দেশে চলমান বিভিন্ন প্রকল্প থেকে ৭২৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বিশ্বব্যাংক। দেশীয় মুদ্রায় এ অর্থের পরিমাণ প্রায় আট হাজার ৬৪৫ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১১৯.৫৮ টাকা ধরে)। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য প্রকল্পগুলো নেওয়া হয়েছিল। বিশ্বব্যাংক বিভিন্ন প্রকল্প থেকে এ অর্থ প্রত্যাহার করলেও নতুন ও গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে অর্থব্যয় করতে সম্মত হয়েছে। সবমিলিয়ে চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশকে তিন বিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩৫ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা) আর্থিক সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে সংস্থাটি।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। এ সংক্রান্ত বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সাধারণ সভার কার্যবিবরণী সম্প্রতি উপদেষ্টা পরিষদে পাঠিয়েছে ইআরডি।

ইআরডি-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, দেশে চলমান ধীরগতি ও কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প থেকে ৭২৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রত্যাহার করবে বিশ্বব্যাংক। তবে, প্রত্যাহার করা অর্থ নতুন ও গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্তও নিয়েছে সংস্থাটি। এ ছাড়া চলমান ঘোড়াশাল পলাশ ইউরিয়া ফার্টিলাইজার প্রজেক্ট অ্যাট থার্ড ইউনিট রি-পাওয়ারিং প্রকল্পে দ্য মাল্টিলেটারাল ইনভেস্টমেন্ট গ্যারান্টি এজেন্সির (এমআইজিএ) নিশ্চয়তার আওতায় অর্থায়ন করবে বিশ্বব্যাংক। পাশাপাশি পেট্রোবাংলাকেও অর্থায়নের বিষয়ে আশ্বস্ত করা হয়েছে।

এ ছাড়া এমআইজিএ নতুন করে হংকং অ্যান্ড সাংহাই ব্যাংকিং কর্পোরেশন (এইচএসবিসি) থেকে দুই কিস্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ট্রেড ফাইন্যান্স (এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড) গ্রহণে নিশ্চয়তা দিতে সম্মত হয়েছে। সবমিলিয়ে চলতি অর্থবছরে প্রায় ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থাৎ প্রায় ৩৫ হাজার ৮৭২ কোটি টাকার আর্থিক সহায়তা মিলেছে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে।

গত অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংক গ্রুপ ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বার্ষিক সভায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। বিশ্বব্যাংক গ্রুপ ও আইএমএফসহ বেশকিছু সংস্থার সঙ্গে পার্শ্বসভায় অংশ নেয় বাংলাদেশ। ওই সভায় বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অপারেশন্স) আনা বিয়ার্ড ও দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্টিন রেজারসহ অন্যান্য সংস্থার প্রতিনিধিরা এ ঋণ সহায়তা দেওয়ার কথা জানান। ওই সভায় লিকুইডিটি গ্যারান্টি ফ্যাসিলিটি প্রদানের প্রতিশ্রুতিও দেয় বিশ্বব্যাংক।

ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর মুদ্রানীতি গ্রহণ, মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত সংস্কার, বৈশ্বিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্ষয়রোধসহ বহিঃচাপ নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, রাজস্ব আয় বৃদ্ধি এবং বাজেট বাস্তবায়নে সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়ে আইএমএফ গুরুত্বারোপ করে। অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে সরকারের ইতোমধ্যে নেওয়া সংস্কার কার্যক্রমগুলো বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি কমানো এবং রাজস্ব আয় বৃদ্ধিতে গৃহীত পদক্ষেপগুলোও সংক্ষেপে উপস্থাপন করে বাংলাদেশ। এ ছাড়া ব্যাংক খাত সংস্কার, রিকভারি অব অ্যাকসেস, অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংস্কার ও শক্তিশালী করাসহ বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেওয়া অন্যান্য সংস্কার কার্যক্রমে আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতা করার আশ্বাস দেয় সংস্থাটি।

এ ছাড়া অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের সামষ্টিক অর্থনীতি অনুবিভাগের পূর্বাভাস প্রণয়নের সক্ষমতা অধিকতর শক্তিশালীকরণ, আইএমএফের ঝুঁকি টুলকিট ব্যবহার করে বিভিন্ন আর্থিক ঝুঁকি মূল্যায়নের জন্য সামষ্টিক অর্থনীতি শাখার সক্ষমতা বৃদ্ধি, ট্রান্সপোর্টেশন সিকিউরিটি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (টিএসএ), স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠান অন্তর্ভুক্তকরণ এবং রাজস্ব ও ব্যয় ব্যবস্থাপনার জন্য গতিশীল ড্যাশবোর্ড তৈরি করার বিষয়ে সহযোগিতা চাওয়া হয় সংস্থাটির কাছে। বাজেট ব্যবস্থায় ক্লাসিফিকেশন অব ফাংশনস অব গভর্নমেন্ট (সিওএফওজি) প্রবর্তন এবং বাজেটের বিভিন্ন খাতের সঙ্গে সিওএফওজি’র সংযোগসাধন, ফরোয়ার্ড বেসলাইন এস্টিমেট প্রবর্তন, পরিচালন কাঠামো অন্তর্ভুক্তি করে জলবায়ুর আর্থিক কাঠামো উন্নতকরণ, এসওই সংশ্লিষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত সম্পদের ব্যবস্থাপনা এবং এসওই থেকে আর্থিক ঝুঁকির মূল্যায়নের পাশাপাশি এসওই পারফরম্যান্স মূল্যায়ন ও উন্নতিতে সহায়তা প্রদান, কর্পোরেট গভর্নেন্স, কোড অব কন্ডাক্ট এবং পাবলিক সেক্টরের ঋণ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনা হয়। ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ব্যবধান কমাতে কর সংগ্রহ বাড়ানোর জন্য সুনির্দিষ্ট রাজস্ব নীতি, বিদ্যুতের শুল্ক বৃদ্ধি এবং রেমিট্যান্স ভর্তুকি বাদ দেওয়াসহ ভর্তুকি ব্যয় যৌক্তিক করার পরিকল্পনা, এনবিআর থেকে করনীতি সংক্রান্ত কার্যক্রম আলাদা করার বিষয়েও আলোচনা করা হয় সভায়। আইএমএফ বাংলাদেশ সরকারের নেওয়া সংস্কার কার্যক্রম সম্পাদন ও বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায় সব ধরনের সহায়তা করবে বলে আশ্বাস দিয়েছে বলে জানান কর্মকর্তারা।

গত অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংক গ্রুপ ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বার্ষিক সভায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। বিশ্বব্যাংক গ্রুপ ও আইএমএফসহ বেশকিছু সংস্থার সঙ্গে পার্শ্বসভায় অংশ নেয় বাংলাদেশ। ওই সভায় বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অপারেশন্স) আনা বিয়ার্ড ও দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্টিন রেজারসহ অন্যান্য সংস্থার প্রতিনিধিরা এ ঋণ সহায়তা দেওয়ার কথা জানান। ওই সভায় লিকুইডিটি গ্যারান্টি ফ্যাসিলিটি প্রদানের প্রতিশ্রুতিও দেয় বিশ্বব্যাংক

এদিকে, পার্শ্বসভায় এডিবি’র ভাইস প্রেসিডেন্ট য়িংমিং ইয়াং ১১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বাজেট সহায়তা দেওয়ার কথা জানান (৭০০-৮০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পলিসি বেইজ লোন)। চলমান প্রকল্পের আনডিসবার্সড ফান্ডের কমিটমেন্ট ফি, প্রকল্প প্রস্তুতকরণ, ডিজিটাল প্রযুক্তি, জ্বালানি নিরাপত্তা ও বন্যা-পরবর্তী পুনর্বাসনে আর্থিক সহায়তার কথাও জানানো হয়। এআইআইবি’র প্রেসিডেন্ট জিন লিকুইনের সঙ্গেও বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের বৈঠক হয়। বাংলাদেশের গ্যাস সরবরাহ লাইনে লিকেজ নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত প্রকল্পে অর্থায়ন করা হবে বলে জানান জিন। এ ছাড়া ৭০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাজেট সাপোর্ট এবং পাইপ লাইনভুক্ত প্রকল্পে অর্থায়নের বিষয়েও আলোচনা হয়।

ওপেক প্রেসিডেন্ট ড. আব্দুল্লাহ হামি আল-খালিফা সংস্থাটির ফান্ড থেকে তাৎক্ষণিক ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বাজেট সাপোর্ট প্রদানে আশ্বাস দেন। বাংলাদেশে প্রতি বছর একাধিক প্রকল্পে অর্থায়ন, তিন বছর মেয়াদের বিজনেস প্ল্যান প্রস্তুতকরণ, বেসরকারি ও জ্বালানি খাতে কো-ফাইন্যান্সিং এবং বাৎসরিক দ্বিপাক্ষিক সভা আয়োজনের বিষয়েও আলোচনা করে বাংলাদেশ।

ইতোমধ্যে ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (আইএফসি) বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, জ্বালানি, আর্থিক ও এগ্রো বিজনেসসহ বিভিন্ন বেসরকারি খাতে অর্থায়ন করে যাচ্ছে। গ্রুপ সভায় আইএফসি তাদের কার্যক্রমে বিদ্যুৎ উৎপাদন, প্রতিযোগিতামূলক ক্রয়, জ্বালানি নিরাপত্তা, সার, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, স্বল্পমূল্যে গৃহায়ন এবং স্থানীয় সরকারের সক্ষমতা বৃদ্ধির ক্ষেত্র সম্প্রসারণে আগ্রহ প্রকাশ করে। এ ছাড়া সংস্থাটি কান্ট্রি প্রাইভেট সেক্টর ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট চূড়ান্ত করার আগে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের নিয়ে একটি ওয়ার্কশপ করার বিষয়েও আগ্রহ প্রকাশ করে। বিশ্বব্যাংকের অঙ্গ-প্রতিষ্ঠান আইএফসি’র রিজিওনাল ভাইস প্রেসিডেন্ট রির্কাডো পুলিটি এবং এমআইজিএ ভাইস প্রেসিডেন্ট ইথিওপিস তাফারার সঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের দ্বিপাক্ষিক আলোচনা হয়।

দেশে চলমান ধীরগতি ও কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প থেকে ৭২৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রত্যাহার করবে বিশ্বব্যাংক। তবে, প্রত্যাহার করা অর্থ নতুন ও গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্তও নিয়েছে সংস্থাটি। এ ছাড়া চলমান ঘোড়াশাল পলাশ ইউরিয়া ফার্টিলাইজার প্রজেক্ট অ্যাট থার্ড ইউনিট রি-পাওয়ারিং প্রকল্পে দ্য মাল্টিলেটারাল ইনভেস্টমেন্ট গ্যারান্টি এজেন্সির (এমআইজিএ) নিশ্চয়তার আওতায় অর্থায়ন করবে বিশ্বব্যাংক। পাশাপাশি পেট্রোবাংলাকেও অর্থায়নের বিষয়ে আশ্বস্ত করা হয়েছে

ইআরডির বিশ্বব্যাংক শাখার যুগ্ম-সচিব মুহাম্মদ রেজাউল করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিষয়গুলো সম্পর্কে পুরোপুরি বলতে পারব না। কারণ, এগুলোর কোনো সিদ্ধান্ত আমার কাছে নেই। আমরা খণ্ড খণ্ড জানি। পুরো বিষয়ে জানতে হলে অফিসে এসে উইং-প্রধানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।

বিশ্বব্যাংকের অর্থ প্রত্যাহার প্রসঙ্গে ইউসিএসআই ইউনিভার্সিটির ডেপুটি ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. এ কে এনামুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, অতীতে ওরা (বিশ্বব্যাংক) অনেক প্রকল্পেই অর্থায়ন করেছে। যেগুলোতে বাস্তবিক অর্থে ফাইন্যান্স করা উচিত ছিল না। সব ছিল রাজনৈতিকভাবে স্বার্থ হাসিলের প্রকল্প। তারা (বিশ্বব্যাংক) এখন প্রত্যাহার করছে অর্থাৎ তারা বুঝতে পারছে। এগুলো নিয়ে আমাদের অর্থনৈতিক শ্বেতপত্র কমিটিতেও সমালোচনা ছিল। জেনেশুনেই তারা অনেক প্রকল্পে অর্থায়ন করেছিল। যেটা করা উচিত ছিল না। তারা একটু স্বতন্ত্র হতে পারত।

‘বিশ্বব্যাংক শুনেই হোক বা না শুনেই হোক; মূল বিষয় হচ্ছে তারা যেন নিরপেক্ষভাবে সবসময় চিন্তা করে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর বাইরেও তাদের কারও না কারও কাছে দায়বদ্ধ থাকা উচিত। কারণ, আমি প্রকল্প দিলাম আবার সরিয়ে নিলাম; এটা অনেকটা বাংলাদেশের ডিসি-এসপিদের বদলির মতো। এটা কোনো দায়বদ্ধতা হলো না। এটা অনেকটা নিজেকে রক্ষা করার স্ট্র্যাটেজি। মানে, দুর্বলতা ঢেকে রাখার কৌশল। সুতরাং যদি তারা এ কারণেই করে থাকে তাহলে এ ঘটনা কীভাবে ঘটল, সেটাও তাদের জানা উচিত এবং জানানো উচিত। ভবিষ্যতে এমন কোনো কিছু যেন না ঘটে, সেজন্য তাদের দায়িত্ব নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’

এসআর/এমএআর/