লাইব্রেরিতে পড়াশোনায় মনযোগী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা/ ছবিঃ সংগৃহীত

সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মোট ১৫১টি বিশ্ববিদ্যালয় দেশে উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর মধ্যে ৬০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো গবেষণার কাজ হয়নি। অর্থাৎ এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা খাতে কোনো বরাদ্দ ছিল না। এছাড়া ৫৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল না কোনো প্রকাশনা। অর্থাৎ এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জার্নালে কোনো প্রবন্ধ, সাময়িকী বা অন্য কোনো গবেষণাপত্র প্রকাশ করেননি।

সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) উচ্চশিক্ষার হালচাল নিয়ে প্রকাশিত ৪৬তম বার্ষিক প্রতিবেদনে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা খাতের এমন নাজুক পরিস্থিতির তথ্য পাওয়া গেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান দুটি কাজ হচ্ছে শিক্ষাদান এবং শিক্ষাদানের জন্য নতুন নতুন জ্ঞানের উদ্ভাবন। একটিকে বাদ দিয়ে আরেকটি চলে না। এ দুটির জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন গবেষণা। কিন্তু বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষায় গবেষণার হাল খুবই নাজুক। পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা চলছে কচ্ছপ গতিতে।

প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে ইউজিসি। তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে অর্ধেকের বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়নি। যারা করেছেন, তারা নামমাত্র করেছেন।

চিত্রটি উদ্বেগজনক বলছেন শিক্ষাবিদরা। এজন্য সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দায়ী করা যাবে না বলেও মনে করেন তারা। কারণ উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ বাড়ালেও গবেষণা খাতে বরাদ্দ বাড়ছে না। এমনকি কয়েকটি ক্ষেত্রে গত এক দশকে বরাদ্দের পরিমাণ কমেছে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা / ছবি : সংগৃহীত

ইউজিসি বলছে, নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার চেয়ে এখন শিক্ষার মানের দিকে নজর দেওয়া জরুরি। কারণ টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো গুণগত শিক্ষা। এ চ্যালেঞ্জ সংখ্যা দিয়ে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। এজন্য গবেষণা খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে।

ইউজিসি সূত্রে আরও জানা যায়, ২০১৯ সালে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মোট ১৫১টি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। এর মধ্যে ১২টি সরকারি ও ৪৮টি বেসরকারিসহ মোট ৬০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো গবেষণা হয়নি।

এছাড়া ২০টি বেসরকারি ও আটটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা খাতে কোনো বরাদ্দই রাখেনি। বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা কার্যক্রমে বরাদ্দ ছিল পাঁচ লাখ টাকারও কম। এর মধ্যে ২০১৯ সালে ৩৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো প্রকাশনা নেই। সরকারি ১৯টি বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৯ সালে একটি প্রকাশনাও প্রকাশ করতে পারেনি।

গবেষণায় বরাদ্দ নেই ৮ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে

বর্তমানে দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ৪৬টি। আরও চারটি বিশ্ববিদ্যালয় সরকার অনুমোদন দিলেও এখনও শিক্ষাকার্যক্রম শুরু করেনি। শিক্ষাকার্যক্রম চলছে এমন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে আটটি বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৯ সালে গবেষণা খাতে কোনো বরাদ্দ রাখেনি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো- চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, সিরাজগঞ্জে অবস্থিত রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুরের শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অ্যাভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয় ও আরবি বিশ্ববিদ্যালয়।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো / ছবি : সংগৃহীত

পাঁচ লাখ টাকার কম বরাদ্দ ছিল রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় এবং বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এছাড়া আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় এ খাতে নামমাত্র বরাদ্দ রেখে দায় সেরেছে।

বেহাল দশা ৪৮ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে

সারাদেশে শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করছে ১০৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এর মধ্যে ৪৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা খাতে চলছে বেহাল দশা। ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে ২০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা খাতে কোনো বরাদ্দ রাখেনি। ২৮টি বিশ্ববিদ্যালয় পাঁচ লাখ টাকারও কম বরাদ্দ রেখে দায় সেরেছে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো / ছবি : সংগৃহীত

গবেষণা খাতে বরাদ্দ না রাখা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো- রাজধানীর মোহাম্মদপুরে অবস্থিত দ্য পিপল’স ইউনিভার্সিটি, ইবাইস, জেড এইচ সিকদার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ফার্স্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটি, নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, কুষ্টিয়া রবীন্দ্র মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়, সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, রূপায়ন এ কে এম শামসুজ্জোহা বিশ্ববিদ্যালয়, জেড এন আর এফ ইউনিভার্সিটি অব ম্যানেজমেন্ট সায়েন্সেস, দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা, আহসানিয়া মিশন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনার খান বাহাদুর আহসানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়, বান্দরবন বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহীর শাহ মখদুম ম্যানেজমেন্ট ইউনিভার্সিটি, বরিশালের ট্রাস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড ইউনিভার্সিটি, কুইন্স ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ইউনিভার্সিটি অব স্কিল এনরিচমেন্ট অ্যান্ড টেকনোলজি।

গবেষণা খাতে বরাদ্দের শীর্ষে ৫ বিশ্ববিদ্যালয়

গবেষণা খাতে বরাদ্দের শীর্ষে থাকা পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় হলো- ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ (এআইউবি), ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটি, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি ও ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস। এছাড়া ২০১৯ সালে ৩৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো প্রকাশনা ছিল না।

এ প্রসঙ্গে ইউজিসির চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. কাজী শহীদুল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইউজিসির প্রতিবেদনে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার চিত্র হয়তো ঠিকমতো আসে না। তবে বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মৌলিক গবেষণা কিন্তু হচ্ছে। না হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো টিকে থাকতে পারত না।

তবে আমাদের গবেষণার চিত্র খুব একটা ভালো, এটা বলা যাবে না। আমরা প্রতি বছর গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ চেয়েও পাচ্ছি না।

ইউজিসি চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. কাজী শহীদুল্লাহ

প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, শিক্ষকরা এখন লেজুড়বৃত্তির রাজনীতিতে ঢুকে গেছেন। তারা শিক্ষকতার চেয়ে প্রশাসনিক পদে বসতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। সেজন্য গবেষণা, প্রবন্ধ, সেমিনার করার সময় পান না।

গবেষণা ও শিক্ষার মান কমে যাওয়ার জন্য শিক্ষকরা যেমন দায়ী তেমনি সরকারও দায় এড়াতে পারে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি / ছবি : সংগৃহীত 
সরকার গবেষণায় বরাদ্দ বাড়ানোর চেয়ে নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে বেশি মনোযোগী। কারণ এখানে নিজের দলের লোক নিয়োগ দেয়া যাবে।

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

ইউজিসির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালে ১০৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে গবেষণায় বরাদ্দ না রাখা এবং ব্যয় দেখিয়েও কোনো কাজ না হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬০টি। এর আগের বছরগুলোতেও একই চিত্র ছিল। ২০১৫ সালে ৮৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এ সংখ্যা ছিল ২৮টি এবং ২০১৪ সালে ছিল ২৭টি।

ব্যয় থাকলেও প্রকাশনা নেই ২৫টিতে

এদিকে গবেষণাব্যয় দেখানোর পরও ২৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই কোনো প্রকাশনা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো- ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটি, শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি, মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইসলামি ইউনিভার্সিটি, বরেন্দ্র ইউনিভার্সিটি, নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, খাজা ইউনুস আলী ইউনিভার্সিটি, চিটাগাং ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, টাইমস ইউনিভার্সিটি, নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, রণদা প্রসাদ সাহা বিশ্ববিদ্যালয়, জার্মান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, গ্লোবাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, সিসিএন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, আর্মি ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (বিএইউএসটি) সৈয়দপুর, আর্মি ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি কাদিরাবাদ, দি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব স্কলার্স, কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, এনপিআই ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি চট্টগ্রাম, রবীন্দ্র সৃজন কলা বিশ্ববিদ্যালয় কেরানীগঞ্জ, ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ।

এনএম/টিএম/এমএআর