ভিনি, ভিডি, ভিসি-এলাম, দেখলাম, জয় করলাম! বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একজনের নামের পাশেই খাটে বিখ্যাত এ উক্তিটি। তিনি হচ্ছেন চিত্রনায়ক সালমান শাহ। মাত্র ২২ বছর বয়সে ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ দিয়ে জয় করে নিয়েছিলেন বাংলাদেশের লাখো তরুণ-তরুণীর হৃদয়। বলা যায় রাতারাতি বদলে দিয়েছিলেন দেশীয় চলচ্চিত্রে নায়কের সংজ্ঞা। তৈরি করেছিলেন নিজস্ব স্টাইল, ফ্যাশন ও ক্রেজ। সাবলীল অভিনয় গুণে হয়েছিলেন দেশের এক নম্বর নায়ক। মাত্র সাড়ে তিন বছরের ক্যারিয়ারে ২৭টি সিনেমার মাধ্যমে এ দেশের চলচ্চিত্রকে সালমান এমন কিছু দিয়ে গিয়েছেন, যা এখনও সবার কাছে বিস্ময়।

১৯৭১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর যখন সিলেটের ২১/এ মেঘনা, দাড়িয়া পাড়াস্থ নানাবাড়ি ‘আব এ হায়াত’ ভবনে (এখন যা ‘সালমান শাহ ভবন’ নামে পরিচিত) তিনি জন্ম নেন, তখন হয়ত কেউ কল্পনাও করতে পারেনি এ ছেলে একদিন দেশীয় চলচ্চিত্রের বরপুত্র হবেন। পাবেন ‘রাজপুত্র’-এর খেতাব।

একজন পারফেক্ট নায়কের কী কী গুণ লাগে? চেহারা, ফ্যাশন, স্টাইল, অভিনয় এবং নিজস্ব কিছু প্রকাশ ভঙ্গি—যার সবই ছিল সালমান শাহর। কখনও বড় লোক বাবার আদরের ছেলে, কখনও গ্রামীণ যুবকের চরিত্র—সব জায়াগায় মানিয়ে গিয়েছেন। ‘অতি অভিনয়’ বলে কোন শব্দ হয়ত তার ডিকশনারিতে ছিল না। 

বাবা কমর উদ্দিন চৌধুরী ও মা নীলা চৌধুরীর বড় আদরের সন্তান ছিলেন সালমান। যার আসল নাম ছিল সি এম শাহরিয়ার ইমন। ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন ১৯৮৫ সালে বিটিভিতে শিশুশিল্পী হিসেবে। ১৯৮৬ সালে ছায়ানট থেকে পল্লীগীতিতে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন সালমান। বিটিভির বিখ্যাত ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদি-তে ‘নামটি ছিল তার অপূর্ব’ শিরোনামে মাদকবিরোধী একটি গানের মডেলও হয়েছিলেন তিনি। এতে তার সঙ্গে তার মা নীলা চৌধুরীও অভিনয় করেছিলেন।

পরিচালক সোহানুর রহমান সোহান একজন নতুন নায়ক খুঁজছিলেন। তাকে তখন চিত্রনায়ক আলমগীরের তৎকালীন স্ত্রী খোশনূর আলমগীর সালমান শাহর কথা বলেন। তখন আনন্দমেলা লিমিটেড থেকে হিন্দি ‘সানাম বেওয়াফা’, ‘দিল’ ও ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’ কপিরাইট আনা হয়েছিল। একটি রেস্টুরেন্টে বসে সোহানুর রহমান সোহান সালমানকে ‘সানাম বেওয়াফা’ সিনেমায় অভিনয়ের প্রস্তাব দেন। কিন্তু সালমান ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’-এর জন্য বলেন। কারণ সিনেমাটি তার অনেক প্রিয় এবং ২৬ বার দেখা। 

সালমানের ক্যারিয়ারে ২৭টি সিনেমার মধ্যে ১৪টি করেছেন শাবনূরের সঙ্গে। মৌসুমীর সঙ্গে ৪টি, শাবনাজের সঙ্গে ২টি এবং বাকিগুলো অন্যান্যদের সঙ্গে। সালমান শাহ অভিনীত ২৭টি সিনেমার মধ্যে ৮টি তার মৃত্যুর পর মুক্তি পায়। অল্প দিনের ক্যারিয়ারে সালমান নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন দেশের সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক প্রাপ্ত ও ব্যাপক দর্শকপ্রিয় নায়কের কাতারে। নব্বই দশকের যে সময়ে সালমান ১০ লাখ টাকা করে পারিশ্রমিক নিয়েছেন, ওই সময়ের জন্য তা ছিল রীতিমত ঈর্ষণীয়। 

১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর তার রহস্যজনক অকাল মৃত্যুর পর সারাদেশে ১০-১২ জন্য ভক্ত আত্মহত্যা করেছিল, যা কিনা পৃথিবীর ইতিহাসেই বিরল। মৃত্যুর তিন দশক পার হতে চলেছে; এখনও মানুষ তাকে ভালোবাসে। তার পরা ক্যাপ, জামা, সানগ্লাস, জুতা ও তার নানা স্টাইল এখনও অনেকে অনুকরণ করেন। গাজীপুরের সুরাবাড়ি এলাকায় তার নামে একটি স্টেশনের নামকরণ করা হয়েছে। এমনকি ‘স্বপ্নের ঠিকানা’ নামের একটি রিসোর্টে সালমান শাহের ভাস্কর্যও নির্মাণ করেছেন তার ভক্তরা। আর এই অনলাইন যুগে সামাজিক যোগাযোগের নানা মাধ্যমগুলোতেও তাকে ঘিরে ভক্তদের নানা উন্মাদনা দেখা যায়। আজও লাখো ভক্ত তার জন্য কান্না করেন, দোয়া করেন। সালমান শাহ বেঁচে থাকবেন লাখো ভক্তের হৃদয়ে যুগ যুগ ধরে।

লেখক: সালমান শাহর ভক্ত এবং সালমান শাহ স্মৃতি সংসদ ও টিম সালমান শাহর প্রতিষ্ঠাতা