বিমানের জন্য যাদের কর্মকাণ্ড ও আচরণ ক্ষতিকর কিংবা যারা ক্যান্সারের মতো তাদের চাকরিচ্যুত করাই উত্তম। সিদ্ধান্তটি যত দ্রুত নেওয়া সম্ভব, তত সেটি বিমান এবং সেই ব্যক্তির জন্য লাভজনক। এ কারণে আমি অভিযোগগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা নিয়েছি। বেশকিছু ব্যক্তি, যারা ঝুলন্ত অবস্থায় ছিলেন, তাদের কেউ কেউ বহাল হয়েছেন আর কেউ কেউ চাকরি হারিয়েছেন। তবে, বিষয়গুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হচ্ছে...

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, আকাশ পথে যাত্রীসেবা প্রদানকারী বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী একমাত্র প্রতিষ্ঠান। ১৯৭২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি একটি মাত্র (ডিসি-৩) উড়োজাহাজ নিয়ে কার্যক্রম শুরু করা বিমানের বহরে এখন আছে ২১টি অত্যাধুনিক উড়োজাহাজ। বর্তমানে ১৯টি আন্তর্জাতিক গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনা করছে প্রতিষ্ঠানটি। আগে এ সংখ্যা ছিল ২৯।

দিন যত গড়িয়েছে তত কমেছে বিমানের আন্তর্জাতিক রুটের সংখ্যা। সক্ষমতা ও সেবার মান বিবেচনায় ৫০ বছরে আদৌ কি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরেছে বিমান? পরিচ্ছন্ন ট্র্যাক রেকর্ডের অধিকারী একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক কতটুকু বদলাতে পেরেছেন বিমানকে?

সরকারি এয়ারলাইন্সটির বিরুদ্ধে থাকা নানা অভিযোগ, যাত্রীসেবার মান, কর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব, শৃঙ্খলা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করেছেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. আবু সালেহ্‌ মোস্তফা কামাল। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ঢাকা পোস্টের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক আদনান রহমান। নিচে তা তুলে ধরা হলো-

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব নেওয়া ড. আবু সালেহ্‌ মোস্তফা কামাল সর্বশেষ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে অতিরিক্ত সচিব পদে কর্মরত ছিলেন। তার ব্যক্তিগত প্রোফাইল থেকে জানা যায়, শিক্ষাজীবনে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক (সম্মান) এবং একই বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পিএইচডি করেন মাশরুমের সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণসহ ফুড সেফটির ওপর।

গবেষণার নিদর্শনস্বরূপ ‘পুষ্টিসমৃদ্ধ মাশরুম জুস’ ও ‘মাশরুম-ড্রায়ার’ আবিষ্কারের জন্য ড. সালেহ্ দুটি পেটেন্ট-এর মেধাস্বত্ব তথা ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি’র (আইপি) অধিকারী হন। এমন অর্জন বাংলাদেশের সিভিল সার্ভেন্টদের মধ্যে আর কারো নেই। এছাড়া তিনি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের শুদ্ধাচার পুরস্কার লাভ করেন। একাদশ বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের এ সদস্য মানিকগঞ্জ, দৌলতপুর, কোটালিপাড়া, মধুখালী, ঢাকা ও মুন্সীগঞ্জে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি ধর্ম মন্ত্রণালয়ে পরিচালক, হজ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ড. আবু সালেহ্‌ মোস্তফা কামাল / ছবি- ঢাকা পোস্ট 

ঢাকা পোস্ট : বিমানের এমডির দায়িত্ব নিয়ে বলেছিলেন, ‘বিমানের কোনো অংশ ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে সেই অংশটুকু কেটে ফেলে দিতে কুণ্ঠাবোধ করবেন না’। আপনার এমন নীতির কারণেই কি পাইলটদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বিমানের সিনিয়র পাইলট ও বাংলাদেশ বিমান এয়ারলাইন্স পাইলট অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) সভাপতি ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমানকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে? শৃঙ্খলা নিয়ে বিমানের বর্তমান অবস্থান কেমন? 

ড. আবু সালেহ্‌ মোস্তফা কামাল : ক্যাপ্টেন মাহবুবকে পাইলটের চাকরি থেকে অবসায়ন করা হয়েছে, কিন্তু পদবি বা পদাধিকার অনুযায়ী (বাপার সভাপতি হিসেবে) আমরা কাউকে অবসায়ন করিনি। বিমানের লোয়ার উইং (অধস্তন) ও আপার উইংয়ে (ঊর্ধ্বতন) প্রচুর কর্মী রয়েছেন। সেসব উইংয়েও বিমানের স্বার্থে আমূল পরিবর্তন আনা হচ্ছে। অনেকে চাকরিচ্যুত হয়েছেন। অনেকে সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন।

আগে সাময়িক বরখাস্ত হওয়ার পর অনেক কর্মী দীর্ঘদিন বসে থাকতেন। তাদের প্রচুর মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে থাকতে হতো। পাশাপাশি তারা খোরাকি ভাতা পেতেন। এটা ওই ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিমান- কারো জন্যেই কল্যাণকর নয়। এ কারণে তারা যদি দোষত্রুটিমুক্ত হন, যত দ্রুত সম্ভব তাদের কাজে লাগানোটা সমীচীন। একইভাবে বিমানের জন্য ক্ষতিকর বা ক্যান্সারের মতো যারা, তাদের চাকরিচ্যুত করাই উত্তম। সিদ্ধান্তটা যত দ্রুত নেওয়া সম্ভব, তত সেটা বিমান ও সেই ব্যক্তির জন্য লাভজনক। এ কারণে আমি অভিযোগগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা নিয়েছি। বেশকিছু ব্যক্তি, যারা ঝুলন্ত অবস্থায় ছিলেন, তাদের কেউ বহাল হয়েছেন আর কেউ চাকরি হারিয়েছেন। তবে, বিষয়গুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হচ্ছে।

[বেতন কর্তন বাতিলসহ পাইলটদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে আন্দোলন করেছিলেন পাইলটরা। ওই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান। ২০২১ সালের ১ ডিসেম্বর তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। তবে ঠিক কী কারণে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।]

ঢাকা পোস্ট : বিমানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে প্রায়ই স্বর্ণসহ চোরাচালানের বিভিন্ন অভিযোগ ওঠে। গ্রেপ্তারও হয়েছেন কয়েকজন। কিন্তু চিহ্নিত অনেকে এখনও বিমানে আছেন। তাদের বিষয়ে বিমানের অবস্থান কী? এ ধরনের কাজ আর যাতে না হয় সেক্ষেত্রে বিমান কী কী উদ্যোগ নিয়েছে?

বিমানের জন্য ক্ষতিকর বা ক্যান্সারের মতো যারা, তাদের চাকরিচ্যুত করাই উত্তম— বলেন ড. আবু সালেহ্‌ মোস্তফা কামাল / ছবি- সংগৃহীত

ড. আবু সালেহ্‌ মোস্তফা কামাল : স্বর্ণ চোরাচালান আগেও ছিল, এখনও আছে। এটা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। এ বিষয়ে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে, বিভিন্ন স্থানে ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। বিমানের পক্ষ থেকে যত ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, তা নেওয়া হয়েছে।

আগে বিমানের ইঞ্জিনিয়ারিং (প্রকৌশল) বিভাগের বিরুদ্ধে এমন চোরাচালানের অভিযোগ করা হতো। এখন সেটা নেই। ব্যক্তিবিশেষ যারা এ পোশাক (বিমানের পোশাক) ব্যবহার করে চোরাচালান করছে, তাদের শাস্তি হচ্ছে। চোরাচালান বন্ধে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও কাজ করছে।

ঢাকা পোস্ট : ‘বিমানের সিট নেই, টিকিটও নেই। পরে আবার শোনা যায় ফাঁকা সিট নিয়ে বিমান চলে’-  যুগ যুগ ধরে চলে আসা এ অভিযোগের বিষয়ে কী বলবেন?

ড. আবু সালেহ্‌ মোস্তফা কামাল : আমি যখন বিমানের এমডি ছিলাম না, তখন আমারও এমন ধারণা ছিল। কিন্তু যখন দায়িত্ব নিলাম তখন আমি বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করা শুরু করি। দেখলাম, বিষয়গুলো একটু ভিন্ন। আমাদের ধারণা ভুল। ভুল ধারণাগুলো ভাঙা উচিত।

বিমানের কিছু ইন্টারলিংক ফ্লাইট আছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, একজন বাংলাদেশি মধ্যপ্রাচ্য থেকে বাংলাদেশের কোনো জেলায় যাবেন। এজন্য তাকে প্রথমে বিমানের ফ্লাইটে ঢাকায় আসতে হবে। পরবর্তীতে ঢাকা থেকে অন্য ফ্লাইটে নিজ গন্তব্যে যাবেন। অনেক সময় বিদেশ থেকে ফ্লাইট আসতে দেরি হয়। তখন অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটগুলো সেসব বিদেশফেরত যাত্রী না নিয়েই চলে যেতে বাধ্য হয়। এ সময় ভেতরে সিট ফাঁকা থাকে। এছাড়া কোনো রুটে যাত্রী বেশি থাকলে আমরা সেখানে ছোট বিমান সরিয়ে বড় বিমানে ফ্লাইট পরিচালনা করি। হঠাৎ করে বিমান পরিবর্তন করায় কিছু সিট ফাঁকা থাকে। যাত্রীরা এসব ফ্লাইটের ফাঁকা সিট দেখেই বিরূপ ধারণা পোষণ করেন।

ফাঁকা সিট নিয়ে কেন বিমান চলে— এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন বিমানের এমডি ড. আবু সালেহ্‌ মোস্তফা কামাল / ছবি- ঢাকা পোস্ট

করোনাকালে সামাজিক দূরত্ব মেনে ফ্লাইট পরিচালনার ক্ষেত্রে কিছু বিধিনিষেধ ছিল। যেমন- বোয়িং-৭৭৭ মডেলের বিমানে সিট ৪১৯টি। ভ্রমণ বিধিনিষেধের কারণে আমরা ওই সময় ৩৫০ যাত্রী বহন করেছি। ৬৯টি সিট খালি ছিল। যাত্রীদের অনেকে টিকিটের জন্য এদিক-ওদিক ঘুরেছেন, প্রায় যুদ্ধ করে টিকিট কিনেছেন; ফ্লাইটে গিয়ে যখন দেখলেন সিট খালি, তখন হয়তো প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। আবার অনেকে হয়তো জানতেনও না, করোনাকালে সিট ফাঁকা রেখে ফ্লাইট চালাতে হয়।

এছাড়া কিছু দুষ্টুচক্র তো আছেই, যারা বিমান ফাঁকা থাকার তথ্য বাইরে ছড়ান, ভাইরাল করেন। সর্বোপরি বলতে চাই, বিমান শুধু ব্যবসা করে না, সেবাও করে। কিছু রুট আছে, আমরা জানি সেখানে গেলে বিমানের কিছু সিট খালি থাকবেই; তারপরও যাত্রীসেবার স্বার্থে সেখানে ফ্লাইট পরিচালনা করতে হয়।

ঢাকা পোস্ট : পাইলটদের সঙ্গে নানা ইস্যুতে মনোমালিন্য হয়, তারা আল্টিমেটাম দেন। আলোচনার মাধ্যমে তার সমাধানও হয়। আবার নতুন ইস্যু তৈরি হয়। কয়েক বছর ধরে এমনটি চলে আসছে। পাইলটদের সব দাবিদাওয়া নিষ্পত্তি হয়েছে কি না, তাদের সঙ্গে বিমান কর্তৃপক্ষের সম্পর্কে কোনো দূরত্ব আছে কি না?

ড. আবু সালেহ্‌ মোস্তফা কামাল : পাইলটরা বিমানের গুরুত্বপূর্ণ অর্গান (অঙ্গ)। অন্য সব চাকরির ক্ষেত্রে নিয়োগ, প্রশিক্ষণ ও পদোন্নতির বিষয়গুলো যেভাবে বিবেচিত হয়, বিমানের পাইলটদের ক্ষেত্রেও একইভাবে বিবেচনা করা হয়। এসব বিষয় নিয়ে সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টির কিছু বিষয় আছে। করোনা এটাকে আলাদা একটা মাত্রা দিয়েছে।

বিমানে দুই ধরনের পাইলট নিয়োগ হয়। নিয়মিত ও চুক্তিভিত্তিক। নিয়মিত পাইলটরা সুনির্দিষ্ট কাঠামোতে বেতন-ভাতা ও অন্য সুযোগ-সুবিধা পান। চুক্তিভিত্তিক পাইলটরা চুক্তি অনুযায়ী সুযোগ-সুবিধা পান। পাইলটরা কোনো ইস্যু বা সমস্যা নিয়ে যদি আমাদের কাছে আসেন, আমরা সঙ্গে সঙ্গে বসে নেগোসিয়েশন (আলোচনা) করে সমাধান করি। এখন তাদের বড় কোনো সমস্যা আছে বলে আমি মনে করি না।

ঢাকা পোস্ট : বিমানের সবপর্যায়ের কর্মীদের নিজস্ব সংগঠন-ইউনিয়ন আছে। এগুলো আবার দুই/তিন ভাগে বিভক্ত। প্রায়ই নানা ইস্যুতে একে-অন্যের ওপর দোষারোপ বা কাদা-ছোড়াছুড়ির মতো অপেশাদার আচরণ দেখা যায়। এসব কর্মকাণ্ড বিমানকে পিছিয়ে দিচ্ছে কি না?

ড. আবু সালেহ্‌ মোস্তফা কামাল : রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী এয়ারলাইন্সের কর্মীরা যতটা স্বাধীনভাবে ও নিশ্চিন্তে কাজ করেন, যেভাবে মত প্রকাশ করতে পারেন, আমার মনে হয় অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা সেভাবে পারেন না। অন্য কোথাও পারেন না, বিমানে পারেন— এ পার্থক্যটাই ইতিবাচক দিক। তবে, পরস্পর কাদা-ছোড়াছুড়িটা নেতিবাচক। নিজ নিজ স্বার্থে এমন কাজ না করাই সমীচীন।

বিমানের পাইালটদের এখন বড় কোনো সমস্যা নেই বলে মনে করেন প্রতিষ্ঠানটির এমডি। ছবি- ঢাকা পোস্ট

ঢাকা পোস্ট : অভিযোগ আছে, বিমানের বহরে উড়োজাহাজ ভাড়া নেওয়ার সময় বা কেনার সময় বেশি ব্যয় দেখানো হয়। দুর্নীতির এমন ‘গুঞ্জন’ প্রসঙ্গে কী বলবেন?

ড. আবু সালেহ্‌ মোস্তফা কামাল : যেখানে স্বচ্ছতার অভাব থাকে সেখানেই এমন ‘গুঞ্জন’ শোনা যায়। কোথাও স্বচ্ছতা থাকলে দুর্নীতির গুঞ্জন থাকে না। উড়োজাহাজ কেনা বা লিজের সিদ্ধান্ত বিমানের পর্ষদ নিয়ে থাকে। পর্ষদের সুচিন্তিত মতামত, পর্যবেক্ষণ ও চুলচেরা বিশ্লেষণের মাধ্যমে যে সিদ্ধান্ত আসে সেটাই বাস্তবায়ন করা হয়। স্বচ্ছতার ভিত্তিতে এখন সবকিছু হচ্ছে তাই দুর্নীতির কোনো প্রশ্নই আসে না।

ঢাকা পোস্ট : দায়িত্ব নেওয়ার পর কোন কাজগুলোকে আপনার অর্জন হিসেবে দেখেন…

ড. আবু সালেহ্‌ মোস্তফা কামাল : করোনাকালের সংকটময় পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার প্রণোদনার অংশ হিসেবে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে যে ঋণ দিয়েছিল সেটা আমরা যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পেরেছি। এছাড়া মুজিববর্ষের মাইলফলক হিসেবে বিমানের দক্ষ প্রকৌশলী ও টেকনিশিয়ানদের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো সম্পূর্ণ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার উড়োজাহাজের সি-চেক দেশেই সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। ফলে বিমানের ছয় লাখ মার্কিন ডলারের মতো অর্থ সাশ্রয় হয়েছে। পাশাপাশি নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় উড়োজাহাজের গিয়ার রিপ্লেসমেন্ট (প্রতিস্থাপন) করার মতো কাজও আমাদের বড় অর্জন।

বিমানের বহরে বর্তমানে ২১টি উড়োজাহাজ আছে। চারটি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর, চারটি বোয়িং ৭৮৭-৮, দুটি বোয়িং ৭৮৭-৯, ছয়টি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ এবং পাঁচটি ডি হ্যাভিল্যান্ড কানাডা ডিএইচসি-৮ কিউ ৪০০।

ঢাকা পোস্ট : বিমানের দায়িত্ব নিয়ে আপনি বলেছিলেন, শিডিউল ঠিক রাখাই হবে আপনার প্রথম ও প্রধান চ্যালেঞ্জ। আদৌ কি শিডিউল ঠিক করতে পেরেছেন?

ড. আবু সালেহ্‌ মোস্তফা কামাল : প্রতি সপ্তাহেই আমরা শিডিউল নিয়ে বৈঠক করি। সপ্তাহের অবস্থা রিভিউ করি। অনেক সময় আন্তর্জাতিক শিডিউল ঠিক রাখতে পারলেও অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটের ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। আবার অভ্যন্তরীণ শিডিউল ঠিক থাকলেও কখনো কখনো আন্তর্জাতিকটা ঠিক থাকে না। তবে, সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, বিমানের ৭৩ থেকে ৮৬ শতাংশ ফ্লাইট ‘অন টাইম’ অর্থাৎ সময়মতো ছেড়েছে। আন্তর্জাতিক মান বিবেচনায় এ হার ৯০-এর ওপরে গেলে একটি এয়ারলাইন্সের শিডিউল ঠিক আছে বলে ধরে নেওয়া হয়।

বিমানের টিকিটের জন্য হাহাকার। কাঙ্ক্ষিত টিকিট পেতে প্রবাসীদের রাজপথে বিক্ষোভও করতে দেখা যায় / ছবি- সংগৃহীত

আমি বলব না যে শিডিউল পুরোপুরি ঠিক করতে পেরেছি, তবে লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি আছি।

অনেক সময় নানা কারণে শিডিউল ঠিক রাখা সম্ভব হয় না। ঢাকা থেকে দেশের বাইরে যাওয়া ফ্লাইট অনেক কারণে সময়মতো দেশে ফিরতে পারে না। একটা ফ্লাইট ছাড়তে দেরি হলে ইক্যুয়েশনাল ইফেক্টের (সমীকরণীয় প্রভাব) কারণে অন্য ফ্লাইটগুলোর শিডিউল পরিবর্তন করতে হয়। ফলে বিপর্যয় ঘটে। এছাড়া আমরা প্রবাসীদের চলাচলের সুবিধার্থে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের সঙ্গে ডোমেস্টিক ফ্লাইট কানেক্ট (যুক্ত) করেছি। যেমন- লন্ডনের ফ্লাইটটি সিলেট হয়ে ঢাকায় আসে। কানেক্টিভিটির (সংযোগ) কারণে তারতম্যটা বেশি হয়। আমরা বিষয়গুলো যতটুকু সম্ভব কমিয়ে আনার চেষ্টা করছি।

ঢাকা পোস্ট : ৫০ বছর পার করেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। এখনও সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। মান বাড়াতে নতুন কী উদ্যোগ নিয়েছেন বা নিচ্ছেন?

ড. আবু সালেহ্‌ মোস্তফা কামাল : বিমানের যাত্রীরা আগে অনলাইনে শুধুমাত্র ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড দিয়ে টিকিট কাটতে পারতেন। এখন থেকে বিকাশ-নগদের মতো মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে পেমেন্ট করে টিকিট সংগ্রহ করতে পারবেন। এছাড়া আগামী কয়েক দিনের মধ্যে যাত্রীরা অনলাইনে ওয়েব চেক-ইনের মাধ্যমে নিজের বোর্ডিং পাস নিজেই প্রিন্ট করতে পারবেন। যাত্রী কোন আসনে বসতে চান সেটিও নিজে ঘরে বসে বেছে নিতে পারবেন। এ দুই যাত্রীবান্ধব ও অত্যাধুনিক সেবার পাশাপাশি আরও কিছু উদ্যোগ নেওয়ার পরিকল্পনা আছে যেগুলো বাস্তবায়িত হলে জাতীয় পতাকাবাহী এ প্রতিষ্ঠান আরও সামনে এগিয়ে যাবে।

ঢাকা পোস্ট : প্রবাসীদের দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা ঢাকা-টরোন্টো ফ্লাইট। ২৬ মার্চ এটি চালু হচ্ছে তো?

ড. আবু সালেহ্‌ মোস্তফা কামাল : প্রবাসী বাংলাদেশিরা টরোন্টো ফ্লাইট নিয়ে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন। আমরা ফ্লাইটটি যত দ্রুত সম্ভব চালুর চেষ্টা করছি। ২৬ মার্চ ফ্লাইট পরিচালনার টার্গেট ফিক্সড করে এগোচ্ছি। এ রুটে ফ্লাইট পরিচালনায় ১৭টি শর্ত ছিল। এর মধ্যে ১৫টি পূরণ করতে পেরেছি। বাকি দুটি শর্ত পূরণের জন্য একটি প্রতিনিধি দল এখন কানাডায় অবস্থান করছেন। যেভাবেই হোক মুজিববর্ষে টরোন্টো ফ্লাইট চালু করতে চাই আমরা।

রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী এয়ারলাইন্সের কর্মীরা যতটা স্বাধীনভাবে ও নিশ্চিন্তে কাজ করেন, সেটা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে সম্ভব নয়— দাবি বিমানের এমডির / ফাইল ছবি

আমাদের প্রকৌশলীরা টরোন্টো থেকে ফেরার সময় কোনো দেশে টেকনিক্যাল ল্যান্ডিংয়ের প্রয়োজন আছে কি না তা যাচাই-বাছাই করছেন। পাশাপাশি এ রুটের ভাড়া নির্ধারণের কাজও চলছে।

ঢাকা পোস্ট : মহামারি করোনার কারণে গত দুই বছর হজ অনুষ্ঠিত হয়নি। এ বছরও হজ পালনের কোনো পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেনি সৌদি আরব। অথচ বিমানের আয়ের বড় একটি অংশ আসে হজ থেকে। হজ না হওয়ায় বিমানের আয়ে কোনো প্রভাব পড়েছে কি না?

ড. আবু সালেহ্‌ মোস্তফা কামাল : হজের সময় বিমান ভালো একটা আয় করে। যা বিমানের বিভিন্ন লোকসান কাভার করে। হজ না হওয়ায় আমরা আয় কম করেছি ঠিক, তবে গত দুই বছর বিমান লোকসান করেনি, বরং লাভে ছিল। প্রণোদনা ফান্ডের অর্থ যথাযথ ব্যবহার করেছি আমরা। অপ্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে এনেছি। আমরা আশা করছি, এবার হজ পালনের ঘোষণা আসবে। ঘোষণা এলে হজযাত্রীর সংখ্যা বিবেচনায় প্রস্তুতি শুরু করব। 

এআর/এমএআর/