০৪টি উপজেলায় ২০১০ সাল থেকে ৩০ লাখ শিক্ষার্থীকে প্রতিদিন ৭৫ গ্রামের এক প্যাকেট বিস্কুট বিতরণ করা হয়। বিস্কুট থেকে একজন শিক্ষার্থী প্রতিদিন ৩৩৮ কিলো ক্যালরি শক্তি পায়। প্রকল্পটি প্রথম দফায় ২০১০ সালের ১ জুলাই থেকে ২০১৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাস্তবায়ন করা হয়। পরবর্তী সময়ে প্রকল্প সংশোধন করে গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ১১৪২ কোটি ৭৯ লাখ ৯১ হাজার টাকা। এর মধ্যে জিওবি ৫৯৭ কোটি ৭০ লাখ ৫৭ হাজার টাকা আর প্রকল্প সাহায্য ৫৪৫ কোটি নয় লাখ ৩৪ হাজার টাকা।

এনএম/ওএফ/জেএস