দেশে উৎপাদিত বিদ্যুতের ৪৭ শতাংশই গ্যাসভিত্তিক। যার মোট উৎপাদন ক্ষমতা ১১ হাজার ১৭ মেগাওয়াট। কিন্তু গ্যাস সংকটের ফলে উৎপাদনের মাত্রা কমে দাঁড়িয়েছে আট হাজার ২২৮ মেগাওয়াটে। বর্তমানে গ্যাসচালিত কেন্দ্রগুলোতে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা দুই হাজার ২৪০ মিলিয়ন ঘনফুট। বিপরীতে পেট্রোবাংলা সরবরাহ করছে অর্ধেকেরও কম অর্থাৎ এক হাজার ৩৪ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস।

পেট্রোবাংলার তথ্য মতে, সহসাই গ্যাস সরবরাহ বৃ্দ্ধির তেমন সম্ভাবনা নেই। এমন সংকটের সময়ও উৎপাদনের অপেক্ষায় রয়েছে আরও পাঁচটি গ্যাসচালিত নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র।

নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদনে আসার কথা ছিল গত ৩১ আগস্ট। কিন্তু গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত না হওয়ায় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো উৎপাদনে আনা সম্ভব হয়নি। নতুন কেন্দ্রগুলোর মধ্যে রয়েছে- এলএনজিভিত্তিক সামিট গ্রুপের মেঘনাঘাট ৫৮৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র, ইউনিক গ্রুপের মেঘনাঘাট ৫৮৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং ভারতের রিলায়েন্স গ্রুপের মেঘনাঘাট ৭১৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র। এ ছাড়া, ডুয়েল ফুয়েলভিত্তিক (গ্যাস বা ডিজেল) খুলনা ৩৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র ও ১৫৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ঘোড়াশাল ইউনিট-৩ রিপাওয়ারিং বিদ্যুৎকেন্দ্র। সবমিলিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা দুই হাজার ৩৭১ মেগাওয়াট।

সহসাই গ্যাস সরবরাহ বৃ্দ্ধির তেমন সম্ভাবনা নেই। এমন সংকটের সময়ও উৎপাদনের অপেক্ষায় রয়েছে আরও পাঁচটি গ্যাসচালিত নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র

তিতাস সূত্রে জানা যায়, জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে কারিগরি পরীক্ষার জন্য কেবল সামিট ও ইউনিকের বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ করতে বলা হয়েছে। ফলে কেন্দ্র দুটিতে বর্তমানে ২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। বাকি কেন্দ্রগুলোতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।

এ বিষয়ে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অপারেশন) সেলিম মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো এখন টেস্টিং পর্যায়ে রয়েছে। তাদের গ্যাস দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত সক্ষমতা আমাদের নেই। সামগ্রিকভাবে গ্যাসের সরবরাহ না বাড়লে তাদের গ্যাস দেওয়া সম্ভব হবে না।

‘এখন তাদের গ্যাস দিতে হলে অন্যান্য প্ল্যান্ট থেকে সরবরাহ কিছুটা কমিয়ে দিতে হবে। সেটি এখনই সম্ভব নয়। হায়ার অথরিটি থেকে নির্দেশনা পেলে করা হবে।’

জানা যায়, দেশে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ৬৪টি। কিন্তু গ্যাস সংকটে দীর্ঘদিন ধরে সক্ষমতার অর্ধেক বা আংশিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে ১৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্র। অপরদিকে, পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে ২১টি বিদ্যুৎকেন্দ্র।

সংকটের মধ্যে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারবে— এমন প্রশ্নে পিডিবির মুখপাএ শামীম হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, যখন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়, তখন কিন্তু এ সংকট নিয়ে চিন্তা করা হয়নি। যেহেতু সংকটপূর্ণ অবস্থা তৈরি হয়েছে, সেহেতেু চেষ্টা করা হবে তা সমাধান করার।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশীয় গ্যাসের অনুসন্ধান ও উত্তোলনে গুরুত্ব না দেওয়া এ সংকট তৈরি হওয়ার বড় কারণ। একই সঙ্গে আমদানি নির্ভরতা বাড়াচ্ছে জ্বালানি খাতের ঝুঁকি।

বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক জ্বালানি ও টেকসই উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ  ড. ইজাজ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, গ্যাস সংকটে আমরা চলমান বা আগের কেন্দ্রগুলোকে বসিয়ে রেখেছি। নতুন কেন্দ্রগুলোর মাধ্যমে বোঝাটা আরেকটু বাড়ল। এখন যেটা করতে হবে, সবার থেকে একটু লোড কমিয়ে দিয়ে এদের চালাতে হবে। আর চালাতে না পারলে চুক্তি অনুযায়ী ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে। চুক্তিটা করা হয়েছে সেভাবে। সুতরাং যারা প্ল্যান্ট বানিয়েছেন তাদের তো চিন্তা নেই। চাপটা এখন সরকারের। এখন দেশীয় গ্যাস উত্তোলনে গুরত্বারোপ করাটা জরুরি। যাতে আমাদের নিজস্ব নির্ভরতা তৈরি হয়।

এলএনজি নির্ভরতা বাড়াচ্ছে ঝুঁকি

দেশের জ্বালানি খাতে ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে এলএনজি গ্যাসের নির্ভরতা। পেট্রোবাংলার তথ্য মতে, গত পাঁচ বছরে দেশে শুধুমাত্র এলএনজি (তরলিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৮৫ হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা। এ সময়ে দেশের পুরো গ্যাস ক্রয়বাবদ ব্যয় হয়েছে এক লাখ ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। অথচ মোট গ্যাসের মাত্র ২৪ শতাংশ পাওয়া যায় এলএনজি থেকে। কিন্তু ব্যয় করতে হয়েছে ৭৭ দশমিক ৩৮ শতাংশ গ্যাসের সমান দাম। আগামীতে আরও তিন গুণ এলএনজি আমদানি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ২০২৬ সালের পর এলএনজি আমদানি ১০.৫০ মিলিয়ন টন পার ইয়ার (এমটিপিএ) ছাড়ানোর ব্যবস্থা চূড়ান্ত করা হয়েছে।

দেশে গ্যাস সরবরাহের বেশির ভাগই আসে স্থানীয়ভাবে উত্তোলনের মাধ্যমে। এর মধ্যে শুধু মার্কিন কোম্পানি শেভরন উত্তোলন করছে মোট গ্যাসের ৫০ শতাংশ। স্থানীয় কোম্পানিগুলো থেকে পাওয়া যাচ্ছে ২৬ শতাংশ। শেভরনের গ্যাস ক্রয়ে বছরে ব্যয় হয় মাত্র ১৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ অর্থ। স্থানীয় কোম্পানিগুলোর পেছনে বছরে ব্যয় হয় ৫ শতাংশের কিছু বেশি। তবুও জ্বালানি বিভাগ নির্ভরতা বাড়াচ্ছে এলএনজি আমদানির দিকেই।

২০১৮ সালে দেশে এলএনজি আমদানি শুরুর পর থেকে গত চার অর্থবছরে গ্যাস সরবরাহে জ্বালানি বিভাগের মোট অর্থ ব্যয় হয়েছে এক লাখ ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত ব্যয় হওয়া এ অর্থের ৭৭ দশমিক ৩৮ শতাংশ খরচ হয়েছে এলএনজি আমদানিতে। দেশে গ্যাস উত্তোলনকারী বিদেশি কোম্পানিগুলোকে (আইওসি) দিতে হয়েছে ১৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ, আর স্থানীয়ভাবে গ্যাস উত্তোলনকারী তিন দেশীয় কোম্পানির পেছনে ব্যয় হয়েছে ৫ শতাংশের কিছু বেশি অর্থ।

গত পাঁচ বছরে দেশে শুধুমাত্র এলএনজি (তরলিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৮৫ হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা। এ সময়ে দেশের পুরো গ্যাস ক্রয়বাবদ ব্যয় হয়েছে এক লাখ ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। অথচ মোট গ্যাসের মাত্র ২৪ শতাংশ পাওয়া যায় এলএনজি থেকে। কিন্তু ব্যয় করতে হয়েছে ৭৭ দশমিক ৩৮ শতাংশ গ্যাসের সমান দাম

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ব্যয়বহুল এলএনজি-নির্ভরতা আর্থিকভাবে ঝুঁকিতে ফেলছে জ্বালানি খাতকে। এ প্রসঙ্গে জ্বালানি বিশেষেজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন বলেন, ‘দেশীয় খাতে অনুসন্ধান, উত্তোলন না বাড়িয়ে কেন সরকার এলএনজি আমদানিতে ঝুকঁছে— এ তর্কটা আজকের নয়। আমরা সবসময় বলে আসছি, দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধানে সরকারের জোর দেওয়া উচিত। কিন্তু তা না করে আমরা আমদানির দিকে ঝুঁকে পড়েছি। এর কিন্তু একটা অর্থনৈতিক প্রভাব রয়েছে। দিনশেষে যা জনগণের ওপরই বর্তাবে।’

ওএফএ/এমএআর/