স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করে কাজ এগিয়ে চলছে মেট্রোরেল প্রকল্পের

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় স্বাস্থ্যবিধি মানতে সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত বিভিন্ন মেগা প্রকল্পেও নির্দেশনাগুলো মানতে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। শ্রমিকদের জন্য প্রকল্প এলাকায় তৈরি করা হয়েছে আইসোলেশন সেন্টার, রয়েছে তাপমাত্রা পরীক্ষার ব্যবস্থাও। 

প্রকল্পের অগ্রগতি ধরে রাখতে একই সঙ্গে করোনার সংক্রমণরোধে এর বাইরেও বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপকালে এসব তথ্য জানা গেছে।

গত বছরের মার্চে দেশে করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন প্রকল্পে যুক্ত বিদেশিরা নিজ দেশে চলে যান। সংক্রমণ কমে এলে তারা বাংলাদেশে ফিরে আসেন। প্রকল্পে যখন গতি পাচ্ছিল তখন করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আঘাত শুরু হয়। দিনদিন সংক্রমণ বাড়ছে। ফলে বিভিন্ন প্রকল্পের পরামর্শক থেকে শুরু করে শ্রমিকদের স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে কঠোর তদারকি শুরু হয়েছে।

এরই মধ্যে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো–অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) সরকারের সংশ্লিষ্ট একাধিক দফতরে চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে সংস্থাটির অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ চলাকালে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শতাধিক কর্মী, পরামর্শক ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। যদিও এসব প্রকল্পে স্বাস্থ্যবিধি মেনে নির্মাণকাজ পরিচালনার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি দেখছেন সংশ্লিষ্টরা

বাংলাদেশের প্রথম মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে ঢাকায়। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল নির্মাণ প্রকল্পে জাইকা প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ ইয়েন ঋণ সহায়তা দিচ্ছে। এছাড়া ঢাকায় আরও দুটি রুটে মেট্রোরেল প্রকল্প, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, মাতারবাড়ি ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ, শেখ মুজিবুর রহমান রেলসেতুসহ চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্প, পশ্চিমাঞ্চল সেতু উন্নয়ন, ফুড ভ্যালু চেইন উন্নয়ন প্রকল্প, আরবান ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড সিটি গভর্নেন্স প্রকল্পসহ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সহায়তা করছে সংস্থাটি।

সম্প্রতি জাইকার আবাসিক প্রতিনিধি হাইকায়া ইউহো অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সচিবকে চিঠি দিয়েছেন। চিঠির অনুলিপি এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে এমন সব মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সচিব ও সিনিয়র সচিবকে পাঠানো হয়েছে। ‘রি-ইমফেসাইজ টু প্রিভেন্ট কোভিড-১৯ আউটব্রেক অন অনগোয়িং ওডিএ লোন প্রজেক্টস’ শীর্ষক চিঠিতে জাইকার পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর শুভেচ্ছা জানিয়ে সংস্থাটির আবাসিক প্রতিনিধি হাইকায়া ইউহো উল্লেখ করেন, ‘আমাদের কার্যক্রম বাস্তবায়নে সর্বাত্মক সহায়তার জন্য আন্তরিক প্রশংসা জানাচ্ছি এবং আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের দ্রুত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে জাইকার সহায়তায় বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলো গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। জাইকার অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলোতে নিয়োজিত জনবলের মধ্যে দ্রুত করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে। তাই প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোকে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আমি এ চিঠিতে অনুরোধ জানাচ্ছি।’

মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড- ডিএমটিসিএল। ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক শনিবার বিকেলে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমাদের প্রকল্পের কাজ করোনাকালেও চলছে। প্রকল্পের দিয়াবাড়ী ও গাবতলীতে দুটো মাঠ হাসপাতাল রয়েছে। জরুরি অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা রয়েছে হাসপাতাল দুটিতে। একটিতে ১৪টি শয্যা, অন্যটিতে ১০টি শয্যা। আগামী ১৪ এপ্রিল থেকে সরকার সর্বাত্মক লকডাউন দিতে পারে। ওই সময় করোনার সংক্রমণ বেড়ে গেলে আমরা শয্যার সংখ্যা আরও বাড়াব।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেতু

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী সিদ্ধান্তে ১৯৯৮ সালের ২৩ জুন যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতুতে রেলসংযোগ করা হয়েছিল। স্বাধীনতার পর রেলওয়ের উন্নয়নে এটি ছিল প্রথম মাইলফলক। সেতুটি সার্ক, বিমসটেক, সাসেক ও অন্যান্য আঞ্চলিক, উপ-আঞ্চলিক রেলওয়ে রুট ও ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কের অংশ। নির্বিঘ্নে আরও বেশি সংখ্যক ট্রেন চলাচল নিশ্চিত করতে রেলওয়ের জন্য বঙ্গবন্ধু সেতুর ৩০০ মিটার উজানে আলাদা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেলসেতু নির্মাণ করছে সরকার। বিদ্যমান বঙ্গবন্ধু সেতুর সমান্তরালে ডুয়েল গেজ ডাবল ট্র্যাকসহ প্রায় ৪ দশমিক ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ হবে সেতুটি। বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব ও পশ্চিমে নতুন স্টেশন ভবনসহ ইয়ার্ড রিমডেলিং, সিগন্যালিং ও টেলিকমিউনিকেশন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন হবে। এছাড়াও থাকবে রেল জাদুঘর ও বাংলো। সেতুর নির্মাণকাজ চলছে। এ প্রকল্পেও অর্থসহায়তা করছে জাইকা।

যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে এগিয়ে চলছে মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ

২০২০ সালের ৫ এপ্রিল সেতুটি নির্মাণে ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হয়। ওই বছরের ২৯ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। ডাবল লাইন হওয়ায় সেতুটির দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৬০ কিলোমিটার বিবেচনা করছে রেলওয়ে। সেতুর পূর্বদিকের অংশ (প্যাকেজ-১) যৌথভাবে নির্মাণ করবে জাপানের ওবায়াশি করপোরেশন, তোয়া করপোরেশন ও জেইই হোল্ডিং। পশ্চিম দিকের অংশ (প্যাকেজ-২) যৌথভাবে নির্মাণ করবে জাপানের আইএইচআই করপোরেশন ও সুমিতোমো মিতসুই করপোরেশন। ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

প্রকল্পের কর্মকর্তারা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা প্রকল্পের প্রাথমিক কাজ শুরু করেছি। স্বাস্থ্যবিধি মেনেই শ্রমিকরা কাজ করছেন এবং প্রকল্প এলাকায় অবস্থান করছেন।

বিআরটি

ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছ থেকে গাজীপুর পর্যন্ত বাস চলাচলের বিশেষ ব্যবস্থা বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট- বিআরটি প্রকল্পে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে নজরদারি জোরদার করা হয়েছে। এডিবি, ফরাসি উন্নয়ন সংস্থা (এএফডি), গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি (ডিইএফ) প্রকল্পে অর্থায়ন করছে।

বিআরটি কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সফিকুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুসারে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রকল্প এলাকায় কাজ চলছে। মূল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চীনের। তারা কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন করছে। তারপরও আমরা সবকিছু নজরদারিতে রেখেছি।

ঢাকার যানজট নিরসনে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গাজীপুরের শিববাড়ী পর্যন্ত গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট (বিআরটি গাজীপুর-বিমানবন্দর) ২০১২ সালের ২০ নভেম্বরে একনেকে অনুমোদিত হয়। সরকারের তিনটি সংস্থার অধীনে প্রকল্পটির নির্মাণকাজ চলছে।

বিআরটি প্রকল্পেও স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে নজরদারি জোরদার করা হয়েছে

ঢাকা উড়াল সড়ক

ঢাকা উড়াল সড়কের (ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে) নির্মাণকাজ চালাতে কাওলা, কুড়িল, বনানী, তেজগাঁওয়ে প্রকল্পের নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে আইসোলেশন সেন্টার করা হয়েছে। প্রকল্পের পরিচালক এ এইচ এম এস আকতার ঢাকা পোস্টকে জানান, স্বাস্থ্যবিধিতে আমরা বেশি জোর দিচ্ছি। গত বছর যে ১৪টি আইসোলেশন সেন্টার করা হয়েছিল, সেগুলো ফের সচল করা হয়েছে। শ্রমিকদের প্রকল্প এলাকার বাইরে যেতে দেওয়া হচ্ছে না।

২০১১ সালের ১৯ জানুয়ারি প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়। এখন পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি ২৫ শতাংশ। চার লেনের উড়াল সড়কটির প্রারম্ভিক স্থান হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বিপরীতে কাওলায়। কাওলা থেকে শুরু হয়ে খিলক্ষেত, কুড়িল, মহাখালী, তেজগাঁও, মগবাজার, কমলাপুর হয়ে যাত্রাবাড়ীর কাছে কুতুবখালি পর্যন্ত যাবে এটি। ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ হবে উড়াল সড়কটি।

সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব বা পিপিপিতে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ২০১১ সালের ১৯ জানুয়ারি ইতালিয়ান-থাই ডেভেলপমেন্ট কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ সেতু বিভাগ।

পিএসডি/জেডএস/এমএআর/