বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া | ফাইল ছবি

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা আসলে কেমন? রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) চিকিৎসাধীন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর অবস্থা ‘এই ভালো, তো এই খারাপ’। তাকে কখনো অক্সিজেনের পরিমাণ বেশি দিতে হচ্ছে, কখনো সেটা কম লাগছে। ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা তার।

বেশ কিছুদিন ধরে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস ভোগাচ্ছে খালেদা জিয়াকে। তার সুগার লেভেল কখনো ১৪ আবার কখনো ১৮ থেকে ২০ এ গিয়ে ঠেকছে। সবমিলিয়ে গত কয়েকদিন ধরে তার শারীরিক অবস্থা ওঠা-নামার মধ্যে আছে। এদিকে, সরকারের কাছ থেকে চূড়ান্ত (লিখিত) অনুমতি না পাওয়ায় খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশযাত্রার প্রাক-প্রস্তুতিও আটকে আছে।

সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সদস্য ও বিএনপি নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে। তারা বলছেন, গত তিন দিন ধরে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা ওঠা-নামার মধ্যে আছে। শ্বাসকষ্ট বেশি হলে সেদিন তার অক্সিজেন লাগছে চার লিটারের মতো। কম হলে দুই লিটারে কাজ হচ্ছে। ডায়াবেটিসের মাত্রাও অনিয়ন্ত্রিত। এছাড়া, গত কয়েকদিন ধরে রক্তসহ শরীরের যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে সেগুলোর রিপোর্টও খুব বেশি ভালো নয়। এর মধ্যে তার রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে গেছে। তবে, ভালো দিকটি হলো, এখন পর্যন্ত খালেদা জিয়ার মনোবল চাঙা আছে। যা একজন রোগীর প্রধান ওষুধ।

শুক্রবার (৭ মে) রাতে খালেদা জিয়ার সর্বশেষ শারীরিক অবস্থা নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘মেডিকেল বোর্ড পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে যে চিকিৎসা দিয়েছিল সেটি এখনও অব্যাহত আছে। তার অবস্থা বর্তমানে স্থিতিশীল। তার জন্য সবার কাছে দোয়া কামনা করছি।’

বর্তমানে এভারকেয়ার হাসপাতালের সিসিইউতে চিকিৎসাধীন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী

বিদেশে যাওয়ার মতো তার শারীরিক সক্ষমতা আছে কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. জাহিদ বলেন, ‘তার বিদেশ যাওয়ার বিষয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে আবেদন জানানো হয়েছে, এটি আপনারা জানেন। সরকার কীভাবে তাকে যাওয়ার অনুমতি দেবে, সেটি সরকারের বিষয়। বর্তমানে তিনি দেশের স্বনামধন্য চিকিৎসকদের নিয়ে গঠিত বোর্ডের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন।’

‘আপনারা যে প্রশ্নটি করেছেন, সেটি এখন রিলেটেড (সম্পর্কিত) নয়। সরকার অনুমতি দিলে পরবর্তী সময়ে তার মেডিকেল বোর্ড এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে’— বলেন তিনি।

খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার বিষয়ে জানতে চাইলে মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসক ডা. আল মামুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমাদের সিদ্ধান্ত হয়েছে, ম্যাডামের শারীরিক বিষয়ে দলের মহাসচিব আপনাদের জানাবেন। আমরা কিছু বলব না। আমি এখনও ম্যাডামের সামনে আছি। কিন্তু কিছু বলতে পারব না।’

তবে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খালেদা জিয়ার মেডিকেল বোর্ডের অপর এক সদস্য ঢাকা পোস্টকে বলেন, “অবস্থার অবনতি হয়নি অর্থ এখনও ‘স্থিতিশীল’ আছেন তিনি। নিয়মিত তাকে অক্সিজেন দিতে হচ্ছে। সেটা প্রতিদিন দুই থেকে চার লিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে। ডায়াবেটিস আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। অর্থাৎ, কারাবন্দি অবস্থায় বিএসএমএমইউ (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) হাসপাতালে থাকতে তার ডায়াবেটিস সব সময় ১৪-এর ওপরে থাকত, এখন ওই অবস্থায় আছে। মাঝে মাঝে সেটা ১৮-তে গিয়ে ঠেকে। মুক্তি পাওয়ার পর আমরা তার চিকিৎসা শুরু করি। এ সময় তা ৮-এর মধ্যে চলে এসেছিল।”

তিনি আরও বলেন, ‘শ্বাসকষ্টের জন্য অক্সিজেন, ফুসফুসের সংক্রমণ ঠেকাতে অ্যান্টিবায়োটিক এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ইনসুলিন দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া অন্য ওষুধ তো চলছেই। তার খাবারের রুচি যে খুব ভালো, সেটাও বলা যাবে না।’

সিটি স্ক্যানের জন্য গত ১৫ এপ্রিল রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে যান খালেদা জিয়া

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য বলেন, ‘গতকাল (বৃহস্পতিবার) চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে দলের কাছে ম্যাডামের চিকিৎসার বিষয়ে যে আপডেট দেওয়া হয়েছে তাতে তার শারীরিক অবস্থার কিছুটা অবনতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সেটা হচ্ছে, আগের চেয়ে তার অক্সিজেনের পরিমাণ বেশি লাগছে। তার রক্তের পরীক্ষার রিপোর্টও ভালো নয়। এর বাইরে আমাদের কাছে আর কোনো তথ্য নেই।’

বিএনপির নেতারা বলছেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে বিদেশ নেওয়ার বিষয়ে সরকার এখনো লিখিতভাবে অনুমতি দেয়নি। অন্যদিকে, ম্যাডামের পাসপোর্টও হাতে পৌঁছায়নি। ফলে তার বিদেশ যাওয়ার বিষয়টি প্রাক-প্রস্তুতিতে আটকে আছে। কারণ, সরকারের লিখিত অনুমতি পাওয়ার পরই চার্টার্ড ফ্লাইট বা এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের ফ্লাইটের সময় নির্ধারণ করে বুকিং দিতে হবে। সরকারের অনুমতির ওপর নির্ভর করে লন্ডনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতিপত্র এবং হাসপাতালে ভর্তির বিষয়টি চূড়ান্ত করতে হবে।

তারা বলছেন, সরকারের অনুমতি না পাওয়া গেলে এসব প্রক্রিয়া তো শুরু করা যাচ্ছে না। অনুমতি পেলে বিষয়গুলো ঠিক করতে তিন ঘণ্টার মতো সময় লাগবে। খালেদা জিয়ার বিদেশ নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, সরকার এখনও তাকে বিদেশ নেওয়ার অনুমতি দেয়নি। বিষয়টি তার পরিবার দেখভাল করছে।
 
এ বিষয়ে জানতে খালেদা জিয়ার বোন সেলিমা ইসলামকে একাধিকবার ফোন দেওয়া হয়। কিন্তু তার কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

বিদেশ যাওয়ার বিষয়ে খালেদা জিয়া ‘অবগত কি না’— জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপি চেয়ারপারসনের ঘনিষ্ঠ এক সূত্র ঢাকা পোস্টকে জানায়, ম্যাডামের সম্মতিতে বিদেশযাত্রার আবেদন এবং অন্যান্য বিষয়ে প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।

গত ২৭ এপ্রিল রাতে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয় খালেদা জিয়াকে

এদিকে, চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়ার বিদেশ যাওয়া নিয়ে শুক্রবার বিকেলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি। আজ তো জুমাতুল বিদা। হয়ে যাবে (সিদ্ধান্ত)। খুব শিগগিরই হবে।’

আজ পাওয়া যাবে পাসপোর্ট
 
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, পুরাতন পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হওয়ায় খালেদা জিয়ার নতুন পাসপোর্টের জন্য আবেদন করা হয়। তার নতুন এমআরপি পাসপোর্ট প্রস্তুত আছে বলে আমাদের জানানো হয়েছে। আজ শুক্রবার সেটি আনার কথা।

শুক্রবার দুপুরে বিএনপি চেয়ারপারসনের একান্ত সচিব এ বি এম আব্দুস সাত্তার এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ম্যাডামের নতুন পাসপোর্ট এখনও হাতে পৌঁছায়নি। রেডি হয়েছে। ফোন দিলে গিয়ে নিয়ে আসব।’
 
সিঙ্গাপুর নয়, কেন লন্ডনে চিকিৎসা

বিএনপির নেতারা বলছেন, খালেদা জিয়ার বর্তমান শারীরিক অবস্থা দীর্ঘ সময় ভ্রমণের জন্য খুব বেশি উপযুক্ত নয়। কিন্তু তারপরও তাকে লন্ডনে নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। অনেকের প্রশ্ন, কেন কম দূরত্বের সিঙ্গাপুরে নেওয়া হচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত তিনটি কারণে তাকে লন্ডনে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। 

প্রথমত, সিঙ্গাপুরে নিলে তাকে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, খালেদা জিয়ার চিকিৎসা আগে লন্ডনে হয়েছে। এখনও তার মেডিকেল বোর্ডে লন্ডনের চিকিৎসক যুক্ত। সেখানকার হাসপাতালে তাকে ভর্তি করাও সহজ হবে। তৃতীয়ত, দীর্ঘ সময় চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে অবস্থান করতে হবে। কারণ, পোস্ট কোভিডের পাশাপাশি তার পুরাতন রোগ আর্থ্রাইটিস, চোখের সমস্যা, হাঁটু প্রতিস্থাপনের চিকিৎসা করাতে হবে। দীর্ঘ এ সময়ে সিঙ্গাপুরে তাকে দেখভাল করবেন কে? লন্ডনে তো ছেলে-পুত্রবধূরা আছেন। নাতনিরাও সেখানে আছেন। তারা যদি এই সংকটকালে পাশে থাকেন তাহলে মানসিকভাবেও চাঙা থাকবেন খালেদা জিয়া।

সর্বশেষ ২০১৭ সালে লন্ডনে চিকিৎসা নিয়েছিলেন সাবেক এ প্রধানমন্ত্রী। সেখানে তার মেডিকেল বোর্ডের সদস্য ও পুত্রবধূ চিকিৎসক জোবাইদা রহমান আছেন। আছেন ছেলে তারেক রহমানও। তাই সবদিক বিবেচনায় খালেদা জিয়াকে লন্ডনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত।
 
এএইচআর/এমএআর/