সেকশন অফিসার পদে নিয়োগে ‘অদ্ভুত ও বাজে’ উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আব্দুস সাত্তার। বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সহকারী পরিচালক’ (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) পদে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হলেও নিয়োগ দেওয়া হয় ‘সেকশন অফিসার’ পদে। অথচ বিজ্ঞপ্তির কোথাও ওই পদের তথ্য উল্লেখ করা ছিল না। এমনকি ওই পদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) অনুমতিও নেওয়া হয়নি।

অবাক করা তথ্য হলো পছন্দের প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে বিভিন্ন কৌশল ও অনিয়মের আশ্রয় নিয়েছেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য। নিয়োগপ্রাপ্ত আব্দুর রউফ পরে সেকশন অফিসার থেকে উপপরিচালক হন। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রাথমিক অনুসন্ধানে অনিয়মের বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে।

বিজ্ঞপ্তির শর্তানুযায়ী পরিকল্পনা ও উন্নয়ন কর্মকর্তা হিসেবে আব্দুর রউফের কোনো পূর্ব-অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও বাছাই বোর্ড অবৈধভাবে তাকে প্রথমে সহকারী পরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়া চেষ্টা করে। পরে অভিজ্ঞতার ঘাটতি থাকার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সেকশন অফিসার (গ্রেড-১, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) পদে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়। রিজেন্ট বোর্ড সভাপতি হিসেবে সাবেক উপাচার্য আব্দুস সাত্তার উন্মুক্ত বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই তাকে সেকশন অফিসার হিসেবে নিয়োগের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন

আরও পড়ুন >> এমপি সোহেলের জমি দখল ও দুর্নীতি, অনুসন্ধানে দুদক

দুদক সূত্র জানায়, আব্দুর রউফ অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন। এ কারণে কর্মরত অবস্থায় তার পদোন্নতি ও সিলেকশন গ্রেডসহ বেতন-ভাতাবাবদ প্রায় সাড়ে ৬১ লাখ টাকা উত্তোলন অবৈধ এবং সমুদয় অর্থ আত্মসাৎ হিসেবে বিবেচিত হবে। এমন অপরাধের প্রধান হোতা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আব্দুস সাত্তার। যে কারণে তাদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি ৪০৯/১০৯ ধারাসহ ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারায় মামলার অনুমোদন দিয়েছে দুদক কমিশন।

শিগগিরই তাদের আসামি করে মামলা দায়ের করতে যাচ্ছেন দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা উপপরিচালক মো. আল-আমিন। দুদকের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র ঢাকা পোস্টকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আব্দুস সাত্তার / ছবি- সংগৃহীত

আরও পড়ুন >> ৫৮২ কোটি টাকার সার লুটপাট, দুদকের জালে সাবেক এমপি পোটন

এ বিষয়ে দুদকের সমন্বিত যশোর কার্যালয়ের উপপরিচালক আল-আমিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘কমিশনে মামলার সুপারিশ করে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। এর পরের সিদ্ধান্ত আমার জানা নেই।’

অন্যদিকে, অনুমোদিত মামলার প্রধান আসামি ও সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আব্দুস সাত্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও নিয়োগবিধি অনুসরণ করেই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। রিজেন্ট বোর্ডের সভাপতি হিসেবে এ নিয়োগে বৈধ ক্ষমতা আমার ছিল। এখানে কোনো অনিয়ম হয়নি। যাকে আমি নিয়োগ দিয়েছি তিনি আমার পূর্বপরিচিত কিংবা কোনো আত্মীয় নন।’

আরও পড়ুন >> রানার গ্রুপ : কোম্পানি সেক্রেটারি মিজানুরের সম্পদ কত?

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, এ বিষয়ে ব্যক্তিগত শুনানির জন্য আমি দুদক চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করেছি। আগামী রোববার আমাকে দুদক সময় দিয়েছে। সেখানে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও বিধিসহ নিয়োগ সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র উপস্থাপন করব। আশা করি আমি ন্যায়বিচার পাব।

বিশ্ববিদ্যালয় ও দুদক সূত্রে জানা যায়, ২০০৯ সালের ২৩ এপ্রিল আব্দুর রউফ যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী সহকারী পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) পদে আবেদন করেন। নিয়োগের জন্য গঠিত তিন সদস্য বিশিষ্ট বাছাই বোর্ডের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন উপাচার্য ড. মো. আব্দুস সাত্তার। ওই বছরের ২২ আগস্ট মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয়। ওই সময় আরও তিন প্রার্থীর মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয়। কিন্তু কাউকে পাস করানো হয়নি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও নিয়োগবিধি অনুসরণ করেই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে— অধ্যাপক আব্দুস সাত্তার / ছবি- সংগৃহীত

আরও পড়ুন >> দুবাইয়ে বাংলাদেশিদের ৯৭২ প্রপার্টি, তালিকায় আছেন আরাভ খানও

অন্যদিকে, বিজ্ঞপ্তির শর্তানুযায়ী পরিকল্পনা ও উন্নয়ন কর্মকর্তা হিসেবে আব্দুর রউফের কোনো পূর্ব-অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও বাছাই বোর্ড অবৈধভাবে তাকে প্রথমে সহকারী পরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়া চেষ্টা করে। পরে অভিজ্ঞতার ঘাটতি থাকার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সেকশন অফিসার (গ্রেড-১, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) পদে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়। রিজেন্ট বোর্ড সভাপতি হিসেবে সাবেক উপাচার্য আব্দুস সাত্তার উন্মুক্ত বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই তাকে সেকশন অফিসার হিসেবে নিয়োগের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

আরও পড়ুন >> সালাম মুর্শেদীর সম্পত্তি দখল : নথি দিতে মন্ত্রণালয়ের গড়িমসি!

এ বিষয়ে দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইন- ২০০১ এর ৩২ ধারা লঙ্ঘন করে অধ্যাপক ড. মো. আব্দুস সাত্তার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহী হয়ে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে আব্দুর রউফকে অবৈধভাবে সেকশন অফিসার (গ্রেড- ১, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) হিসেবে নিয়োগ দেন। কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিকতা বা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে অত্যন্ত অদ্ভুত ও বাজেভাবে উন্মুক্ত বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই ইউজিসির নির্দেশনা লঙ্ঘন করেন উপাচার্য।

প্রসঙ্গত, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইন- ২০০১ এর ৩২ ধারায় বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তা নিয়োগে সুপারিশ করার জন্য এক বা একাধিক বাছাই বোর্ড থাকবে। বাছাই বোর্ড গঠন ও কার্যাবলি সংবিধি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। বাছাই বোর্ডের সুপারিশের সঙ্গে রিজেন্ট বোর্ড একমত না হলে বিষয়টি চ্যান্সেলরের নিকট প্রেরণ করতে হবে। এ বিষয়ে তাহার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হবে। এ নিয়োগের প্রতিটি ধাপে নিয়োগ নীতিমালার শর্ত লঙ্ঘিত হয়েছে বলে দুদক মনে করে।

অধ্যাপক আব্দুস সাত্তার ও আব্দুর রউফের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি ৪০৯/১০৯ ধারাসহ দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারায় মামলা রুজুর সুপারিশ করেছে দুদক / ফাইল ছবি

আরও পড়ুন >> সার্ভেয়ারের চাকরি নাকি সম্পদ গড়ার পরশ পাথর!

অনুসন্ধান প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, আব্দুর রউফ সেকশন অফিসার পদে অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে কর্মরত থাকা অবস্থায় সিলেকশন গ্রেডসহ বিভিন্ন সুবিধাপ্রাপ্ত হয়ে বিভাগীয় প্রার্থীর সুবিধা নিয়ে ২০১৪ সালে সহকারী পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) পদে এবং ২০২১ সালে উপপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে অদ্যাবধি উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত আছেন। ২০০৯ সালের অক্টোবর হতে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত তার বেতন-ভাতাবাবদ মোট ৬১ লাখ ৩১ হাজার ৭৩২ টাকা গ্রহণপূর্বক আত্মসাতের বিষয়টি অনুসন্ধানকালে প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

তাদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি ৪০৯/১০৯ ধারাসহ ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারায় একটি নিয়মিত মামলা রুজুর সুপারিশ করেন অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা। ওই সুপারিশ বিবেচনায় নিয়ে অধ্যাপক ড. মো. আব্দুস সাত্তার ও মো. আব্দুর রউফকে আসামি করে মামলার অনুমোদন দেয় কমিশন

আরও পড়ুন >> এমপি গোলাপের ৯ বাড়ির খোঁজে যুক্তরাষ্ট্রে এমএলএআর

তাদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি ৪০৯/১০৯ ধারাসহ ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারায় একটি নিয়মিত মামলা রুজুর সুপারিশ করেন অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা। ওই সুপারিশ বিবেচনায় নিয়ে অধ্যাপক ড. মো. আব্দুস সাত্তার ও মো. আব্দুর রউফকে আসামি করে মামলার অনুমোদন দেয় কমিশন।

আরএম/এমএআর/