পেশায় তিনি গৃহিণী। আয় বলতে নেই স্বীকৃত কোনো উৎস। তারপরও রাজধানীর শান্তিনগরে প্রায় আড়াই হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট, বাড্ডায় আড়াই কাঠা ও সোয়া কাঠার প্লট, নেত্রকোনায় ২৯ শতাংশ জমি এবং কক্সবাজারে সায়মন বিচ রিসোর্টে ফ্ল্যাট। এছাড়া রয়েছে বিভিন্ন ব্যাংকে কোটি টাকার বেশি সঞ্চয়।

কোটি কোটি টাকার এসব সম্পদের মালিক শরীফা বেগম (মনি)। গৃহিণী হয়েও আলাদিনের চেরাগে আলোকিত তিনি! স্বামী যে পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মোখলেসুর রহমান। বর্তমান কর্মস্থল রাজশাহীর সারদা পুলিশ একাডেমি।

দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে ওই সম্পদের মূল্য ঘোষণা দেওয়া হয়েছে দুই কোটি ৫৫ লাখ ৯৪ হাজার ৬২ টাকা। যদিও বাস্তবে এসব সম্পদের মূল্য কয়েকগুণ বেশি। দালিলিক নথিপত্রের হিসাবেই দুদকের অনুসন্ধানে ওই সম্পদের মূল্য পাওয়া গেছে তিন কোটি সাত লাখ নয় হাজার ৮০৬ টাকা। স্থাবর সম্পদের মধ্যে ৭২ লাখ ১০ হাজার ৩১৫ টাকার গ্রহণযোগ্য উৎস পেয়েছে দুদক।

শরীফা বেগমের (মনি) বাকি দুই কোটি ৩৪ লাখ ৯৯ হাজার ৪৯১ টাকার সম্পদের বৈধ উৎস পায়নি সংস্থাটি।

যদিও বিভিন্ন জাল কাগজপত্রের মাধ্যমে শরীফা বেগম দুদকের সামনে নিজেকে ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠার ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন। এরপরও শেষ রক্ষা হয়নি। নিজে আসামি হওয়ার পাশাপাশি স্বামী পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মোখলেসুর রহমানও অবৈধ সম্পদ মামলার আসামি হয়েছেন।

বৃহস্পতিবার (২৯ ডিসেম্বর) দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এ সংস্থাটির উপ-পরিচালক মোহাম্মদ সিরাজুল হক বাদী হয়ে দুজনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় অবৈধ সম্পদ অর্জনের পাশাপাশি ৫১ লাখ ১৫ হাজার ৭৪৪ টাকার সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগ আনা হয়েছে।

দুদক মামলা দায়ের করলেও সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তা এ বিষয়ে মুখ খুলছেন না। এমনকি জনসংযোগ দপ্তরও মামলার বিষয়ে কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হয়নি। মামলার বাদী সিরাজুল হকের কাছে জানতে চাইলে তিনি ঢাকা পোস্টকে জনসংযোগ দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন।

মামলার আসামি রাজশাহী সারদা পুলিশ ট্রেনিং একাডেমিতে কর্মরত অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মোখলেসুর রহমানের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনিও কোনো মন্তব্য করেননি।

মামলার এজাহারে যা বলা হয়েছে

আসামি মো. মোখলেসুর রহমান ও তার স্ত্রী শরীফা বেগমের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় ২০২০ সালের ১৮ অক্টোবর পৃথক সম্পদ বিবরণী নোটিশ ইস্যু করা হয়। এরপর ওই বছরের ৮ ডিসেম্বর তারা দুদক সচিব বরাবর সম্পদ বিবরণী দাখিল করেন। এরপর তাদের সম্পদ বিবরণী যাচাই-বাছাই কাজ শুরু করা হয়।

আসামি শরীফা বেগম (মনি) তার দাখিল করা সম্পদের বিবরণীতে কক্সবাজারের সায়মন বিচ রিসোর্ট লিমিটেডে ৪৭৫ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট, ঢাকার শান্তিনগরে ২ হাজার ৩৫৪ বর্গফুটের শেলটেক রহমান ভিলায় একটি ফ্ল্যাট, নেত্রকোনা সদরে দুটি দলিলে ২৯ শতক জমি, ঢাকার বাড্ডায় ২ দশমিক ৫ কাঠার প্লট, বাড্ডায় রাজউকের ১ দশমিক ২৫ কাঠার প্লটের বর্ণনা দেন।

সম্পদ-বিবরণীতে তিনি ওইসব সম্পদের মূল্য মোট এক কোটি ৩৪ লাখ ৩৩ হাজার টাকার ঘোষণা দেন। এছাড়া দাখিল করা সম্পদ-বিবরণীতে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের বিজয়নগর শাখায় ৬০ লাখ টাকা, ওয়ান ব্যাংকের গুলশান শাখায় পাঁচ লাখ টাকার স্থায়ী আমানত, ২১ লাখ টাকার একটি গাড়ি এবং ব্যাংকে ও হাতে নগদসহ মোট এক কোটি ২১ লাখ ৬১ হাজার ৬২ টাকার অস্থাবর সম্পদের ঘোষণা দেন। স্থাবর ও অস্থাবর মিলে দুই কোটি ৫৫ লাখ ৯৪ হাজার ৬২ টাকার ঘোষণা দিলেও দালিলিক হিসাবে যার বাস্তবিক মূল্য পাওয়া যায় তিন কোটি সাত লাখ নয় হাজার ৮০৬ টাকা।

প্রতিবেদন সূত্রে আরও জানা যায়, অনুসন্ধান-পর্যায়ে আসামি শরীফা বেগম (মনি) ব্যবসা সংক্রান্ত ট্রেড লাইসেন্স, কোনো গোডাউন, শো-রুম, দোকান বা অফিস, মালামাল ক্রয় ও বিক্রির পক্ষে গ্রহণযোগ্য রেকর্ডপত্র উপস্থাপন করতে পারেননি। একজন গৃহিণী হওয়া সত্ত্বেও মো. মোখলেসুর রহমান কর্তৃক অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদকে বৈধ করার চেষ্টা করেছেন বলে দুদকের অনুসন্ধানে প্রমাণিত হয়েছে। যা ‘অপচেষ্টা’ হিসেবে দেখছে দুদক।

এছাড়া ৫১ লাখ ১৫ হাজার ৭৪৪ টাকার সম্পদের তথ্য গোপনের প্রমাণ পেয়েছে সংস্থাটি। মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে দুদক আইন ২০০৪ এর ২৬ (২), ২৭ (১) ধারা এবং দণ্ডবিধি ১০৯ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।

দুদকের অভিযোগে যা ছিল

সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে মো. মোখলেসুর রহমান ও তার স্ত্রী শরীফা বেগমের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়-বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০১৯ সালের ৪ ডিসেম্বর অনুসন্ধান শুরু করে দুদক।

ওই অভিযোগে বলা হয়, মোখলেসুর রহমান ১৯৯৫ সালে নেত্রকোনার ফজলুর রহমান ও হোসনে আরা বেগমের কন্যা শরীফা বেগম মনিকে বিয়ে করেন। তাদের দুই সন্তান রয়েছে। তার স্ত্রী শরীফা বেগম মনি গৃহিণী। মোখলেসুর রহমান ও তার স্ত্রী দুজনই আয়করদাতা। স্ত্রী মনি ২০০৮ সালে আয়কর নথি চালু করেন। আর মোখলেসুরের আয়কর নথি চালু হয় ৯০ দশকে।

তাদের আয়কর নথি ও অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, অতিরিক্ত ডিআইজি মোখলেসুর রহমানের নামে ৪৫ লাখ ৮৮ হাজার ৪৪৬ টাকার স্থাবর এবং ১৩ লাখ ৭৫ হাজার ৯৮৩ টাকার অস্থাবরসহ মোট ৫৯ লাখ ৬৪ হাজার ৫০০ টাকার সম্পদ পাওয়া যায়।

অন্যদিকে, তার স্ত্রী মনির নামে এক কোটি ৪৪ লাখ ১৩ হাজার টাকার স্থাবর এবং এক কোটি ১৪ লাখ ২৫ হাজার ৬৮০ টাকার অস্থাবরসহ মোট দুই কোটি ৫৮ হাজার সাত হাজার টাকার সম্পদ পাওয়া যায়। সবমিলিয়ে তাদের নামে তিন কোটি ১৮ লাখ সাড়ে তিন হাজার সম্পদের বর্ণনা পাওয়া যায়।

শরীফা বেগম মনির স্থাবর সম্পদের বিবরণে ছিল, কক্সবাজার কলাতলীর সায়মন বিচ রিসোর্ট লিমিটেডে ৪৭৫ বর্গফুটের ফ্ল্যাট। যা তিনি ২০১০ সালের ৩০ জুনে ক্রয় করেছেন। ২০১২ সালের ১১ এপ্রিল ক্রয় করা রেজিস্ট্রেশন সূত্রে ঢাকার শান্তিনগরে শেলটেক রহমান ভিলায় কার পার্কিংসহ ২৩৫০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট। নিজ বাড়ি নেত্রকোনা সদরে ৩০ শতাংশ জমি কিনেছেন ২০১৩ ও ২০১৪ সালে। এছাড়া ২০১৪ সালে ২১ লাখ টাকার পুরাতন ১৫০০ সিসির টয়োটা গাড়ি (রেজি নং-৩১-৪৭৯৯) ক্রয় করেন মনি।

অস্থাবর সম্পদের বিবরণে মধ্যে রয়েছে, ২০১৩, ২০১৫, ২০১৬, ২০১৭ ও ২০১৮ সালে ১০ লাখ ও ১৫ লাখ করে মোট ৭০ লাখ টাকার পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র ও পরিবার সঞ্চয়পত্র। এছাড়া মনির নামে রয়েছে ছয় লাখ ৪০ হাজার ১৮০ টাকার জীবন বিমা।

আরএম/এসকেডি