১৯২২ সালের ১১ ডিসেম্বর পাকিস্তানের খাইবারে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তার জন্ম। বাবা-মা নাম রেখেছিলেন মোহাম্মদ ইউসুফ খান। কিন্তু এই নামে তাকে খুব কম মানুষই চেনেন। তিনি পরিচিত দিলীপ কুমার নামে। দ্য ট্র্যাজেডি কিং নামে।

মুসলিম পরিবারের ইউসুফ খান কীভাবে হয়ে উঠলেন দিলীপ কুমার, কীভাবে তার নামের পাশে যুক্ত হলো ‘দ্য ট্র্যাজেডি কিং’; সেই ইতিহাসটা চলুন জেনে নেওয়া যাক।

দিলীপ কুমারের বাবা ছিলেন একজন ফল বিক্রেতা। অধিকাংশ মুসলিম পরিবারের মতো তাদের পরিবারও ছিল বেশ রক্ষণশীল। ছেলে নায়ক হবে, সিনেমা করবে, এমনটা তার বাবা-মা ভাবতেও পারেননি। সে কারণে একেবারে গোপনেই সিনেমায় যুক্ত হয়েছিলেন দিলীপ কুমার।

১৯৩০ সালের শেষ দিকে পরিবারের সঙ্গে ভারতের মুম্বাইতে চলে আসেন দিলীপ কুমার। আরও বছর দশেক পর মুম্বাই থেকে পুনে’তে যান তিনি। সেখানকার একটি ক্যান্টিনে চাকরি দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেন দিলীপ। ওই সময়ে তাদের পরিবারে আর্থিক সংকট দেখা দেয়। সেজন্য পরিবারে অর্থের যোগান দিতে তিনি বেশি বেতনের চাকরি খুঁজছিলেন। তখন এক পারিবারিক বন্ধুর পরামর্শে অভিনেত্রী দেবিকা রাণীর ‘বোম্বে টকিজ’-এ চাকরি পান।

দিলীপ কুমার উর্দু ভাষায় দারুণ দক্ষ ছিলেন। এছাড়া তার মেধাও ছিলো অসাধারণ। সেই সুবাদে ‘বোম্বে টকিজ’-এর বিভিন্ন সিনেমার চিত্রনাট্য তৈরির কাজও করতেন তিনি। ওই সময়টাতে অভিনেতা অশোক কুমারের সঙ্গে তার পরিচয় হয় এবং তার দ্বারা তিনি অনুপ্রাণিত হন।

সুদর্শন চেহারা এবং প্রতিভাবান হওয়ায় দিলীপ কুমারকে সিনেমায় অভিনয়ের প্রস্তাব দেন দেবিকা রাণী। সেটা ১৯৪৪ সালের ঘটনা। তখনো তার নাম ছিল ইউসুফ খান। দেবিকা রাণী জানান, সিনেমায় অভিনয়ের জন্য এই নাম মানানসই নয়। নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য অন্য নাম লাগবে। ওই সময়ে বোম্বে টকিজে কাজ করতেন হিন্দি কবি নরেন্দ্র শর্মা। তিনি ইউসুফ খানের পরিবর্তে তিনটি নাম প্রস্তাব করেন। এগুলো হলো- জাহাঙ্গীর, ভাসুদেব এবং দিলীপ কুমার। ইউসুফ তৃতীয় নামটি বেছে নেন।

১৯৪৪ সালে মুক্তি পায় দিলীপ কুমার অভিনীত প্রথম সিনেমা ‘জোয়ার ভাটা’। কিন্তু সিনেমাটি সাফল্য পায়নি এবং দিলীপ কুমারও কারো নজরে আসেননি। এরপর আরও কয়েকটি সিনেমায় কাজ করলেও কাঙ্খিত সাফল্য ধরা দিচ্ছিল না।

অবশেষে ১৯৪৭ সালে সাফল্যের দেখা পান দিলীপ কুমার। সিনেমাটির নাম ছিল ‘জুগনু’। এতে তার নায়িকা হয়েছিলেন নূর জাহান। এই সিনেমার পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি দিলীপ কুমারকে। নানামাত্রিক চরিত্রে অভিনয় করে নিজেকে অসামান্য উচ্চতায় নিয়ে যান তিনি।

দিলীপ কুমার অভিনীত উল্লেখযোগ্য কয়েকটি সিনেমা হলো-‘জোগান’, ‘বাবুল’, ‘হুলচুল’, ‘দিদার’, ‘তারানা’, ‘দাগ’, ‘অমর’, ‘দেবদাস’, ‘নায়া দউর’, ‘পয়গাম’, ‘মধুমতি’, ‘ইনসানিয়াত’, ‘মুঘল-এ-আজম’, ‘সওদাগর’, ‘কারমা’, ‘গঙ্গা যমুনা’, ‘দুনিয়া’, ‘বৈরাগ’, ‘আদমি’ ইত্যাদি।

সমসাময়িক নায়কদের চেয়ে দিলীপ কুমার ব্যতিক্রম ছিলেন অভিনয়ে। এছাড়া তার বিভিন্ন ধরণের চরিত্রে অভিনয়ের দিকটাও ছিল অনন্য। সে কারণে তিনি পুরস্কারেও ছিলেন এগিয়ে। এক এক করে তার ঝুলিতে চলে আসে আটটি ‘ফিল্মফেয়ার’ পুরস্কার। ২০০০ সালের আগ পর্যন্ত তিনিই ছিলেন সবচেয়ে বেশি ফিল্মফেয়ার পাওয়া অভিনেতা।

দিলীপ কুমার ভারতের রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘পদ্ম ভূষণ’ এবং ‘পদ্ম বিভূষণ’ পদকেও ভূষিত হয়েছেন। এছাড়া ভারতীয় চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ সম্মাননা দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারও পেয়েছেন খ্যাতিমান এই তারকা।

বেশ কিছু সিনেমায় ব্যর্থ প্রেমিকের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন দিলীপ কুমার। সেসব চরিত্রে তিনি এতোটাই নিখুঁত অভিনয় করেন যে, বাস্তব জীবনেই তিনি ‘ট্র্যাজেডি কিং’ হিসেবে পরিচিত পেয়ে যান। আবার ব্যক্তিগত জীবনের কিছু অসম্পূর্ণ প্রেমের ঘটনাও তাকে বিরহ সম্রাটের খ্যাতি পেতে সাহায্য করেছে। এই ফাঁকে বলা প্রয়োজন, অনেকগুলো সিনেমার শেষ দিকে দিলীপ কুমারকে মৃত্যুবরণ করতে দেখা গেছে। সেসব চরিত্রে অভিনয় করতে করতে তিনি সত্যিকার অর্থেই হতাশাগ্রস্ত হয়ে যেতেন। এজন্য চিকিৎসকরা তাকে ট্র্যাজেডি বাদ দিয়ে কিছু কমেডি সিনেমা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন।

দিলীপ কুমারের মৃত্যুর মাধ্যমে বলিউডের সবচেয়ে উজ্জ্বল একটি তারকার পতন হলো। কিন্তু চলে গিয়েও দিলীপ কুমার থেকে যাবেন বলিউডের ইতিহাসের পাতায়। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম তাকে দেখে শিখবে অভিনয়ের সংজ্ঞা, আর দর্শকরা তাকে রেখে দেবে রূপালি অনুভবের গভীরে।

কেআই/আরআইজে