আজম খান। ছবি: ইমতিয়াজ আলম বেগ

দশ বছর কেটে গেল আজম খান নেই। ২০১১ সালে আজকের (৫ জুন) দিনে জাগতিক মায়া কাটিয়ে পাড়ি দিয়েছিলেন না ফেরার দেশে। কিন্তু চলে যাওয়া মানেই তো আর হারিয়ে যাওয়া নয়। মুক্তিযুদ্ধ শেষ করে যেই মানুষটি বাংলাদেশের ব্যান্ডযাত্রার পথ দেখিয়েছেন, সেই কিংবদন্তির জায়গা সহস্র মানুষের হৃদয়ে। 

আজম খান গায়ক পরিচয়ের আগে একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ছিলেন ২ নাম্বার সেক্টরের ২১ বছর বয়সী সেকশন কমান্ডার ও গেরিলা দলনেতা। তার সেই সময়ের ঘটনা উঠে এসেছে সংগীশিল্পী মাকসুদুল হকের লেখায়। যেটি তার ‘বাংলাদেশের রকগাথা’ বইয়ে প্রকাশিত হয়। তারই এক অংশ নিচে দেওয়া হলো-

অগ্নিদীক্ষা: গেরিলা থেকে রক নায়ক

১৯৭১ এর জুন মাসের বৃষ্টিস্নাত এক রাত। মুক্তিবাহিনীর তিন দুর্ধর্ষ গেরিলা প্রায় এক ঘণ্টারও বেশি হলো হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে চলেছে। তাদের লক্ষ্য কুমিল্লার সালদাহে অবস্থিত পাকিস্তান আর্মির একটা সুসজ্জিত বাংকার। প্রথমে তারা গোপন ক্যাম্প থেকে বিরতিহীন পায়ে হেঁটেছে চার ঘণ্টা। রক্তচোষা জোঁক, মশা, পোকামাকড়, ঘন কাদা মাখা অবসন্ন দেহ তাদের অগ্রযাত্রাকে করে তুলেছে ধীর আর কষ্টসাধ্য। ব্যথার তীব্রতায় অসাড় হয়ে পড়েছে শরীর। চারদিকে গিজগিজ করছে বিষাক্ত সাপেরা।

সবচেয়ে খারাপ যে বিষয়টি তা হল, লক্ষ্য স্থির করার জন্য বহুদূর থেকে আসা কয়েকটি পেট্রোম্যাক্সের ক্ষীণ আলো (বাংলায় হ্যাজাগ বাত্তি) একমাত্র ভরসা। সেক্টর কমান্ডার ঠিকই বলেছিলেন, অ্যামবুস করার আগে শত্রুপক্ষের অবস্থান সম্বন্ধে নিশ্চিত না হয়ে এবং লাইন অব ফায়ারের কাছাকাছি না আসা পর্যন্ত এভাবেই হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।

দৃষ্টি বিভ্রমের কারণে দূরত্বও ঠাহর করে ওঠা যায় না ঠিকঠাক। যে কোনও সময় আকস্মিক কিছু ঘটে যাওয়ার সম্ভাবনাও নেহাত কম নয়। আর এভাবেই সেই তরুণ যোদ্ধাটির অগ্নিদীক্ষা হয়।

চমকটা ছিল গেরিলা দলটির ভাগ্যেই। নিজেদের সাজসরঞ্জাম গুছিয়ে নিতে না নিতেই হঠাৎ দলটি টের পেল যে নিজেদের লক্ষ্যস্থল থেকে মাত্র হাফ মিটারেরও কম দূরত্বে অবস্থান করছে তারা! সেখান থেকে শত্রুপক্ষের সেনাদেরকে তাদের বাংকারের উপর স্পষ্ট বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে, এমনকি সেখান তাদের নিচে প্রায় তিন মিটার পর্যন্ত জায়গাও পরিষ্কার দৃশ্যমান। ছয়জন দশাসই পাক সেনা একসাথে তারপোলিন ছাউনির নিচে রাতের খাবার খেতে বসেছে।

যুদ্ধের সময় অস্ত্র হাতে আজম খান

চারদিকে মুষলধারে বৃষ্টি। প্রহরায় প্রহরীও নেই কোনও। উত্তেজনায় দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করতে লাগল তিন গেরিলা। আরও নিশ্চিত হতে হবে। যুদ্ধ তখন সবেমাত্র শুরু হয়েছে ফলে অস্ত্রশস্ত্রও তেমন একটা নেই। এই স্পেশাল অপারেশন স্কোয়াডটির নেতৃত্বে যিনি, সেই সেকশন কমান্ডার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার পুরোনো একটা ৯ এমএম স্টেনগান অতিরিক্ত এক ম্যাগাজিন বুলেটসহ দুহাতে আঁকড়ে ধরে আছেন। অন্যদের কাছে অস্ত্র বলতে মাত্র একটা পিস্তল আর চারটা গ্রেনেড। এই নিয়ে তারা শত্রুপক্ষের অস্ত্রশস্ত্র দেখে তাজ্জব বনে গেল।

শিগগিরই তারা বুঝে গেল যে তাদের লক্ষ্যস্থল মোটেও মামুলি কোনও বাংকার নয় বরং একটি ভারী মেশিন গান ঘাঁটি। কাজেই তাদেরকে ধরাশায়ী করতে হলে কোনওরকম ভুল করা চলবে না। সবকিছু ভেবেচিন্তে দলনায়ক তার কমরেডদের ইশারায় জানালেন যে তিনি গুলি করা আরম্ভ না করা পর্যন্ত যেন তারা চুপচাপ শুয়ে থাকে। এর ঠিক পরপরই তিনি শোয়া অবস্থা থেকে হামাগুড়ি দিয়ে পুরোপুরি সোজা হয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে নিজের অস্ত্রটাকে প্রস্তুত করে নিলেন। একবার তাকালেই  শত্রুপক্ষ দেখে ফেলবে তাকে কিন্তু ভাগ্য ভালো যে তারা খোশগল্পে মশগুল।

বাতাসে ভাসছে ভাত, ডাল, মাংস, সালাদ আর সবজির ঘ্রাণ। গেরিলাদের পেটটা মুচড়ে উঠলো ক্ষুধায়। যুদ্ধ শুরুর পর কতদিন যে পেট পুরে খাওয়া হয়নি তার হিসেব নেই। ক্ষুধা তাদের মনঃসংযোগে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিল বারবার। আক্রমণ শুরুর ঠিক আগ দিয়ে দলনেতাটির মনটা তার কাজের জন্য ভরে উঠল অনুশোচনায়, মায়ায়। কারণ আর যাই হোক পাকিস্তানী সেই সেনাদের জন্য সেটাই হতে চলেছিল জীবনের শেষ আহার। তাই তিনি শত্রুদের কয়েক গ্রাস খাবারের স্বাদ নিতে দিলেন। তার এই অনাকাঙ্ক্ষিত বিলম্ব দলের বাকি সদস্যদের দুঃশ্চিন্তা ক্রমেই বাড়িয়ে দিচ্ছিল।

আর ঠিক তখনই দলনেতাটি ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তায় শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত হলেন। কিন্তু এর আগ মুহূর্তেই তার বাঁকা বিদ্রূপে ভরা রসিক মনে খেলে গেলো একটা অদ্ভুত চিন্তা, ‘মৃত্যুর আগে বিদায় সম্ভাষণ হিসাবে তাদেরকে এমন কোনও ভাষায় একটা গান শোনালে কেমন হয় যা তারা বুঝতে পারবে?' তো এই ভেবে তিনি ষাটের দশকের পূর্ব পাকিস্তান, ভারত দুই দেশেই খুব জনপ্রিয় একটা সিনেমার গান গাইবেন বলে মনস্থির করলেন।

তীক্ষ্ণ কর্কশ গলায় ‘এইসা মওকা ফির কাঁহা মিলেগা ( এমন মওকা আর কোথায় পাবো)’ গানটি গাইতে গাইতে গুলি করতে শুরু করে দিলেন। প্রথম ম্যাগাজিন খালি হয়ে গেল চোখের নিমেষেই। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কাতরাতে লাগলো পাক সেনারা। কোনও সুযোগই পেল না তারা। কফিনে শেষ পেরেক ঠুকতে আটাশটি বুলেটের দ্বিতীয় ম্যাগাজিনটিও ব্রাশ ফায়ার করা হল দ্রুত।

পাঁচ মিনিটেই কেল্লা ফতে। নিজেদের ঘাঁটিতে ফেরার সময় সাফল্যের ঝুলিতে তখন ছয় পাকসেনা, প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র আর শত্রুপক্ষের একটি বিধ্বস্ত বাংকার।

২ নাম্বার সেক্টরের সে ২১ বছর বয়সী সেকশন কমান্ডার ও গেরিলা দলনেতাটি আর কেউ নন ছিলেন আজম খান ওরফে মাহবুবুল হক খান যিনি ২০১১ সালের ৫ জুন রবিবারে ৬১ বছর বয়সে ঢাকায় মৃত্যু বরণ করেন।  

এমআরএম