একটা সময় ট্রেনের টিকিট কাটার একমাত্র উপায় ছিল সশরীরে কাউন্টারে গিয়ে টিকিট কাটা। তবে প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় মানুষ এখন ঘরে বসেই অনলাইনে ট্রেনের টিকিট কাটতে পারেন। বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ থার্ড পার্টির মাধ্যমে অনলাইনে টিকিট বিক্রি করে থাকে। বর্তমানে ট্রেনের টিকিট বিক্রির এই কাজটি করছে ‘সহজ-সিনেসিস-ভিনসেন জেভি’। গেল ঈদে প্রথমবারের মতো অনলাইনে ট্রেনের টিকিট বিক্রি করেছে দীর্ঘদিন ধরে বাস ও লঞ্চের টিকিট বিক্রির অভিজ্ঞতা সম্পন্ন সহজ-সিনেসিস-ভিনসেন জেভির লিড পার্টনার সহজ লিমিটেড। তবে টিকিট বিক্রির শুরুতেই সার্ভার ডাউনসহ নানা জটিলতায় পড়তে হয় সহজকে। ঈদে টিকিট বিক্রি ও মানুষের ভোগান্তিসহ নানা বিষয়ে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা বলেছেন সহজের জনসংযোগ কর্মকর্তা ফারহাত আহমেদ।  

ঢাকা পোস্ট: প্রথমবারের মতো রেলের টিকিট বিক্রির অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

ফারহাত আহমেদ: প্রথমবারের মতো রেলের টিকিট বিক্রির চাপ সামলাতে গিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের অধিক অভিজ্ঞতা হয়েছে। আমাদের মূল ও প্রথম চ্যালেঞ্জের বিষয় ছিল মাত্র ২১ দিনের মধ্যে কাউন্টারের জন্য সফটওয়্যার এবং অনলাইনের জন্য ওয়েবসাইট তৈরি করা এবং ২১ দিনের মধ্যেই আমরা সেটি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি।

ঢাকা পোস্ট: অনলাইনে ট্রেনের টিকিট বিক্রির প্রথম দিনই সাইট অচল হয়েছে কেন?

ফারহাত আহমেদ: ২৬ মার্চ সকালে যখন প্রথম ওয়েবসাইট রান করি তখন বিশাল পরিমাণ হিট এসেছিল সাইটে। আমরা চিন্তা করেছিলাম সাইবার অ্যাটাকের মতো কোনো কিছু হবে। কারণ, দেশের বাইরে থেকে প্রচুর পরিমাণে হিট এসেছিল। আমি যদি একটা প্যারামিটার ধরি, এক মিনিটে সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ হিট হতে পারে। কিন্তু সেখানে ২৬ তারিখ সকাল ৮টা ১ মিনিটে ২০ লাখ হিট কী করে সম্ভব! আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের বাইরে থেকে এত হিট কেন আসবে? তাদের তো টিকিট দরকার নেই, তাহলে কেন এত হিট! যখন সার্ভার ডাউন হয়েছিল, তখন আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে সেটা আপ করার চেষ্টা করেছি। সর্বোচ্চ ১২ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে এটাকে আমরা ঠিক করেছি। ২৭ মার্চ থেকে সবাই সুন্দরভাবে টিকিট কাটতে পেরেছেন। 

বাংলাদেশ রেলওয়েকে টিকিট বিক্রিতে সহায়তা করার জন্য এ বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি চুক্তিবদ্ধ হয় ‘সহজ’।
সড়ক ও নৌপথে নানা ঝক্কি-ঝামেলার তুলনায় ট্রেন ভ্রমণ অনেকটা আরামদায়ক। তাই দীর্ঘ ভ্রমণে মানুষের পছন্দের শীর্ষে থাকে ট্রেন। ঈদের মতো উৎসবগুলোতে তাই ট্রেনের টিকিটের চাহিদা বেড়ে যায় বহু গুণে। টিকিটের জন্য স্টেশনগুলোর কাউন্টারের সামনে টিকিট প্রত্যাশীদের অপেক্ষা থাকে ৩৬ থেকে ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত। 

ঢাকা পোস্ট: ঈদে টিকিটের চাপ কীভাবে সামলেছেন?

ফারহাত আহমেদ: ওই ঘটনার পর আমাদের মূল টার্গেট ছিল, ঈদের সময় যেন আমাদের সার্ভার ডাউন না হয়। এর জন্য আমাদের ডেভলপাররা দিন-রাত এক করে কাজ করেছেন এবং আমরা সফল হয়েছি। ২৩ তারিখ থেকে ঈদযাত্রার অগ্রীম টিকিট বিক্রি শুরু হয়। ওইদিন সকাল ৮টা ১ মিনিটে আমাদের ওয়েবসাইটে ৫ লাখ, পরদিন ১০ লাখ এবং তৃতীয় দিন ১৮ লাখ হিট পড়ে। এটিই ছিল ওই সময়ের সর্বোচ্চ হিট। এরপরও আমাদের ওয়েব সাইট স্ট্যাবল ছিল।

ঢাকা পোস্ট: ওই সময় কোনো ঝামেলা পোহাতে হয়েছে কি  না?

ফারহাত আহমেদ: ঈদে আমাদের সবচেয়ে বড় ঝামেলা পোহাতে হয় যেটা, সেটা হচ্ছে টিকিট কম চাহিদা বেশি। সাধারণ মানুষ ভেবেছে, সহজ থেকে টিকিট পাওয়া যায় না। কিন্তু মানুষ এটা বুঝতে চায় না, রেলওয়ে আমাদের যে পরিমাণ টিকেট বরাদ্দ দিয়েছে, সে পরিমাণই বিক্রি করতে পারি। মিডিয়াও এমনভাবে প্রকাশ করেছে যে, সহজে টিকিট খুঁজে পাওয়া যায়নি।

দীর্ঘ ভ্রমণে মানুষের পছন্দের শীর্ষে থাকে ট্রেন। ঈদের মতো উৎসবগুলোতে তাই ট্রেনের টিকিটের চাহিদা বেড়ে যায় বহু গুণে।
গেল ঈদুল ফিতরে অনলাইনে ট্রেনের টিকিটের জন্য ১০ দিনে ওয়েবসাইটে ৩০ কোটির বেশি হিট করেছেন টিকিট প্রত্যাশীরা।

ঢাকা পোস্ট: টিকিট প্রত্যাশীদের অভিযোগ— ঈদে ওয়েবসাইটে প্রবেশের পর ‘কিউ’ দেখিয়েছে। এ বিষয়ে কী বলতে চান?

ফারহাত আহমেদ: ওয়েবসাইটে প্রবেশের পর ‘কিউ’ দেখিয়েছে কারণ, প্রতিদিন ঢাকা থেকে ১৩ হাজারের কিছু বেশি টিকিট বিক্রির কথা বলা হয়েছে। সাইটে হিট পড়েছে ৫ লাখ, টিকিট মাত্র ১৩ হাজার প্লাস। এই ৫ লাখের মধ্যে প্রথম ১৩ হাজার প্লাস মানুষ টিকিট কাটতে পেরেছে। এর বাইরে যারা ছিল, তাদের কিউ দেখিয়েছে। এটা মিলি সেকেন্ডের খেলা। একজন করে টিকিট কেটে বের হলেই কিউতে থাকা আরেকজন প্রবেশ করতে পরেছেন।

ঢাকা পোস্ট: ঈদে একই টিকিট ডাবল প্রিন্টিংসহ সহজের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ছিল টিকিট প্রত্যাশীদের...

ফারহাত আহমেদ: আমি শুনেছি এমন অভিযোগের কথা। তবে এটা কিভাবে সম্ভব হলো সেটা আমি জানি না। এ বিষয়ে ডেভলপারদের সঙ্গে কথা বলে জানতে হবে। এটা যেহেতু টেকনিক্যাল ইস্যু, তাই তাদের কাছ থেকেই জানতে হবে। এটা কোনোভাবেই হওয়ার কথা না। এছাড়া আমাদের বিরুদ্ধে টিকিট না পাওয়ার অভিযোগ ছিল। আমি আগেই বলেছি, চাহিদা বেশি বরাদ্দ কম। যারা টিকিট পেয়েছে, তারা কিন্তু মিডিয়ার সামনে কিছু বলেনি। আমরা তো সবাইকে টিকিট দিতে পারবো না। বাংলাদেশ রেলওয়ে যত টিকিট বরাদ্দ দেবে, আমরা ততটাই বিক্রি করতে পারবো। কর্তৃপক্ষ যদি বলে আগামী ঈদে দিনে ১ লাখ টিকিট বিক্রি করতে, আমরা করবো। সে ক্ষেত্রে ৫ লাখ হিটের প্রথম ১ লাখ জনই টিকিট পাবে।

সহজ সূত্রে জানা গেছে, ঈদযাত্রার ১০ দিনে (২৭ এপ্রিল থেকে ৬ মে) সারা দেশে মোট টিকিট বিক্রি হয়েছে সাড়ে ৬ লাখের বেশি। এর মধ্যে কাউন্টার থেকে সাড়ে ৪ লাখ এবং অনলাইন থেকে ২ লাখ ৭০ হাজারের বেশি টিকিট সংগ্রহ করেছেন টিকিট প্রত্যাশীরা। ঈদ যাত্রার জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ে গত ২৩ এপ্রিল থেকে অগ্রীম টিকিট বিক্রি শুরু করে। ট্রেনে ঈদ যাত্রা শুরু হয় ২৭ এপ্রিল থেকে।

ঢাকা পোস্ট: আগামী ঈদে ঝামেলা এড়াতে কী কী পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছেন?

ফারহাত আহমেদ: সামনের কোরবানি ঈদে টিকেটের চাহিদা আরও বাড়বে। এবং এটার জন্য আমরা এখনই কাজ শুরু করে দিয়েছি। যেখানে যতটুকু ব্যবস্থা নেওয়ার, আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। যতটুকু ক্যাপাসিটি বাড়ানো দরকার, তার সব ব্যবস্থাই করা হচ্ছে। এই দিক থেকে এক বিন্দু ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। আর এটার জন্য আমাদের ডেভলপাররা অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন এখনও।

বাংলাদেশ রেলওয়েকে টিকিট বিক্রিতে সহায়তা করার জন্য এ বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি চুক্তিবদ্ধ হয় ‘সহজ-সিনেসিস-ভিনসেন জেভি’। এর আগে ১৪ বছর টিকিট বিক্রির কাজটি করেছে কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেমস লিমিটেড (সিএনএস)।

ঢাকা পোস্ট:'টিকিট প্রত্যাশীদের উদ্দেশে কী বলতে চান?

ফারহাত আহমেদ: আমরা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। তাই নিরাপদ যাত্রার জন্য মানুষ সরকারি বাহন ট্রেনে ভ্রমণ সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন। যার ফলে যাত্রায় সবার প্রথমে পছন্দ থাকে ট্রেনের। আমি টিকিট প্রত্যাশীদের বলব, ধৈর্য ধারণ করতে হবে। যে পরিমাণ টিকিট বরাদ্দ আছে, তার বাইরে আমরা টিকিট বিক্রি করতে পারি না। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ কম। রেলের টিকেট কত বিক্রি হবে সে সিদ্ধান্ত সহজ নেয় না, সহজ শুধুমাত্র টিকিট বিক্রিতে রেলওয়েকে সহযোগিতা করে। যদি এক মিনিটে সব টিকিট শেষ হয়ে যায় এটা সহজের দোষ না, এটা সহজে সক্ষমতা।

এমএইচএন/এনএফ