বিএনপি কিংবা আওয়ামী লীগ, কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নই। কিন্তু সব দলের সঙ্গে আমার সম্পর্ক আছে। একজন নাগরিক হিসেবে সব দলের নেতৃত্ব নিয়ে সমালোচনা করার অধিকার আমার আছে— কথাগুলো বলেছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।

এক সময় ‘বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবী’ হিসেবে মনে করা হলেও দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব নিয়ে কঠোর সমালোচনা করেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। বলেন, ‘বিএনপির বর্তমান নেতৃত্ব নিয়ে আমি কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। তাদের নতুন, ইয়াং নেতৃত্ব দরকার।’ কথা বলেন জাতীয় সরকার ব্যবস্থা নিয়েও।

গত ১১ এপ্রিল রাত ১১টায় রাজধানীর ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। মৃত্যুর কিছু দিন আগে ঢাকা পোস্টের নিজস্ব প্রতিবেদক আদিত্য রিমনকে সাক্ষাৎকারটি দেন সারা জীবন উল্টো ধারায় চলা মানুষটি। নিচে তা উপস্থাপিত হলো-

ঢাকা পোস্ট : বিরোধী দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করছে। কিন্তু আপনি নির্বাচনের আগে জাতীয় সরকারের কথা বলছেন। এটা করতে গেলে আমাদের বর্তমান সংবিধান সংশোধন করার প্রয়োজন আছে কি না?

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী : সংবিধান সংশোধন তো খুব বেশি কঠিন কাজ নয়। সরকার ইসি (নির্বাচন কমিশন) গঠনের কিছুদিন আগেও বলেছিল, এত অল্প সময়ে নির্বাচন কমিশন আইন তৈরি করা সম্ভব নয়। তারপরও তারা আইন নিয়ে হাজির হয়েছে। আজ সরকার ভয় পাচ্ছে, তারা এত অন্যায় আচরণ করছে, তাই মনে করছে নির্বাচনে হারলে কপালে দুঃখ আছে। সেটার জন্যই আমি মনে করি, জাতীয় সরকার থাকলে এ রকমের পাল্টাপাল্টি… হবে না। আওয়ামী লীগও জাতীয় সরকারের অংশীদার হবে। তবে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে হবে। সেটা করলে আজ তাদের যে চালাকির সরকার, সেটা হবে না।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে সম্মাননা ক্রেস্ট তুলে দিচ্ছেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। (ছবি : সংগৃহীত)

পরিচ্ছন্ন খোলামেলা কথাবার্তা থাকতে হবে। জাতীয় সরকার আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনার কারা হবেন, তা জনগণের কাছ থেকে মতামত নিয়ে করবেন। লুকোচুরি করে কিছু করা যাবে না। এসব কারণে আমি মনে করি, জাতীয় সরকারের প্রয়োজন আছে। এজন্য তো সংবিধান কিছুটা সংশোধন করতে হবে। বদলাতে হবে।

ঢাকা পোস্ট : প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হলে জাতীয় সরকারের প্রধান কে হবেন?

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী : সেটা খুঁজে বের করতে হবে। সারাদেশে কি এমন একজন লোক পাওয়া যাবে না?

ঢাকা পোস্ট : খুঁজে বের করার দায়িত্ব কে নেবেন বা কোন প্রক্রিয়ায় এটা করা হবে? তাছাড়া রাজনৈতিক দলগুলো তো একজন-আরেকজনকে বিশ্বাস করে না…

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী : যখন জাতীয় সরকার নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু হবে, তখন সিদ্ধান্ত হবে যে কীভাবে এ সরকারের প্রধান নির্বাচিত হবেন বা খুঁজে বের করার প্রক্রিয়া কী হবে? তাছাড়া রাজনৈতিক দলগুলো এখন কেউ-কাউকে বিশ্বাস করছে না। কিন্তু যখন দেখবে একটা স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় হচ্ছে, তখন সবাই-সবাইকে বিশ্বাস করবে।

ঢাকা পোস্ট : আপনার দৃষ্টিতে জাতীয় সরকারের প্রধান কে হতে পারেন?

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী : আমার মতে ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতীয় সরকারের প্রধান হতে পারেন। সেটা হয়তো আওয়ামী লীগের কাছে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। তাছাড়া অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান আছেন। তারা না হলে কাউকে না কাউকে তো পাওয়া যাবে।

গত ২৬ মার্চ বিকেলে বঙ্গভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কুশল বিনিময়ে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ছবি: গণস্বাস্থ্য

ঢাকা পোস্ট : জাতীয় সরকারের কাজ কী হবে?

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী : তাদের কাজ হবে একটা সুষ্ঠু প্রশাসন গড়ে তোলা। সুষ্ঠু শাসন ব্যবস্থা প্রয়োগ করা। আজ দেশে সুশাসন নেই, দেশে দারিদ্র্যের হার বেড়েছে। দুই কোটি লোককে খাদ্যের নিরাপত্তা দেওয়া, স্বাস্থ্যের নিরাপত্তা দেওয়া, এটা কোনো কঠিন কাজ নয়। ইচ্ছা থাকলেই এসব পরিবর্তন করা যাবে। বেকারদের কর্মসংস্থান করা, একটা সুষ্ঠু নির্বাচন করা। তখন জনগণ যদি আবার আওয়ামী লীগকে চায়, তারা ক্ষমতায় থাকবে। অন্য কাউকে চাইলে তারা ক্ষমতায় আসবে।

আজ প্রায় এক কোটি লোক বিদেশে কাজ করছেন। এর মধ্যে প্রায় ২০ লাখ লোকের পাসপোর্টে সমস্যা আছে। কিন্তু এটা নিয়ে পাসপোর্ট অধিদপ্তর কোনো কাজ করছে না। অথচ বলে রোল মডেল। একবার আমি ও আমার স্ত্রী প্যারিসে গিয়েছিলাম। এয়ারপোর্টে আমার স্ত্রীর পাসপোর্ট চুরি হয়ে যায়। আবার সেদিন ছিল ঈদ। আমি আমার স্ত্রীকে বললাম, আমি হাই-কমিশনে যাই। তিনি বললেন, মাথা খারাপ নাকি। বললাম, ঈদের দিন হলেও একটা লোক তো থাকবে। গিয়ে এক দারোয়ানকে পেলাম। তাকে বললাম, তোমার অ্যাম্বাসেডরের নম্বরটা দাও। কাহিনি ছোট করার জন্য বলি, আধা ঘণ্টার মধ্যে পাসপোর্ট করে দিয়েছে। পাসপোর্ট পেলাম, কিন্তু নতুনটাতে ভিসা নেই। আমার স্ত্রী একটা কাজে সুইডেন যাবে। তার হারিয়ে যাওয়া পাসপোর্টে সুইডিস ভিসা ছিল। এরপর সুইডিস অ্যাম্বাসিতে গেলাম। তারা বলল, তোমার তো পাসপোর্ট নেই। আমি বললাম আছে। তখন তারা জিজ্ঞাসা করল, নতুন পাসপোর্ট করতে কতক্ষণ লেগেছে। আমি বললাম, আধা ঘণ্টায় পাসপোর্ট করে দিয়েছে। তখন তারা আমাকে বলল, হোয়াট! আর ইউ জোকিং? তাহলে ভিসা দিতে আমারও আধা ঘণ্টা লাগবে।

আজ আমাদের বিদেশের হাই-কমিশনগুলো প্রবাসীদের ঘুরাতে ঘুরাতে এক থেকে দুই বছরে নিয়ে যায়। এটাকে কি আমরা রোল মডেল বলব? প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমরা নাকি রোল মডেল হয়ে গেছি। একটা কথা আছে, রোম যখন পুড়ছিল, নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল। আজ প্রতিদিনই মানুষ খুন হচ্ছে, স্বামী স্ত্রীকে খুন করছে, ছেলে মাকে খুন করছে। প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ৪০ থেকে ৫০ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করছে। এটা কি পৃথিবীর রোল মডেল? এই কথাগুলো প্রধানমন্ত্রীর কাছে যায় না। কারণ, তিনি জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ৪১ সাল পর্যন্ত উন্নয়নের কথা বলতে হবে। আইয়ুব খান যখন উন্নয়নের রোল মডেলে ছিল, তার কয়েক মাসের মাথায় তার পতন হয়েছিল। এজন্য আমি বলি, সরকারের এসব হাস্যকর কথা বলার কোনো মানে হয় না।

বেগম খালেদা জিয়া (বাঁয়ে) ও ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী (ডানে) 

ঢাকা পোস্ট : একটু জানতে চাই, আপনার এই জাতীয় সরকারের ফর্মুলা নিয়ে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে কি না?

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী : কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা হয়নি, জনগণের সঙ্গেও আলোচনা হয়নি।

ঢাকা পোস্ট : কয়েক মাস আগে আপনি বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে সমালোচনা করেছেন। তারা এখন তাদের কোনো অনুষ্ঠানে আপনাকে দাওয়াত করে না। কিন্তু নিকট অতীতে আপনাকে অনেকে বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবী বলেও দাবি করতেন…

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী : বিএনপির সঙ্গে আমার সম্পর্ক নেই। আমি তাদের কেউ না। আমাকে নিয়ে আপনারা, সাংবাদিকরা একটা মিথ্যাচার করেন। সুসম্পর্ক আমার সবার সঙ্গেই আছে। আমি যেহেতু সত্য কথা বলি, আমি তো তাদের শেখানো বুলি বলব না। যখন আমি বলেছি, বিএনপির আজ এই সুযোগ নেওয়ার মুরোদ নাই, তারেক রহমান দেশে নাই, খালেদা জিয়া অসুস্থ, তাদের স্থায়ী কমিটির অধিকাংশ সদস্যই বয়োবৃদ্ধ। তাদের নিয়ে তো কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারছে না।

একজন নাগরিক হিসেবে আমার সব দলের নেতৃত্ব নিয়ে সমালোচনা করার অধিকার আছে। আমি আওয়ামী লীগও করি না। কিন্তু তাদের ভুলভ্রান্তি নিয়ে সমালোচনা করার অধিকার কি আমার নাই? আজ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকে বলছি, তোমাদেরও একটা সম্মিলিত চেষ্টা থাকতে হবে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চেষ্টাতে কিছু হবে না। এখনও বলছি, বিএনপি যদি তারেকের মেয়েকে দেশে পাঠায়, সে এখনও তরুণ; তাহলে দেশে আন্দোলন সৃষ্টি করা সহজ হবে।

ঢাকা পোস্ট : তার মানে আপনি বিএনপির বর্তমান নেতৃত্ব নিয়ে কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না?

ডা.  জাফরুল্লাহ চৌধুরী : বিএনপির বর্তমান নেতৃত্ব নিয়ে আমি কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। তাদের নতুন, ইয়াং নেতৃত্ব দরকার। তাই বলে আমি এটা বলছি না যে তারেক রহমানের মেয়ে কাল এসেই দলের প্রেসিডেন্ট হয়ে যাবে। সে এখন শিখবে, জনগণের কথা শুনবে। জনগণ এখন বিএনপির কার সঙ্গে কথা বলবে, কার সঙ্গে তাদের সুখ-দুঃখ, তাদের পরামর্শ ও সুপারিশ জানাবে?

ঢাকা পোস্ট : কেন, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামসহ অন্যান্য নেতারা আছেন না?

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী : মির্জা ফখরুল তো ভদ্রজন, অসুস্থ ব্যক্তি। এত বড় দেশে তিনি কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারেন না। তাকে তারেকের (তারেক রহমান) সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়।

গত বছরের জুলাইয়ে জাতীয় প্রেস ক্লাবে একটি অনুষ্ঠানে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী (ছবি : সংগৃহীত)

ঢাকা পোস্ট : এই সমস্যা তো আমাদের প্রায় সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে আছে…

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী : সে জন্যই তো কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। তার জন্য দরকার তরুণ নেতৃত্ব।

ঢাকা পোস্ট : গত সংসদ নির্বাচনের (একাদশ) আগে আপনার প্রচেষ্টায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন হয়েছিল। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে সে রকম কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন কি না?

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী : এবার আমার কোনো পরিকল্পনা নাই। এটা প্রতিবারই আমাকে করতে হবে, সে রকম কোনো কথাও নাই। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে উদ্যোগ নিতে হবে।

এএইচআর/এমএআর/