মোটের ওপর ব্যান্ডটির প্রকাশিত গানের সংখ্যা ২১। খুব বেশি হয়ত নয়। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো, প্রায় সবগুলো গানই ভক্তদের ঠোঁটে বাজে। হৃদয়ের আঙিনায় ঘুরে বেড়ায়। ব্যান্ডটি যখন কনসার্টে পারফর্ম করে, তখন তাদের চেয়ে অধিক আগ্রহে গাইতে থাকেন শ্রোতারা। আবার ইউটিউবে যখন গান প্রকাশিত হয়, তখন মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউ হয়ে যায় অবলীলায়।

বলছি ‘অ্যাশেজ’ ব্যান্ডের কথা। এই ব্যান্ডের প্রাণভোমরা জুনায়েদ ইভান। তার সঙ্গেই মুঠোফোনে জমেছিল দারুণ আলাপ। সে আলাপের প্রথম পর্ব ইতোপূর্বে প্রকাশিত হয়েছে। আজ রইল দ্বিতীয় পর্ব…

জুনায়েদ ইভানের গানের চর্চা স্কুল জীবন থেকেই। তবে অফিসিয়ালি ব্যান্ড অর্থাৎ ‘অ্যাশেজ’ গঠন করেছেন ২০০৮ সালে। অবশ্য তারও বহু আগে থেকে জ্যামিং করতেন। তখন তার সঙ্গে ছিলেন ছোটবেলার বন্ধু রাফসান ও বিজয়। এখনো তারা একসঙ্গেই ব্যান্ডটি পরিচালনা করছেন।

জানতে চাইলাম ঠিক কোন অনুপ্রেরণায় ব্যান্ড মিউজিকে আসা? জুনায়েদ ইভান বললেন, ‘নির্দিষ্ট কাউকে দেখে কিংবা কারো গান শুনে ব্যান্ড গঠন করেছি, এমন নয়। গান তো অনেকেরই শুনতাম। আবার আমিও স্কুল জীবনেই গানের চর্চা শুরু করেছি। নিজের মতো করে গান বাঁধতাম, গাইতাম। তো একটা পর্যায়ে এসে মনে হলো, গানগুলো মানুষকে শোনানো যায়। এটা থেকেই ব্যান্ড গঠন করা। ২০০৮ সালে আমরা ব্যান্ড গঠন করি। তবে সিরিয়াসলি কাজ শুরু করি এর পরের বছর। ২০১০ সালে একটি মিক্সড অ্যালবামে আমাদের প্রথম গান প্রকাশিত হয়।’

অ্যাশেজ ব্যান্ডের সদস্যরা

২০১৪ সালে ‘অ্যাশেজ’-এর প্রথম একক অ্যালবাম ‘ছারপোকা’ বাজারে আসে। যেটার অধিকাংশ গানই পায় শ্রোতাপ্রিয়তা। এছাড়া কিছু অনালাইনে কয়েকটি সিঙ্গেলসও প্রকাশ করে ব্যান্ডটি। এখন এক এক করে প্রকাশ্যে আসছে তাদের দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘অন্তঃসার শূন্য’-এর গানগুলো। গত ১১ নভেম্বর প্রকাশিত হয়েছে এর চতুর্থ গান ‘আমি বদলে যাব’।

কেবল অর্থ কিংবা গানের জন্য গান নয়, জুনায়েদ ইভান ও ‘অ্যাশেজ’ গান করে মানুষের জন্য। এ পর্যন্ত তারা প্রায় ১০০টি চ্যারিটি কনসার্ট করেছেন। এর মধ্যে বহু কনসার্ট ইভান নিজেই অ্যারেঞ্জ করেছেন। তার ভাষ্য, ‘এমন অনেক হয়েছে, কেউ আমাকে জানানোর পর আমি নিজেই কনসার্টের ব্যবস্থা করেছি, পুলিশের অনুমতি, মাঠ বা ভেন্যু ঠিক করেছি, পোস্টার, টিকেট এসবের বন্দোবস্ত করেছি। একেকটা কনসার্ট শেষে আমরা মানুষের হাতে ৮-১০ লাখ টাকা তুলে দিয়েছি। তবে সেই টাকা আবার আমরা নিজের কাছে নেই না। আমরা একটা মাধ্যম হিসেবে কাজ করি। রোগীদের পরিবার বা কোনো আত্মীয়ের নম্বর, অ্যাকাউন্ট দিয়ে দেই। শ্রোতা-দর্শকরা সেখানেই যাচাই-বাছাইয়ের পর সহযোগিতা করেন।’

শিল্পীসত্তা ও মানবিক দায়বদ্ধতা থেকেই এমন কাজ করে আসছেন জুনায়েদ ইভান। তিনি বলেন, ‘আমি তো অনেক ক্ষমতাবান কিংবা শিল্পপতি নই। আমি কেবল গান গাইতে পারি। এর মাধ্যমে যদি একটা মানুষের উপকার করতে পারি, কিছু মানুষ জড়ো করে যদি কাউকে সহযোগিতা করতে পারি, সেটা তো আমার জন্য আশীর্বাদ। এসব ঘটনার অনেক অদ্ভুত ও সুন্দর গল্প আছে। যেমন, কারো কিডনির চিকিৎসার জন্য আমরা সহযোগিতা করেছি। তার কিডনি ট্র্যান্সপ্ল্যান্ট হয়েছে, তিনি সুস্থ হয়েছেন, বিয়ে করেছেন, এরপরে আমাদের ফোন করে আনন্দের সঙ্গে বিয়ের খবর জানিয়েছেন। এসব গল্পই আমাদের শক্তি। এই মানুষগুলোর একটু হাসি, আনন্দ আমাদের সমস্ত পরিশ্রমকে সার্থক করে দেয়।’

মন্ত্রমুগ্ধের মতো জুনায়েদ ইভানের গল্পগুলো শুনছিলাম। তখন মাথায় উঁকি দিল, যিনি এত সুন্দর চিন্তা-ভাবনা করেন, তার স্বপ্নটা আসলে কেমন? কৌতূহল পুষে না রেখে জানতে চাইলাম। জবাবে তিনি বললেন, ‘অন্যদের মতো সফল হওয়ার কোনো স্বপ্ন নেই আমার। ছোট একটি স্বপ্ন আছে- আমি একটা পাহাড় কিনতে চাই। সেখানে কাঁচের দেয়ালে ঘেরা একটা ঘর বানাতে চাই। সেটার ভেতরে আমি স্টুডিও বানাব। ওই স্টুডিওতে সারারাত গান করব। কাঁচের দেয়াল হবে, যাতে গান করার সময় বাইরের শব্দ না আসে এবং রাতের পাহাড়ি সৌন্দর্যটা দেখা যায়।’

কথায় কথায় সামনে এলো জুনায়েদ ইভানের আরও একটি ভাবনা। তিনি হারিয়ে যাওয়া মানুষকে নিয়ে কাজ করতে চান। তার ভাষ্য, ‘রাস্তাঘাটে, এদিকে-সেদিকে অনেক অজ্ঞাতনামা মানুষ দেখি আমরা। যারা কোনো কারণে ঘরছাড়া হয়েছেন। দেখা যায়, কেউ হারিয়ে যাওয়ার অনেক বছর পর তার পরিবার যদি খুঁজেও পায়, স্বীকার করে না। তাকে ফিরিয়ে নিতে চায় না। এই নির্মম সত্যগুলো আমরা জানি না। তাদের জন্য কিছু করতে চাই।’

জুনায়েদ ইভান তার নিখাদ সুন্দর ভাবনাগুলো যেমন গানের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন, একইভাবে সেগুলো বিস্তার লাভ করে অসহায় মানুষকে সহযোগিতার মাধ্যমে। তার এই অন্তবিহীন পথচলা অবিরাম থাকুক, সবুজে মোড়ানো কোনো পাহাড় আলগোছে ধরা দিক তার কাছে, এটাই প্রত্যাশা।

কেআই/আরআইজে