পি কে হালদারের নেতৃত্বে চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় হাজার কোটি টাকা, বিষয়টি তদন্ত করছে দুদক

আলোচিত প্রশান্ত কুমার হালদারের (পি কে হালদার) নেতৃত্বে চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা সরিয়ে নেওয়া হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন টিম কেন তা আগে উদঘাটন করতে পারেনি, এটি ইচ্ছাকৃত গাফিলতি ছিল কি না— প্রভৃতি বিষয় খতিয়ে দেখছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

বিগত পাঁচ বছরে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (আইএলএফএসএল), পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড এবং বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি) নিয়মিত অডিট করলেও পরিদর্শন টিম আসলে কী করেছে, মূলত সে বিষয়টি খতিয়ে দেখছে রাষ্ট্রীয় দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি।

সম্প্রতি দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বরাবর পাঠানো চিঠিতে এ বিষয়ে জানতে চেয়েছে দুদকের অনুসন্ধান টিম। অনুসন্ধান টিম প্রধান ও দুদক পরিচালক বেনজীর আহম্মেদ স্বাক্ষরিত চিঠির সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।

পি কে হালদারের কারসাজিতে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও এফএএস ফাইন্যান্স থেকে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা লোপাটের প্রমাণ পেয়েছে দুদকের অনুসন্ধান টিম। যেখানে পি কে হালদার চক্র ২০টির মতো কাগুজে প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে ঋণের নামে ওই টাকা বের করে নেয়

এ বিষয়ে দুদক পরিচালক বেনজীর আহম্মেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বিগত পাঁচ বছরের অডিট রিপোর্টসহ চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিদর্শন টিমের সদস্যদের নাম জানতে চেয়েছি চিঠিতে। কারণ, গ্রেফতার হওয়া আসামিরা ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, তারা পরিদর্শক টিমের সদস্যদের ম্যানেজ করেই এসব অপকর্ম করেছেন। আমাদের ধারণা অডিট প্রতিবেদনে যদি যথাযথ তথ্য-উপাত্ত থাকত তাহলে এমন লুটপাট বন্ধ করা যেত। অডিট প্রতিবেদন ও চিঠির জবাব পাওয়ার পর পর্যায়ক্রমে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’

পি কে হালদার কেলেঙ্কারিতে দুদকের হাতে আটক তার সহযোগীরা 

‘কারও কোনো ইচ্ছাকৃত গাফিলতি বা কু-মতলব উদঘাটিত হলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে’ বলেও জানান দুদক কর্মকর্তা।

অন্যদিকে, অনুসন্ধান টিমের সদস্য দুদক উপ-পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তথ্য-উপাত্ত চেয়ে চিঠি পাঠানো হলেও জবাব এখনো পাওয়া যায়নি। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার অপেক্ষায় আছি। আমাদের কাজ চলছে। অনুসন্ধান কাজ দ্রুত শেষ করতে চাই।’

দুদক চিঠির মূল বক্তব্য

পি কে হালদার দায়িত্বে থাকার সময় পাঁচ বছরে পিপলস লিজিং, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও এফএএস ফাইন্যান্সের দুর্নীতি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দল কেন উদঘাটন করতে পারল না, পরিদর্শক দলের সার্বিক কর্মকাণ্ড কী ছিল এবং অডিট প্রতিবেদনগুলো অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে পাঠাতে অনুরোধ করা গেল।

এদিকে, পি কে হালদারের কারসাজিতে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও এফএএস ফাইন্যান্স থেকে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা লোপাটের প্রমাণ পেয়েছে দুদকের অনুসন্ধান টিম। যেখানে পি কে হালদার চক্র ২০টির মতো কাগুজে প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে ঋণের নামে ওই টাকা বের করে নেয়। পি কে হালদারসহ অন্তত ৭০ জনের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করে কমিশনে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে দুদক। যা এখন কমিশনের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানা গেছে।

দুদকের একাধিক সূত্র জানায়, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (আইএলএফএসএল) ও এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড থেকে প্রায় ২০টি কাগুজে প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে মর্টগেজ ছাড়াই প্রায় এক হাজার ৫০০ কোটি টাকার জালিয়াতিপূর্ণ ঋণ দেওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। আরবি এন্টারপ্রাইজ, জিঅ্যান্ডজি এন্টারপ্রাইজ, তামিম অ্যান্ড তালহা এন্টারপ্রাইজ, ক্রসরোড করপোরেশন, মেরিন ট্রাস্ট নিউটেক, এমএসটি মেরিন, গ্রিন লাইন ডেভেলপমেন্ট, মেসার্স বর্ণসহ প্রায় ২০টির মতো অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে দেওয়া ওই ঋণ নিয়ে চলেছে লুটপাট। লুটপাটের নেতৃত্ব দিয়েছেন পি কে হালদার, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও এমডিসহ ঊর্ধ্বতনরা।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিদর্শন টিমের সদস্যদের ম্যানেজ করেই অর্থ লুটপাটের ঘটনা ঘটে, স্বীকার করেন আটকরা  

পি কে হালদারের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ

এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি বিভিন্ন কৌশলে নামে-বেনামে অসংখ্য কোম্পানি খুলে শেয়ারবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ শেয়ার কেনেন এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে নিজের আত্মীয়, বন্ধু ও সাবেক সহকর্মীসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে পর্ষদে বসিয়ে অন্তত চারটি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নেন।

কোম্পানিগুলো হলো- ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (আইএলএফএসএল), পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড এবং বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি)। এসব কোম্পানি থেকে তিনি ঋণের নামে বিপুল অঙ্কের টাকা সরিয়ে বিদেশে পাচার করেছেন।

পি কে হালদারের বিরুদ্ধে মামলা

ক্যাসিনো অভিযানের ধারাবাহিকতায় প্রায় ২৭৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে পি কে হালদারের বিরুদ্ধে প্রথম মামলা করে দুদক। গত ৮ জানুয়ারি দুদকের অনুরোধে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা দিয়ে রেড অ্যালার্ট জারি করে ইন্টারপোল।

রাজধানীর দুর্নীতি দমন কমিশন কার্যালয় | ছবি- ঢাকা পোস্ট

দুদক উপ-পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধানের নেতৃত্বে আরও একটি টিম তার আর্থিক কেলেঙ্কারির বিষয়টি অনুসন্ধান করছে। ওই টিম এরই মধ্যে ১৫টি মামলা করেছে। ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা ভুয়া ঋণের নামে উত্তোলন করে আত্মসাতের অভিযোগে ৩৭ জনের বিরুদ্ধে ১০টি মামলা এবং ৩৫০ কোটি ৯৯ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ৩৩ শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পৃথক পাঁচটি মামলা করে দুদক।

গ্রেফতার ও স্বীকারোক্তি

পি কে হালদার কেলেঙ্কারিতে এখন পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছেন ১১ জন। যাদের মধ্যে উজ্জ্বল কুমার নন্দী ছাড়াও পি কে হালদারের সহযোগী শংখ বেপারী, রাশেদুল হক এবং সর্বশেষ অবান্তিকা বড়াল আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

আরএম/জেডএস/এমএআর/