বছরজুড়ে রাজধানীতে ছিল মশার উপদ্রব। দিন নেই রাত নেই, ঘরে কিংবা বাইরে, বাসা কিংবা অফিস— সব জায়গাতে ছিল মশার তাণ্ডব। বছরের পুরো সময় মশার যন্ত্রণায় রীতিমতো অতিষ্ঠ নগরবাসী। শুধু রাত নয়, দিনেও কয়েল জ্বালিয়ে থাকতে হয়েছে। ওষুধ বা স্প্রে, কিছুতেই ঠেকানো যায়নি মশার উপদ্রব।

বর্ষাকালে জলাবদ্ধতা, শুষ্ক মৌসুমে ধুলার দুর্ভোগ, আর বছরজুড়ে যানজটের ভোগান্তি যেন নিত্যদিনের সঙ্গী। এসব ভোগান্তির সঙ্গে মশার উপদ্রবে রীতিমতো অতিষ্ঠ রাজধানীবাসী। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নানা উদ্যোগ, অভিযানসহ নিত্যনতুন কার্যপরিচালনা করেও হার মানতে হচ্ছে মশার কাছে। তাদের অত্যাচার থেকে নগরবাসীকে মুক্তি দিতে পারেনি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনও।

‘মশা মারতে কামান দাগা’ প্রবাদের প্রচলন রয়েছে মানুষের মুখে মুখে। প্রবাদটি পুরোপুরি বাস্তবে রূপ না দিলেও, কাছাকাছিই হেঁটেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। কামান না হলেও তারা মশার উৎপত্তিস্থল খুঁজতে আধুনিক প্রযুক্তির ড্রোন ব্যবহার করেছে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন যখন ড্রোন ব্যবহারের সার্বিক দিক নিয়ে আরও বিস্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছে, তখন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) মশা মারতে অভিনব এক পদ্ধতি ব্যবহারের উদ্যোগ নিয়েছিল। মশা মারতে খাল, নালা, ড্রেনসহ বিভিন্ন জলাশয়ে ব্যাঙ ছেড়েছিল সংস্থাটি।

ডিএসসিসি মনে করেছিল, জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য কাজে লাগিয়ে ব্যাঙগুলো পানিতে ভাসতে থাকা মশার লার্ভা খেয়ে ফেলবে। ফলে সেসব স্থানে মশা আর বংশবিস্তার করতে পারবে না। এছাড়া জিঙ্গেল বাজিয়েও মশা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে তারা। এমন নানা উদ্যোগ নিয়েও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নগরবাসীকে মশার অত্যাচার থেকে রক্ষা করতে পারেনি।

চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্তের পরিসংখ্যান

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৮ হাজার ৬২২ জন। এছাড়া ঢাকার বাইরে আক্রান্তের সংখ্যা ২২ হাজার ৬৪১ জন।

সার্বিক তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ঢাকাতেই ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেশি। এ বছরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সারাদেশে মারা গেছেন ২৭১ জন। যা এক বছরের মৃত্যুর হিসাবে রেকর্ড।

মশা মারার বাজেট ৭৬ কোটি, অভিযোগের তীরে বিদ্ধ ডিএনসিসি

মশা মারতে নানা অভিযান, পর্যাপ্ত কর্মসূচি, মশক নিধনকর্মীদের মনিটরিং, সপ্তাহ ও মাসব্যাপী বিভিন্ন সময় অভিযান পরিচালনা করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। পাশাপাশি বড় অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ করেও সুফল পায়নি সংস্থাটি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে ৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। সেখানে মশার ওষুধ-বাবদ ৪০ কোটি, কচুরিপানা, আগাছা পরিষ্কার ও পরিচর্যায় এক কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। ফগার, হুইল, স্প্রে মেশিন পরিবহনে চার কোটি, মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের বিশেষ কর্মসূচিতে এক কোটি, আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে ২৫ কোটি এবং মশক নিয়ন্ত্রণে চিরুনি অভিযানে চার কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখে ডিএনসিসি। সবমিলিয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে মশা মারতে ৭৬ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়। এরপরও কাজের কাজ না হওয়ায় বছর শেষে নগরবাসীর অভিযোগের তীর গিয়ে ঠেকেছে ডিএনসিসির দিকে।

দক্ষিণ সিটিতেও মোটা অঙ্কের মশা মারার বাজেট

উত্তরের মতো মশা নিয়ন্ত্রণে অভিযান, জরিমানা, মনিটরিং, সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। পাশাপাশি মশা নিধনে বড় অঙ্কের বাজেটও বরাদ্দ দিয়েছে সংস্থাটি। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে ২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয় মশক নিধনে ব্যবহৃত কীটনাশকে। ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে যা ছিল ২২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। পরে সংশোধিত বাজেটে তা ২২ কোটি ১২ লাখ টাকা করা হয়। এছাড়া মশক নিধনে ফগার, হুইল, স্প্রে মেশিনের জন্য বরাদ্দ রাখা হয় তিন কোটি ৭৫ লাখ টাকা।

মশা খুঁজতে ড্রোন দিয়ে চিরুনি অভিযান

চলতি বছরের জুলাই থেকে আধুনিক প্রযুক্তির ড্রোনের মাধ্যমে মশার উৎপত্তিস্থল খুঁজতে অভিযান পরিচালনা করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। ঢাকা উত্তরের অধীন প্রতিটি বাসাবাড়িতে অত্যাধুনিক ড্রোনের মাধ্যমে মশার উৎস খুঁজতে চিরুনি অভিযান পরিচালনা করা হয়। সিটি করপোরেশন ড্রোন থেকে ছবি ও তথ্য-উপাত্ত নিয়ে যেসব বাড়িতে মশার লার্ভা পাওয়া যায় তার একটি তথ্যভাণ্ডার তৈরি করে এবং বছরের অন্যান্য সময় মশক নিধন কার্যক্রমে এটি কাজে লাগায়।

এ বিষয়ে ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জোবায়দুর রহমান বলেন, আমাদের মশক নিধনকর্মীদের পক্ষে প্রতিটি বাড়ির ছাদে উঠে মশার উৎপত্তিস্থল চিহ্নিত করা কঠিন কাজ। অনেক বাসায় কর্মীদের ঢুকতে দেওয়া হয় না। এছাড়া অল্প-সংখ্যক লোকবল দিয়ে এ কাজ পরিচালনা করাও প্রায় অসম্ভব। যে কারণে একটি উঁচু ভবনে উঠে যখন আমরা ড্রোন উড়াচ্ছি, তখন আশপাশের শত শত বাড়ি কিন্তু আমরা এক ঘণ্টার মধ্যে দেখে ফেলতে পারছি। এতে যেমন কাজ সহজ হয়েছে, তেমনি দ্রুততার সঙ্গে মশার উৎপত্তিস্থল ছাদও কিন্তু আমরা চিহ্নিত করে ফেলছি।

মশক নিধন কার্যক্রম বেগবান করতে ডিএনসিসি আধুনিক প্রযুক্তির ড্রোন ব্যবহার করছে বলেও উল্লেখ করেন এ কর্মকর্তা।

জিঙ্গেল বাজিয়ে মশক নিধন কার্যক্রম

চলতি বছর মশার ওষুধ ছিটানোর সঙ্গে সঙ্গে জিঙ্গেল (সচেতনমূলক গান) বাজিয়ে মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এ অঞ্চলের প্রতি এলাকায় দুজন করে মশক নিধনকর্মী ওষুধ ছিটিয়ে যাচ্ছেন। তাদের পাশাপাশি আরেকজন হ্যান্ড মাইকে জিঙ্গেল বাজাচ্ছেন। সেখানে মূলত সচেতনতামূলক গান বাজতে থাকবে। মশক নিয়ন্ত্রণে নগরবাসীর করণীয় এবং তাদের সচেতনতার বার্তা প্রচার করা হচ্ছে।

অভিযানসহ অন্যান্য কার্যক্রমের পাশাপাশি গান বাজিয়েও জিঙ্গেল পদ্ধতিতে মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করেছে ডিএসসিসি।

এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মুখপাত্র আবু নাছের জানান, জনসচেতনতাই মূলত ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে মূলত জিঙ্গেলটা করা হয়েছে। এতে মানুষ আরও সচেতন হয়েছে, বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে পেরেছে। অভিযান, মশক নিধনে ওষুধ ছিটানোর পাশাপাশি এই ধরনের জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম ডিএসসিসি গ্রহণ করেছে।

মশা নিয়ন্ত্রণে দুই সিটি করপোরেশনের সর্বশেষ পদক্ষেপ

মশা নিয়ন্ত্রণে বছরজুড়ে অভিযান পরিচালনা অব্যাহত রেখেছে ঢাকা দক্ষিণ সিট করপোরেশন (ডিএসসিসি)। সংশ্লিষ্টরা বলছে, এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মশক নিধন কার্যক্রম-বিষয়ক অভিযান পরিচালিত হয়েছে। বর্তমানে মশার উপদ্রব অনেকটা কমেছে। তবুও মশার ওষুধ ছিটানোসহ অন্যান্য কার্যক্রম তারা নিয়মিত পরিচালনা করছে। পাশাপাশি প্রতিটি ওয়ার্ডে জনসচেতনতা চালিয়ে যাচ্ছে তারা।

তাদের মতে, চলতি ডিসেম্বর মাসে ডিএসসিসি এলাকায় ৪/৫ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। তবে দক্ষিণ সিটি এলাকার ডেমরা, নাসিরাবাদ, কদমতলী, জুরাইন, শ্যামপুর এলাকায় মশার উপদ্রব এখনও বেশি। এসব এলাকায় মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সংস্থাটি।

অন্যদিকে, বছরজুড়ে মশা নিয়ন্ত্রণে না থাকায় নাগরিকদের ক্ষোভের মুখে পড়তে হয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনকে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বছরজুড়ে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালিত হলেও বর্তমানে কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে মাঠে নেমেছে সংস্থাটি। সর্বশেষ ডিএনসিসি জানতে পারে যে তাদের ১, ১৭, ৪৯, ৫০ ও ৫২ নম্বর ওয়ার্ডে মশার উপদ্রব বেশি। যে কারণে ১৫ দিনের ক্র্যাশ প্রোগ্রাম হাতে নিয়ে মাঠে নেমেছে তারা। এছাড়া সব খাল, ডোবা, জলাশয় পরিষ্কার করতে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম। এরপর থেকে সেগুলো পরিচ্ছন্নতার কাজ শুরু করেছে সংস্থাটি।

মশক নিধন কার্যক্রমের বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৩নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর এনামুল হক বলেন, আমাদের কার্যক্রম থেমে নেই। আমরা নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছি। তবে যেসব এলাকায় মশা বেশি সেগুলোতে আমাদের বিশেষ অভিযানসহ মশক নিয়ন্ত্রণে সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনা করছি।

অন্যদিকে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১৮নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর জাকির হোসেন বলেন, সকাল-বিকেল মশক নিধনের ওষুধ ছেটাচ্ছেন কর্মীরা। মশার নিয়ন্ত্রণে ডিএনসিসি কিছুদিন আগে সবার ছুটিও বাতিল করে। সেই সঙ্গে নাগরিকদের সচেতন করতে আমরাও নিয়মিত মাঠে ছিলাম। মশক নিয়ন্ত্রণে এখনও নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে ডিএনসিসি।

এএসএস/এমএআর/