আজাদ সিনেমা হলের সামনে রঙিন পোস্টার ভেতরে অনুজ্জ্বল প্রদর্শন

পুরান ঢাকার রায়সাহেব বাজার মোড় বা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে থেকে জনসন রোড ধরে সামনে এগোলেই জজ কোর্টের বিপরীত দিকে দেখা মিলবে প্রায় ৯০ বছরের পুরোনো আজাদ সিনেমা হল।

চোখ পড়তেই হলের বয়সী দেয়ালগুলো মনে করিয়ে দেবে সাদাকালো সিনেমার দিনগুলো। তবে ঝুলানো ও সাঁটানো নতুন সিনেমার পোস্টার বাংলা চলচ্চিত্রের যে অধঃপতন হয়েছে, সে ইঙ্গিতটা আরও স্পষ্ট করিয়ে দেবে। দেশের অন্যান্য হলের মতো মানসম্পন্ন সিনেমার অভাবে এটিতেও রুচিশীল দর্শকের সংখ্যা কমছে প্রতিনিয়ত। হলের বাইরের দেয়ালে অশ্লীল পোস্টার থাকলেও দর্শক নেই ভেতরে।

জানা যায়, ১৯২৯ সালে ঢাকায় নির্মিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ নির্বাক চলচ্চিত্র ‘দ্য লাস্ট কিস’ চলচ্চিত্রটি এ প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। ওই সিনেমা দিয়েই হলটির যাত্রা শুরু। শুরুতে এটির নাম ছিল মুকুল হল। প্রতিষ্ঠার সময় এটির মালিক ছিলেন নর্থব্রুক হল রোড়ের জমিদার বাড়ির মালিক মুকুল বাবু। বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশ কিংবা ষাটের দশকে নাম পরিবর্তন হয়ে এটি আজাদ সিনেমা হলে রূপান্তরিত হয়।

এই হলটিই একসময় ঢাকার অভিজাত পরিবারের সদস্যদের বিনোদনের মূল কেন্দ্র ছিল। লেখক, চিত্রশিল্পী, চলচ্চিত্রের শিল্পী-কলাকুশলীদের পদভারে মুখরিত থাকত আজাদ সিনেমা হল। ঘোড়ার গাড়ি, রিকশায় চড়ে দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসতেন। ইংলিশ, উর্দু, হিন্দি, বাংলা ছবিতে বিশ্বকে দেখতেন তারা।

সরেজমিনে দেখা যায়, হল পরিচালনায় ৭-১০ জন শ্রমিক কাজ করছেন। হলের মালিকানায় রয়েছে ঢাকা পিকচার্স প্যালেস। তারা পারিবারিকভাবে হলের মালিক। দিনে তিনবার সিনেমা প্রদর্শন হয় এখানে। সকাল, বিকেল এবং সন্ধ্যার পর। বৃষ্টির দিনে ছাদ দিয়ে হলের ভেতরে ঢোকে পানি। হলের বিদ্যুৎ, মেশিন ও পানির বিলসহ হল পরিচালনার অর্থ জোগাতে ভেতরে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখানে জজ কোর্টের ব্যক্তিগত গাড়ি ছাড়াও বিভিন্ন ভ্যান রাখা হয়। জরাজীর্ণ অবস্থা হলের দেয়ালগুলোর। যেকোনো সময় দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে।

সিনেমা হলে প্রবেশের টিকিট
আমাদের সিনেমা উৎপাদনের মূলকেন্দ্র এফডিসি। আশির দশকের পর থেকে ঢাকাইয়া চলচ্চিত্র বা এফডিসিতে সবচেয়ে বড় সংকট হলো- নান্দনিক, মেধাবী, শৈল্পিক মানুষদের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমেছে। বর্তমানে এখন তা প্রায়ই মেধাশূন্য হয়ে আছে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জুনায়েদ আহমদ হালিম

হলের স্টল স্পেশাল টিকিটের দাম ২৪ টাকা। সেখানে প্রবেশ মূল্য হিসেবে ১১.৭০ টাকা, পৌর কর ১.১৮, সম্পূরক কর ৫.১৪, মূল্য সংযোজন কর ২. ৯৮ টাকা এবং অন্যান্য চার্জ হিসেবে তিন টাকা নেওয়া হয়। হলে আসা দর্শকদের জন্য দুই তলা বিশিষ্ট চেয়ার রয়েছে। একটা হলো নিচ তলা যেখানে বসার জন্য ৩৫ টাকা দিতে হয়। অপরটি হলো উপর তলা এর মূল্য ৪৫ টাকা। মানসম্মত সিনেমার অভাবে হলটিতে দর্শকের ভিড় দেখা ভার। তবে হলের সামনে ‘আকর্ষণীয় পোস্টার’ সাঁটানো হলে অনেকেই সেটির দিকে চেয়ে থাকেন। সাধারণত ৭-১০ জনের বেশি দর্শক এক সময়ে হয় না হলটিতে।

অভিযোগ আছে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা টাকা না দিয়ে হলে প্রবেশ করেন। বাধা দিলে দায়িত্বরতদের মারধর করেন। তবে সম্প্রতি তারা আসেন না।

বাংলাদেশে সিনেমা হলের অবস্থা ভালো নয়। এখন কোনো সিনেমাই নেই, তৈরি হয় না। বাংলাদেশ রুচিশীল সিনেমা তৈরি হয় না। মালিক হলের কার্যক্রম দেখতে সচরাচর আসেন না। হল চালাতে আমাদেরকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। মালিক সিনেমা হল ভেঙে মার্কেট করবেও বলছিলেন।

হলটির বর্তমান অবস্থা নিয়ে ম্যানেজার পরিতোষ রায়

আজাদ সিনেমা হলের ভঙ্গুর প্রোজেকটর

সিনেমার অশ্লীল পোস্টারের বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘এগুলো আকর্ষণের জন্যে করা হয়। সিনেমার মধ্যে অশ্লীল কোনো দৃশ্য নেই।’

এ প্রসঙ্গে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জুনায়েদ আহমদ হালিম বলেন, ‘সিনেমার করুণ পরিস্থিতি একদিনে তৈরি হয়নি। ফিল্ম ডেভলপমেন্ট করপোরেশন (এফডিসি) ভিত্তিক সিনেমা নির্মাণের মান কমে যাচ্ছে। অর্থাৎ দর্শক আকর্ষণের ধারণা থেকে সিনেমায় যৌনতা, অতি নাটকীয়তা, অবাস্তব কাহিনী বা গল্পহীন, অতিরিক্ত ভায়োলেন্স ইত্যাদি দিয়ে সিনেমাগুলো পরিপূর্ণ হয়েছে। যার ফলে হলে সিনেমা দেখতে দর্শক হিসেবে যারা যান তারা নিম্ন শ্রমজীবী শ্রেণি বা রিকশাওয়ালা। নাগরিক অবস্থান থেকে তাদের খাটো করতে চাই না। কিন্তু তারা বোধশক্তির জায়গায় নিম্ন। 

তিনি বলেন, ‘রিকশাওয়ালারা যে ছবি পছন্দ করে সেরকম ছবি ঢাকাইয়া চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে তৈরি হচ্ছে। নব্বইয়ের দশকের পর থেকে ঢাকাইয়া সিনেমা জগতে শৈল্পিক মানুষদের সংখ্যা কমে গেছে। দুই হাজার সালের পর থেকে ঢাকাইয়া চলচ্চিত্রের খুবই খারাপ অবস্থা। ঢাকাইয়া সিনেমা কতিপয় মানুষের কাছে কুক্ষিগত হয়ে আছে অর্থ লোভে। যার ফলে সিনেমার বিকাশটা কমে গেছে। আমাদের সিনেমা উৎপাদনের মূলকেন্দ্র এফডিসি। আশির দশকের পর থেকে ঢাকাইয়া চলচ্চিত্র বা এফডিসিতে সবচেয়ে বড় সংকট হলো- নান্দনিক, মেধাবী, শৈল্পিক মানুষদের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমেছে। বর্তমানে এখন তা প্রায়ই মেধাশূন্য হয়ে আছে। সত্তর বা আশির দশকের দিকেও সিনেমায় পারিবারিক, সামাজিক, একটু মিষ্টি গান এগুলো ছিল। হল মালিক লোকসান দিয়ে দিয়ে হল কতদিন চালাবে? এই কারণে অধিকাংশ হল এখন বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক প্রযোজক এখন সিনেমা অঙ্গন ছেড়ে দিয়েছে। গত ৮-১০ বছরে সিনেমার কারিগরি সিস্টেম বা টেকনোলজি প্রক্রিয়াটা বদলে গেছে। আশির দশকের পর বছরে ২০০-২৫০ সিনেমা নির্মাণ হতো ও মুক্তি পেতো। এখন বছরে সিনেমা নির্মাণ হয় ও মুক্তি পায় ২০-২৫ টি। এখনকার সিনেমার মানগুলোও খুব নিম্নমানের আগের সিনেমার তুলনায়।’

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত এই শিল্পী আরও বলেন, ‘স্বাধীনতার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়েও আমাদের দেশীয় সিনেমার সুনাম ছিল। নতুন প্রজন্ম প্রযুক্তি বোধসম্পন্ন, তরুণরা সিনেমার দিকে ঝুঁকছে। তবে আমি আশাবাদী, বাংলাদেশে চলচ্চিত্র নিয়ে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা হচ্ছে ও পড়াশোনা জন্য পরিবেশও তৈরি হচ্ছে। প্রজন্মের পরিবর্তন হচ্ছে, ধীরে ধীরে আমাদের সিনেমারও মানসম্পন্ন বিকাশ ঘটবে। আমাদের সিনেমার মানও পরিবর্তন হবে, তবে সময় লাগবে।’

মাহমুদ তানজীদ/এফআর