এ বছর প্রকাশিত ষষ্ঠ শ্রেণির শিল্প ও সংস্কৃতি বইটি রচনা করেছেন নয়জন লেখক। সম্পাদনা করেছেন দুজন। মোট ১১ জনের এ তালিকায় যারা আছেন সবাই নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষক এবং ভালো লেখক ও গবেষক। কিন্তু এ বিশাল লেখক গোষ্ঠীর শ্রমে যে বই বের হলো তাতে ঠাঁই পেয়েছে চুরি বা প্লেজারিজমের মাধ্যমে কপি করা লেখা।

পাঠ্যপুস্তক নিয়ে বিতর্ক যেন কোনোভাবেই পিছু ছাড়ছে না। সপ্তম শ্রেণির একটি বই নিয়ে চলমান বিতর্কের মধ্যেই এবার জানা গেল ষষ্ঠ শ্রেণির একটি বইয়ে প্রবন্ধ লেখা হয়েছে অন্যের লেখা হুবহু চুরি বা কপি করে। যাকে ইংরেজিতে বলে প্লেজারিজম। চৌর্যবৃত্তির মাধ্যমে যে প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে তাও আবার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লেখা।

পাঠ্যপুস্তক নিয়ে বিতর্ক যেন কোনোভাবেই পিছু ছাড়ছে না। সপ্তম শ্রেণির একটি বই নিয়ে চলমান বিতর্কের মধ্যেই এবার জানা গেল ষষ্ঠ শ্রেণির একটি বইয়ে প্রবন্ধ লেখা হয়েছে অন্যের লেখা হুবহু চুরি বা কপি করে। যাকে ইংরেজিতে বলে প্লেজারিজম। চৌর্যবৃত্তির মাধ্যমে যে প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে তাও আবার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লেখা

বৃহস্পতিবার (২ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে এমন অভিযোগ এনেছেন স্বয়ং মূল লেখার লেখক নাসরুল্লাহ শাকুরি। তিনি ঢাকা কলেজের বাংলা বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থী। ব্যক্তিগত আগ্রহে তিনি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গবেষণা করেন।

>> পাঠ্যবইয়ে কপি : স্বীকার করে জাফর ইকবাল ও হাসিনা খানের বিবৃতি

শাকুরি জানান, ২০২০ সালের ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ‘টুঙ্গিপাড়ার সেই ছেলেটি’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। যা অনলাইন সংবাদ মাধ্যম পূর্বপশ্চিমে প্রকাশিত হয়। সেই লেখাটি কিছুটা সম্পাদনা করে একই শিরোনামে ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠ্যবই ‘শিল্প ও সংস্কৃতি’-তে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বইটির সম্পাদনায় ছিলেন অধ্যাপক নিসার হোসেন ও মঞ্জুর আহমদ। আর রচনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মঞ্জুর আহমদ, তানজিল ফাতেমা, ড. মো. কামাল উদ্দিন খান, শেখ নিশাত নাজমী, কামরুল হাসান ফেরদৌস, মো. রেজওয়ানুল হক, মুহাম্মদ রাশীদুল হাসান শরীফ, তানজিনা খানম ও সুলতানা সাদেক।

ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থী নাসরুল্লাহ শাকুরির দাবির সত্যতা মিলেছে ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানে।

দেখা গেছে, ২০২০ সালের ১৫ আগস্ট প্রকাশিত শাকুরির প্রবন্ধ ‘টুঙ্গিপাড়ার সেই ছেলেটি’ এবং ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের ষষ্ঠ শ্রেণির ‘শিল্প ও সংস্কৃতি’ বইয়ের ৫৮ নম্বর পৃষ্ঠায় প্রকাশিত ‘টুঙ্গিপাড়ার সেই ছেলেটি’ প্রায় একই রকম তথ্য ও গল্পনির্ভর। পাঠ্যবইয়ে স্থান পাওয়া প্রবন্ধে শিরোনামসহ শাকুরির প্রবন্ধ থেকে অনেকগুলো বাক্য হুবহু কপি বা চুরি করা হয়েছে।

যেমন, শাকুরির প্রবন্ধে প্রথম বাক্য ছিল ‘খরস্রোতা মধুমতি নদী’। পাঠ্যবইয়ের প্রবন্ধে প্রথম বাক্য লেখা হয়েছে ‘নদীর নাম মধুমতি’। শাকুরির লেখার দ্বিতীয় বাক্য ‘এই নদীতে আগে বড় বড় পাল তোলা নৌকা চলত’ হুবহু কপি করা হয়েছে। এরপর শাকুরির তৃতীয় বাক্য ‘চলত লঞ্চ স্টিমারও’ বাদ দিয়ে চতুর্থ বাক্য থেকে আবার কপি করা হয়েছে। চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম বাক্য টানা হুবহু কপি করা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু একটা বাক্যে ‘পেরিয়ে’র জায়গায় ‘পার করে’ লেখা হয়েছে এবং আরেকটা বাক্যে ‘টগবগে যুবক’ শব্দ দুটি বাদ দেওয়া হয়েছে।

এভাবে কপি করা লেখা দিয়ে প্রথম অনুচ্ছেদ শেষ করা হয়েছে। শেষে লেখা হয়েছে- ‘আজকে আমরা সেই খোকার গল্প শুনবো’।

>> ‘সংকটেও’ এনসিটিবির বই খোলাবাজারে

এরপর দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ থেকে যে গল্প বলা হয়েছে তাও প্রায় পুরোটাই নাসরুল্লাহ শাকুরির প্রবন্ধ থেকে কপি করা। শুধু একটা বাক্যে ‘একবার’ শব্দের জায়গায় ‘একদিন’ এবং আরেকটা বাক্যে ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দের জায়গায় ‘খোকা’ লেখা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থী নাসরুল্লাহ শাকুরি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘একজন লেখকের লেখা পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হওয়া তার জন্য অত্যন্ত সম্মানের ও গৌরবের। কিন্তু দুঃখজনক হলো, আমার লেখাটি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে সেটি আমাকে জানানোও হয়নি। বইয়ের রচয়িতাদের তালিকায় আমার নাম নেই। এটা পুরোটাই একটা প্লেজারিজম বা চৌর্যবৃত্তি হয়েছে।’

শাকুরির প্রবন্ধে প্রথম বাক্য ছিল ‘খরস্রোতা মধুমতি নদী’। পাঠ্যবইয়ের প্রবন্ধে প্রথম বাক্য লেখা হয়েছে ‘নদীর নাম মধুমতি’। শাকুরির লেখার দ্বিতীয় বাক্য ‘এই নদীতে আগে বড় বড় পাল তোলা নৌকা চলত’ হুবহু কপি করা হয়েছে। এরপর শাকুরির তৃতীয় বাক্য ‘চলত লঞ্চ স্টিমারও’ বাদ দিয়ে চতুর্থ বাক্য থেকে আবার কপি করা হয়েছে। চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম বাক্য টানা হুবহু কপি করা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু একটা বাক্যে ‘পেরিয়ে’র জায়গায় ‘পার করে’ লেখা হয়েছে এবং আরেকটা বাক্যে ‘টগবগে যুবক’ শব্দ দুটি বাদ দেওয়া হয়েছে

তিনি আরও বলেন, ‘লেখালেখি একটা শিল্প। এ শিল্পের শিল্পীকে মূল্যায়ন করতে হবে। লেখককে তার প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত করা উচিত নয়। এতে লেখক উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন।’

এ ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন অনেকে। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সমালোচনা হচ্ছে।

রিমন শিকদার নামের এক ব্যক্তি ফেসবুকে লিখেছেন, “নাসরুল্লাহ শাকুরি ২০২০ সালের ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে পূর্বপশ্চিম নামক একটি অনলাইন পত্রিকায় ‘টুঙ্গিপাড়ার সেই ছেলেটি’ শিরোনামে একটি অত্যন্ত চমকপ্রদ লেখা আমাদের উপহার দেয়। ব্যক্তিগতভাবে আমি ওর লেখা পড়ে আনন্দিত হয়েছিলাম। কারণ, সে হৃদয়ে বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করেই লেখাটি লিখেছিল। কিন্তু ষষ্ঠ শ্রেণির বইয়ে তার লেখাটি নিয়েছে ঠিকই, তাকে জানায়নি, ক্রেডিটও দেয়নি। এ অন্যায়ের নিন্দা জানাচ্ছি।’

এ বিষয়ে জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. ফরহাদুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘জাতীয় পর্যায়ে দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত করে তারা যে রিপোর্ট দেবেন সেটির আলোকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

পাঠ্যবইয়ের ভুল সংশোধনের জন্য গঠিত দুটি তদন্ত কমিটির একটির প্রধান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. আব্দুল হালিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এমন ঘটনা কখনোই কাম্য নয়। বিষয়টি দুঃখজনক। যদি প্রয়োজনীয় লেখা কপি করতে হয় তবে সেখানে উল্লেখ করতে হবে যে আমি অমুক লেখকের লেখাটি এখানে উল্লেখ করেছি। অথবা লেখাটি যদি হুবহু নেওয়া হয়ে থাকে তবে মূল লেখকের নামেই সেটি প্রকাশিত হবে। বিষয়গুলো আমরা খতিয়ে দেখছি।’

>> পাঠ্য বইয়ের ভুল নিয়ে যা বললেন শিক্ষামন্ত্রী

প্রবন্ধটিতে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগের বিষয়টি স্বীকার করেছেন ষষ্ঠ শ্রেণির শিল্প ও সংস্কৃতি বইয়ের সম্পাদক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেনও। তিনি বলেন, লেখাটির মধ্যে প্লেজারিজম রয়েছে। আসলে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা এত বেশি পরিমাণে রয়েছে যে বিখ্যাত লেখকদের লেখাগুলোই আমরা ঠিক করে দিয়েছিলাম। পরে এসব লেখা (প্রবন্ধটি) সময়ের অভাবে পুনরায় যাচাই করে দেখা সম্ভব হয়নি।

তিনি আরও বলেন, এরকম ঘটনা আরও বের হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ধরনের কাজ কখনোই কাম্য নয়। কেননা, এসব বিষয়ে আমরা লেখকদের আগেই ওয়ার্কশপ করিয়েছি। 

যাদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠছে তাদের শুধু বই থেকে বাদ দেওয়াই নয় বরং শাস্তিমূলক কী কী ব্যবস্থা নেওয়া যায় সেটিও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানান তিনি।

আরএইচটি/এসএসএইচ/জেএস/ওএফ