ফ্রান্সের সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্টের সঙ্গে সম্ভাব্য যুদ্ধের ব্যয় মেটাতে সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে ১৭৯৮ সালে প্রথমবারের মতো আয়কর প্রবর্তন করেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম পিট। এর ৪৪ বছর পর ১৮৪২ সালে প্রধানমন্ত্রী রবার্ট পিলের আমলে সেখানে স্থায়ীভাবে আয়কর ব্যবস্থা চালু করা হয়। শুরুতে ‘যুদ্ধকালীন কর’ হিসেবে আয়করের আবির্ভাব ঘটলেও কালের বিবর্তনে তা হয়ে ওঠে সামাজিক কল্যাণ, বণ্টন ও সাম্যের সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার। অবশ্য ব্রিটিশ ভারতে আয়কর ব্যবস্থা আসে ১৮৬০ সালের সিপাহি বিপ্লবের পর। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) গঠনের মাধ্যমে আয়কর আহরণ শুরু হয়। 

মূলত, সম্পদ ও আয়ের সুষম বণ্টনের অন্যতম হাতিয়ার হলো আয়কর। যাকে সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় অর্থ জোগানের প্রধান উৎস এবং প্রত্যক্ষ কর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। স্বনির্ভর দেশ গঠনে আয়কর রাজস্ব সংগ্রহের প্রধান খাত হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও এক্ষেত্রে ঢের পিছিয়ে ১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশ। প্রবৃদ্ধি হলেও কর-জিডিপির অনুপাত দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে নিচে। শুধুমাত্র ই-টিআইএন রেজিস্ট্রেশন বিবেচনায় নিলেও তার সংখ্যা কোটিতে উত্তীর্ণ হয়নি। আয়কর দিয়ে রিটার্ন জমার সংখ্যা টেনেটুনে ৩২ লাখ।

স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হলেও এখনও কেন আয়কর প্রদানে মানুষের আগ্রহ বাড়ছে না— এমন প্রশ্ন অনেকের। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা বলছে, করযোগ্য হয়েও আয়কর দেন না দেশের ৬৮ শতাংশ মানুষ। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফসহ বিভিন্ন সংস্থার গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, কর-জিডিপির অনুপাত কম হওয়ার প্রধান কারণ হলো— জটিল কর ব্যবস্থা, দুর্বল কর প্রশাসন, করদাতা হয়রানি, কর ফাঁকি, কর অব্যাহতি দানের সংস্কৃতি এবং দুর্নীতি

স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হলেও এখনও কেন আয়কর প্রদানে মানুষের আগ্রহ বাড়ছে না— এমন প্রশ্ন অনেকের। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা বলছে, করযোগ্য হয়েও আয়কর দেন না দেশের ৬৮ শতাংশ মানুষ। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফসহ বিভিন্ন সংস্থার গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, কর-জিডিপির অনুপাত কম হওয়ার প্রধান কারণ হলো— জটিল কর ব্যবস্থা, দুর্বল কর প্রশাসন, করদাতা হয়রানি, কর ফাঁকি, কর অব্যাহতি দানের সংস্কৃতি এবং দুর্নীতি।

আরও পড়ুন >> ৯৭ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকিতে বিপাকে ব্যুরো ভেরিতাস গ্রুপ

যদিও খোদ এনবিআরের শীর্ষ কর্মকর্তাদের দাবি, আয়কর প্রদানে পিছিয়ে থাকার প্রধান কারণ হলো— কর না দেওয়ার মানসিকতা। এ ছাড়া, করকর্মীদের অদক্ষতা ও মানসিকতা, লজিস্টিক ও কাঠামোগত সহায়তার অভাব। জনবল সংকটকেও দায়ী করছেন তারা।

যেমনটি মনে করেন এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত দুর্বল। রাষ্ট্র ও সরকার এক জিনিস নয়। রাজস্ব ব্যবস্থাপনা যদি সরকারের হাতেই থাকে, তাহলে যত উদ্যোগ নেওয়া হোক না কেন, নিজ স্বার্থ রক্ষায় অযাচিত হস্তক্ষেপে মাঝপথেই সব উদ্যোগ থেমে যাবে। যখন যে সরকার দেশ পরিচালনায় থাকছে, তারা নিজ স্বার্থ রক্ষায় কর অব্যাহতি কিংবা কর ফাঁকির বিষয়টি মেনে নিচ্ছে। এনবিআর কর্মকর্তারা সরাসরি সরকারের অংশ। ফলে তারা রাজস্ব আদায়ের চেয়ে সরকারের স্বার্থ সুরক্ষায় বেশি ব্যস্ত থাকছে। এনবিআর কর্তারাও জবাবদিহিতার বাইরে থেকে যাচ্ছে। এনবিআর যখন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান না হয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠান হয়ে যায়, তখন সে সরকারের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করে।’

তিনি বলেন, ‘সব জায়গায় বৈষম্য আর বৈষম্য। এটি প্রকৃতির ভারসাম্যও নষ্ট করে দেয়। উন্নয়নের ক্ষেত্রেও আমরা বৈষম্য দেখতে পাচ্ছি। ধনীদের চলাচলের জন্য রাস্তাঘাট ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু রাস্তায় ফুটপাত নেই বা হাঁটার জন্য পরিসর বৃদ্ধির কোনো প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে না। পাশাপাশি ট্র্যাফিক ব্যবস্থা উন্নয়নে কোনো সুদৃষ্টি নেই। যে প্রকল্প বৈষম্য সৃষ্টি করে, সেটি অর্থনীতির জন্য ফলপ্রসূ নয়।’

‘এনবিআরকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। তারা (এনবিআর) যদি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করত, তাহলে তারা আয়কর বাড়াতে নেওয়া উদ্যোগগুলো বাস্তবায়নে সরকারকেও চাপ দিত। তবে, সেটি হচ্ছে না। যেমন ধরুন, আমাদের দেশের ৯০ শতাংশ মানুষের ব্যাংক হিসাব রয়েছে। সেখানে ই-টিআইএন থাকা বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু দেশের অন্তত তিন/চার কোটি মানুষের ব্যাংক হিসাব আছে, অথচ টিআইএন নেই। ওই মানুষদের ট্যাক্স ফাইল খোলা তো কঠিন বিষয় নয়। কিন্তু তা হচ্ছে না। ব্যাংকগুলো নির্দেশনা মানছে না। কারণ, ব্যাংকগুলোর মালিক সরকার কিংবা সরকারের সংশ্লিষ্ট লোকজন।’

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) মতে, কর ফাঁকি ও কর এড়ানোর মাধ্যমে ৫৫ হাজার ৮০০ কোটি থেকে দুই লাখ ৯২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে দেশ।

আরও পড়ুন >> জমি ও ফ্ল্যাট বিক্রিতে করের ‘জটিল অঙ্ক’, পকেট ফুরোবে বিক্রেতার

সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, “কর ফাঁকি দিতে গিয়ে বেশির ভাগ সময় প্রকৃত আয় কম দেখায় কোম্পানিগুলো। অথচ তারা ‘লিগ্যাল ফ্রেমের’ আওতায় সরকারের দেওয়া সুবিধা গ্রহণ করে। আমাদের দৃষ্টিতে এটিও কর অস্বচ্ছতা। কর ফাঁকি যদি ৮০ শতাংশ হয়, তাহলে দুই লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকার মতো রাজস্ব হারাচ্ছে দেশ। আবার কর ফাঁকি যদি ৫০ শতাংশ ধরা হয়, তাহলে রাজস্ব হারায় ৪১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে কঠোরতা অবলম্বন করলে আমাদের ৪১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা থেকে দুই লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকার মতো বাড়তি কর আদায়ের সুযোগ রয়েছে।”

‘অন্যদিকে, কর এড়াতে কোম্পানিগুলো যে অর্থ ব্যয় করছে সেটি যদি শতকরা পাঁচ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত হয়, তাহলে এর পরিমাণ ১৪ হাজার কোটি টাকা থেকে ৬৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকার মতো। এই বিপুল পরিমাণ রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। কর স্বচ্ছতার ক্ষেত্রে বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে, কর ফাঁকি ও কর এড়ানোর কারণে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে। যার পরিমাণ ৫৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা থেকে দুই লাখ ৯২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পর্যন্ত হতে পারে।’

রাজস্ব আদায়ে প্রত্যক্ষ কর

অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মধ্যে আয় ও সম্পদের বৈষম্য সৃষ্টি হয়। যা মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী আয়কর ব্যবস্থা। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২-৭৩ সালে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ে আয়করের অবদান ছিল ১০ শতাংশেরও কম। ওই সময় রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ছিল ১৬৬ কোটি এবং আয়কর আদায় ছিল ১০.৭২ কোটি টাকা। গত পাঁচ দশকে ক্রমান্বয়ে তা চারগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ৩৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে আয়কর আদায় হয় এক লাখ ১২ হাজার ৯২১ কোটি টাকা। যদিও তা সমাজের আয় ও সম্পদের বৈষম্য নিরসনের লক্ষ্যমাত্রা থেকে এখনও বহু দূরে। তবে, ২০৪১ সালে মোট রাজস্বের ৫০ ভাগের বেশি আয়কর থেকে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।

ই-টিআইএন বেড়েছে, বাড়েনি কাঙ্ক্ষিত রিটার্ন দাখিল

২০১৩ সালের জুলাই মাসে ইলেকট্রনিক ট্যাক্স আইডেনটিফিকেশন নম্বরের (ই-টিআইএন) রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম শুরু হয়।

দীর্ঘ ১০ বছরের যাত্রায় বর্তমানে নিবন্ধিত করদাতার সংখ্যা প্রায় ৯৪ লাখ হলেও বাড়েনি কাঙ্ক্ষিত আয়কর রিটার্ন দাখিলের সংখ্যা। সরকারি ৪৮ ধরনের সেবায় রিটার্ন স্লিপ বাধ্যতামূলক করার পরও এখনও রিটার্ন দাখিল করেন না প্রায় ৪৫ লাখ নিবন্ধিত করদাতা। এ সময়ের পরিসংখ্যান বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে, বছরে দুই থেকে চার লাখের মতো রিটার্ন দাখিল বেড়েছে। ২০২০-২১ করবর্ষে সরকারি সেবায় রিটার্ন স্লিপ দাখিল বাধ্যতামূলক ছিল না। ওই করবর্ষে রিটার্ন দাখিলের পরিমাণ ছিল ২৪ লাখ ৬১৫টি। পরের বছর রিটার্ন দাখিল করেন ২৫ লাখ ৯০ হাজার ৭৪৪ করদাতা। কিন্তু ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৪৪ ধরনের সরকারি সেবায় তা বাধ্যতামূলক করা হলে এক লাফে রিটার্ন দাখিল ৩২ লাখ ছাড়িয়ে যায়। অবশ্য রিটার্ন দাখিল বাড়লেও ই-টিআইএনধারী ব্যক্তির সংখ্যার তুলনায় তা এখনও অনেক কম।

আরও পড়ুন >> ২৮ বছরেও হয় না পদোন্নতি, ফাইলে নেই গতি

এ বিষয়ে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বর্তমানে সরকারি ৪৮ ধরনের সেবায় রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক। এটি শতভাগ সেবায় করা উচিত। বিদেশে এমনই আছে। এটি করার পরও সেই অর্থে কি করদাতা বেড়েছে? বাড়েনি। যদি ওই নির্দেশনাও মানা হতো, তাহলে করদাতা বেড়ে কয়েক কোটি হওয়ার কথা ছিল। অর্থাৎ, আইন ও বিধি থাকলেও তার বাস্তবায়ন নেই। ফলে কর-সংস্কৃতি গড়ে উঠছে না।’

দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন কর-জিডিপি অনুপাত

ধীরে ধীরে আয়কর সংগ্রহে ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতে থাকলেও দেশের কর-জিডিপির অনুপাত এখনও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছায়নি। সংকুচিত করভিত্তিকে কর-জিডিপির নিম্নহারের অন্যতম প্রধান কারণ বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এক্ষেত্রে বিশেষ খাতকে স্বল্প করহার সুবিধা, কর অব্যহতি ও কর অবকাশ সুবিধা প্রদানকে দায়ী করছেন এনবিআর-সংশ্লিষ্টরা। 

এনবিআরের গবেষণা বলছে, বিদ্যমান স্বল্প করহার, কর অব্যাহতি ও কর অবকাশ সুবিধাগুলোর কারণে কর-জিডিপির অনুপাত প্রকৃত অনুপাত থেকে ২.২৮ শতাংশ কমে যাচ্ছে। যদিও অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিভিন্ন ধরনের শিল্পখাত, রপ্তানিমুখী খাত, তথ্যপ্রযুক্তি খাত ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাতকে এমন সুবিধা দেওয়া যৌক্তিক মনে করার পাশাপাশি ক্রমান্বয়ে কর অব্যাহতি যৌক্তিকীকরণের দাবি অর্থনীতিবিদদের।

দেশের কর-জিডিপির অনুপাত ৭.৫ থেকে ৯ শতাংশ। যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে নেপালে যা ২৩.৩ শতাংশ, ভারতে ২০.৩ শতাংশ, পাকিস্তানে ১৫.২ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কায় ১৩.৩ শতাংশ। সে কারণে দীর্ঘদিন ধরে জিডিপির বিপরীতে রাজস্ব আয়ের অনুপাত বাড়াতে জোর দেওয়ার কথা বলে আসছেন অর্থনীতিবিদরা

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশের কর-জিডিপির অনুপাত ৭.৫ থেকে ৯ শতাংশ। যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে নেপালে যা ২৩.৩ শতাংশ, ভারতে ২০.৩ শতাংশ, পাকিস্তানে ১৫.২ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কায় ১৩.৩ শতাংশ। সে কারণে দীর্ঘদিন ধরে জিডিপির বিপরীতে রাজস্ব আয়ের অনুপাত বাড়াতে জোর দেওয়ার কথা বলে আসছেন অর্থনীতিবিদরা।

আরও পড়ুন >> ভ্যাট ফাঁকি উদঘাটন নিয়ে বিতর্ক, মুখোমুখি এনবিআরের দুই প্রতিষ্ঠান

সিপিডির গবেষণায় বলা হয়, করযোগ্য আয় করার পরও আয়কর দেন না ৬৮ শতাংশ মানুষ। অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ কর দেওয়ার যোগ্য হলেও দেন না। মূলত এটিই কর-জিডিপির অনুপাত ঊর্ধ্বমুখী না হওয়ার বড় কারণ।

দুর্নীতির অন্যতম হাতিয়ার কর ফাঁকি

আয়কর প্রক্রিয়া সহজীকরণের পাশাপাশি কর ফাঁকি রোধের মাধ্যমে রাষ্ট্রের ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করাও এনবিআরের দায়িত্ব বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনার প্রক্রিয়াতেও কর ফাঁকির নতুন নতুন ধারণা জন্ম হয়েছে। এনবিআরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বছরে তিন থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকার আয়কর ফাঁকি দেয় বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। এনবিআরের অডিট, ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশনের তৈরি করা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১০-১১ করবর্ষ থেকে ২০১৯-২০ করবর্ষ পর্যন্ত ১০ বছরে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার আয়কর ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। কর ফাঁকির কারণ উদঘাটন কার্যক্রম জোরদার করতে কর-জরিপ এবং সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তথ্য বিনিময়ের মাধ্যমে সমৃদ্ধ ডাটাবেজ তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলেও এর যথাযথ বাস্তবায়ন নেই। ফলে কর-জরিপের কাজ একেবারে থেমে গেছে।

কর অব্যাহতিতে রাজস্ব ক্ষতি ৬০ হাজার কোটি 

এনবিআরের তথ্যানুসারে, দেশীয় শিল্পায়ন বিকাশের লক্ষ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও যোগাযোগের অত্যাবশ্যকীয় ভৌত কাঠামো, তথ্য ও প্রযুক্তি খাত, রপ্তানিমুখী পোশাক ও বস্ত্র খাত, হস্তজাত শিল্প, কৃষি খাত এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের আওতায় শিল্প ও দেশীয় অটোমোবাইলসহ ইলেকট্রনিক্স খাতকে বিভিন্ন হারে কর অব্যাহতির সুবিধা দিয়ে আসছে সরকার। এনবিআরের নিজস্ব গবেষণা বলছে, বছরে প্রায় ৫৮-৬০ হাজার কোটি টাকার কর অব্যাহতি দেয় সরকার। এ অব্যাহতির সংস্কৃতি এড়াতে পারলে ২০৩১ সালের মধ্যে কর-জিডিপির অনুপাত ১৭ শতাংশে উন্নীত করা সম্ভব। যে কারণে সবসময়ই অব্যাহতির পরিমাণ কমানোর জন্য বারবার মন্ত্রণালয় ও দপ্তরে চিঠি দিয়ে আসছে এনবিআর।

এ বিষয়ে সম্প্রতি এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম এক আলোচনায় বলেছিলেন, যখন আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল (ইপিজেডের জন্য) তখন অন্ধভাবে অনেক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। কারণ, তখন তেমন কোনো স্থানীয় শিল্প ছিল না। তবে, বর্তমানে স্থানীয় শিল্প বেড়েছে। দেশের শিল্পায়ন ও উন্নয়নের স্বার্থে ছাড় না চেয়ে কর দেওয়ার মানসিকতা বাড়ানো উচিত ব্যবসায়ীদের।

আরও পড়ুন >> পেট্রোবাংলার পেটে সরকারের ২২ হাজার কোটি টাকা

কর-ব্যবস্থাপনার অটোমেশন কত দূর

বাংলাদেশের কর-ব্যবস্থাপনা এখনও অতিমাত্রায় অ্যানালগ ও ব্যক্তি-নির্ভর। যে কারণে সেবা প্রদান প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হচ্ছে এবং রাজস্ব সংগ্রহ বিলম্বিত হচ্ছে। এসব কারণে আয়কর সিস্টেমকে অটোমেশনের ওপর জোর দিয়েছে এনবিআর। যার মধ্যে রয়েছে ই-টিআইএন, অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল সিস্টেম, উৎসে কর জমায় ই-টিডিএস সিস্টেম ও ট্রান্সফার প্রাইসিং। এসব সিস্টেম চালু হলেও পূর্ণতা এখনও পায়নি। ফলে হয়রানি থেকে সহসাই মুক্তি মিলছে না।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কারণে আইটিভিত্তিক নানা ব্যবসার সম্প্রসারণ ঘটবে। এ ধরনের ব্যবসার আয় থেকে বর্তমান কাঠামো দিয়ে কর আদায় সম্ভব নয়। তাই প্রত্যক্ষ কর আদায় বাড়াতে আয়কর বিভাগের সংস্কার ও সম্প্রসারণের বিকল্প নেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা

জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়ার কী খবর

২০১১ সালে আয়কর বিভাগে সংস্কার ও সম্প্রসারণ কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছিল। তখন ৩১টি কর অঞ্চলে মাত্র আট লাখ রিটার্ন জমা পড়ত। বর্তমানে প্রত্যাশা রয়েছে, ২০২৪ সালে টি-আইএনধারীর সংখ্যা এক কোটি ছাড়িয়ে যাবে এবং রিটার্ন জমা পড়বে ৫০ লাখের বেশি। এত বিপুলসংখ্যক রিটার্ন প্রসেস করার জন্য বিদ্যমান আয়কর কাঠামোর সক্ষমতা নেই। অন্যদিকে, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কারণে আইটিভিত্তিক নানা ব্যবসার সম্প্রসারণ ঘটবে। এ ধরনের ব্যবসার আয় থেকে বর্তমান কাঠামো দিয়ে কর আদায় সম্ভব নয়। তাই প্রত্যক্ষ কর আদায় বাড়াতে আয়কর বিভাগের সংস্কার ও সম্প্রসারণের বিকল্প নেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

আরও পড়ুন >> ১২.৪৬ কোটি টাকার দানকর পরিশোধ করেছেন ড. ইউনূস

আইএমএফের পরামর্শে মাঠপর্যায়ে আয়কর ও কাস্টমস অফিসের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং ৪২ হাজার জনবল বাড়ানোর প্রস্তাব তৈরি করেছে এনবিআর। যার মধ্যে আয়কর অনুবিভাগে সংস্কার, পুনর্গঠন ও সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে ১০০ উপজেলায় আয়কর অফিস করা হবে। পাশাপাশি নতুন ৪৫টি কর অঞ্চল গঠন করা হবে। বর্তমানে দেশব্যাপী আয়কর অফিসের সংখ্যা ৪০টি। কর্মরত রয়েছেন নয় হাজার জনবল। নতুন কাঠামোতে আরও ২৫ হাজার জনবল নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে, কাগজে-কলমে থাকা এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন থেকে বহু দূরে রয়েছে এনবিআর।

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘উপজেলা পর্যায়ে এত এত সরকারি অফিস, এমনকি পরিষদের নিজস্ব ভবন ও কমপ্লেক্স থাকলেও এনবিআরের অফিস নেই। অর্থাৎ সরকার নিজেই অফিস খুলতে দিচ্ছে না। একটি অটোমেশনের আওয়াজ তোলা হলেও এনবিআরের কর-ব্যবস্থাপনা অনলাইনভিত্তিক করার কাজ শেষে হয়নি। বছরের পর বছর ধরে এ কাজ চলছে। সবক্ষেত্রেই বাস্তবায়নের ঘাটতি!’

আরও পড়ুন >> নিটল মটরসের ৩৬৬ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকি

সার্বিক বিষয়ে এনবিআরের বক্তব্য পাওয়া না গেলেও প্রতিষ্ঠানটির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, কর-জিডিপির অনুপাত আমাদের দেশে অনেক কম, এটি সত্য। বর্তমানে ৯৫ লাখ টি-আইএনধারীর মধ্যে ৩২ লাখের মতো করদাতা রিটার্ন দাখিল করছেন। কিন্তু আমার প্রশ্ন, ওই করদাতা ম্যানেজ করার মতো কর-কাঠামো কি এনবিআরের আছে? দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, ওই রিটার্ন ফাইল ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা বর্তমান কর অফিসের নেই। ফলে অধিকাংশ রিটার্ন আনটাচড থেকে যাচ্ছে।

‘আয়করে সবচেয়ে বেশি কর আসে উৎসে করের মাধ্যমে। সেই উৎসে কর কর্তনের কথাই ধরা যাক। এনবিআরের তালিকাভুক্ত ১৫ থেকে ২০ হাজার কোম্পানি রয়েছে। এনবিআরের কর্মকর্তারা কি প্রতিটি কোম্পানির নথি যাচাই-বাছাই করতে পারেন? পারেন না। কারণ, জনবল সংকট। এ ছাড়া অন্যান্য কাজ তো আছেই। করকর্মকর্তাদেরও সব ফাইল যাচাই-বাছাই করার সক্ষমতা নেই। অর্থাৎ করদাতার সংখ্যা বাড়ছে কিন্তু সেটির ব্যবস্থাপনা এবং কর আদায়ের জন্য করকর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা বাড়ছে না। করদাতার গ্রাফ ও করসংগ্রহকারীর গ্রাফের মধ্যে ব্যবধান দিনদিন বাড়ছে। তাই এক্ষেত্রে বড় ঘাটতি তৈরি হচ্ছে।’

আরও পড়ুন >> বছর শেষে রাজস্ব ঘাটতি ৪৪ হাজার কোটি

করদাতাদের হয়রানি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কর অফিস কিংবা ব্যবসায়ী উভয় পক্ষ থেকেই হয়রানি করা হয়। কোম্পানির ফাইলে ঘাপলা বের হলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মাধ্যমে হয়রানি করা হয়। বিপরীত চিত্রও আছে। করকর্মকর্তাও করদাতাকে হয়রানি করেন। একটি বিষয় হচ্ছে, আয়কর রিটার্নের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করের পাশাপাশি পরোক্ষ করের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ারও সুযোগ রয়েছে।’ [চলবে...]

আরএম/কেএ/এমএআর/

দ্বিতীয় পর্বে থাকছে >> অব্যাহতি আর ফাঁকিতে গচ্চা লাখ কোটি টাকার ভ্যাট