ছবি : সংগৃহীত

পঞ্চাশের দশক। জেমস বায়রন ডিন নামের একজন সুদর্শন আমেরিকান অভিনেতা ছিলেন। প্রচণ্ড জনপ্রিয়। রেবেল উইদাউট অ্যা কজ [Rebel Without a Cause] (১৯৯৫) নামের সিনেমার জন্য এখনো তিনি চিরস্মরণীয়।

তবে যে ব্যাপারটার জন্য মানুষ এখনো তাকে ভুলতে পারে না, সেটি হচ্ছে মাত্র ২৪ বছর বয়সে সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান। এরকম তাজা একটি প্রাণ এভাবে ঝরে যাবে, তা হয়তো কেউ কল্পনাও করেনি। মরণোত্তর অস্কার পাওয়া প্রথম অভিনেতা হলেন এই জেমস বায়রন ডিন।

সালমান শাহ’কে নিয়ে বলতে গিয়ে জেমস বায়রন ডিনের প্রসঙ্গ কেন জানি চলেই আসে। দুইজনের মধ্যে আমি অদ্ভুত মিল খুঁজে পাই। দুজনেই অল্প বয়সে ঝরে যাওয়া প্রাণ। বেঁচে থাকতে তো জনপ্রিয় ছিলেনই, মৃত্যুর পর তা বেড়েছে আরও বহুগুণে।

আরও পড়ুন : শনিবার বিকেল : খুলে যাক রুদ্ধ দ্বার 

সালমান শাহ এখনো কেন জনপ্রিয়? এই প্রশ্নের উত্তর এক লাইনে দেওয়াটা খুব সোজা হবে না। তবে যিনি বা যারা জনপ্রিয় হন, তারা কোনো না কোনোভাবে গণমানুষের সাথে যুক্ত থাকেন। আবার জনপ্রিয়তারও বিভিন্ন ধরন রয়েছে।

কেউ কেউ কোনো বিশেষ শ্রেণির, বিশেষ বয়সী দর্শকের কাছে জনপ্রিয়। তবে রাজ্জাকের পর সর্বমহলে জনপ্রিয়তা পাওয়া নায়ক সালমান শাহই। সব মহলে জনপ্রিয়তা পাওয়াটা যতটা কঠিন, তারচেয়েও কঠিন হলো সেই জনপ্রিয়তা ধরে রাখা।

আনন্দ অশ্রু (১৯৯৭)-তে যেমন তিনি পাগলের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন, তেমনি এই ঘর এই সংসার (১৯৯৬)-এ ভাইয়ের ভূমিকায় তাকে দেখে মনে হচ্ছিল, তিনি পাশের বাড়ির কোনো ছেলে।

সালমান তার স্বল্প ক্যারিয়ারের সময়ে সেই ব্যাপারটা পেরেছিলেন। কেয়ামত থেকে কেয়ামত (১৯৯৩) দিয়ে যে মানুষটা তরুণদের মণিকোঠায় স্থান করে নিয়েছিলেন, সেই মানুষটা পরবর্তীতে একের পর এক সিনেমা দিয়ে সব বয়সের সবার মনেই জায়গা করে নিলেন।

সেখানে যেমন ছিল বিক্ষোভ (১৯৯৪)-এর মতো রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সিনেমা, তেমনি ছিল সুজন সখি (১৯৯৪)-এর মতো গ্রামীণ প্রেক্ষাপটের সিনেমা।

আনন্দ অশ্রু (১৯৯৭)-তে যেমন তিনি পাগলের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন, তেমনি এই ঘর এই সংসার (১৯৯৬)-এ ভাইয়ের ভূমিকায় তাকে দেখে মনে হচ্ছিল, তিনি পাশের বাড়ির কোনো ছেলে। অর্থাৎ সব ধরনের চরিত্রে স্বাভাবিকভাবে অভিনয় করে তিনি সবার মাঝে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।

আরও পড়ুন : চলচ্চিত্র বিষয়ক এজেন্ডাটা কী?

যে ব্যাপারটা নিয়ে কথা না বললেই না, সেটা হচ্ছে সালমান শাহের ফ্যাশন আর ড্রেসিং সেন্স। এই ব্যাপারটা নিয়ে আসলে এত আলোচনা হয়েছে, এরপরেও প্রতিবার আলোচনা করতে গেলে বিস্ময় জাগে এই ভেবে যে, কীভাবে একটা মানুষ এতটা ফ্যাশনেবল হতে পারেন! কীভাবে একটা মানুষ সময়ের চেয়ে এতটা এগিয়ে থাকতে পারেন!

বাহারি সব সানগ্লাসের কালেকশন, বাহারি সব টুপি পরা, নিত্যনতুন জুতা আর কেডস পরা, ডান হাতে ঘড়ি পরা, মাথায় ব্যান্ডেনা পরা, শার্ট ইন করে কিছু অংশ বের করে রাখা, চোখে লেন্স পরা, মাথার সামনের দিকের চুল পরে যাচ্ছে—চিন্তা না করে পেছনের চুল লম্বা করে ঝুঁটি করে ফেলা, একটা জ্যাকেট পরলে সেটাও স্টাইলিশ জ্যাকেট পরা, লম্বা ওভারকোট পরা—এই লিস্ট আসলে শেষ হওয়ার নয়।

মায়ের অধিকার (১৯৯৬) সিনেমায় আলমগীরের সাথে যেভাবে পাল্লা দিয়ে শুদ্ধ উচ্চারণে ইংরেজি বলেছিলেন, সেই ব্যাপারটা খুব ভালোভাবেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়—একজন শিক্ষিত অভিনেতা আসলে পর্দায় কতটা প্রভাব ফেলতে পারেন নিজের কাজের মাধ্যমে।

আগে দর্শনধারী, এরপরে গুণ বিচারী—এই ব্যাপার সালমান শাহ হয়তো বেশ সিরিয়াসলি নিয়েছিলেন, এই কারণেই প্রচণ্ড ফ্যাশন সচেতন ছিলেন। তবে অন্যদের থেকে তিনি আলাদা ছিলেন। তিনি দেখতে যেমন সুদর্শন তেমনি গুণেও ছিলেন অনন্য।

গুণ থাকার প্রমাণ হচ্ছে, সালমান শাহের সাবলীল অভিনয়। এফডিসির অনেকেই যেখানে যাত্রার ঢং-এ বা মাত্রাতিরিক্ত চিৎকার করে সংলাপ বলেন, সেই জায়গায় তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। বাড়াবাড়ি কিছু করতেন না, অতিরিক্ত মেলোড্রামা করতেন না। বাংলা আর ইংরেজি- দুটোর উচ্চারণই ছিল পরিষ্কার।

মায়ের অধিকার (১৯৯৬) সিনেমায় আলমগীরের সাথে যেভাবে পাল্লা দিয়ে শুদ্ধ উচ্চারণে ইংরেজি বলেছিলেন, সেই ব্যাপারটা খুব ভালোভাবেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়—একজন শিক্ষিত অভিনেতা আসলে পর্দায় কতটা প্রভাব ফেলতে পারেন নিজের কাজের মাধ্যমে।

আরও পড়ুন : বাংলাদেশের চলচ্চিত্র (১৯৪৭-১৯৭৫) শিল্পের স্বকীয়তা 

শুরু করেছিলাম জেমস বায়রন ডিনকে দিয়ে, শেষও করতে চাই তাকে দিয়ে। যারা অনেক সমৃদ্ধশালী হয়, তাদের একটা হ্যাপি এন্ডিং দেখতে না পারলে আমরা সেটা মেনে নিতে পারি না। তাদের প্রতি একটা অচেনা, অজানা মায়া জন্মে যায়। মায়াটা অচেনা হলেও, মানুষটাকে অচেনা মনে হয় না—বরং অনেক বেশি আপন মনে হয়। এই ব্যাপারটা জেমস বায়রন ডিন আর সালমান শাহ—দুজনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

সবদিক থেকে সমৃদ্ধ থাকা এই দুজন মানুষই হুট করে বিদায় নেন, যা মেনে নেওয়া কষ্টের। সেই কষ্ট থেকে জন্ম নেওয়া অচেনা মায়াই হয়তো তাদেরকে দিনদিন আরও বেশি জনপ্রিয় করে তুলেছে। তবে সেই জনপ্রিয়তার পেছনে তাদের কাজের অবদান ছিল অপরিসীম—সেই ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই।

জেমস বায়রন ডিনের স্বল্প সময়ের কাজকে হলিউড খুব ভালোভাবেই সংরক্ষণ করেছে, সালমান শাহ’র ক্ষেত্রে আমরা তেমনটা কবে করব? নাকি প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসে দীর্ঘশ্বাস ফেলাটাই আমাদের একমাত্র অবলম্বন হবে?

সৈয়দ নাজমুস সাকিব ।। শিক্ষক ও চলচ্চিত্রপ্রেমী