ধর্মভিত্তিক দলগুলোর ‘নির্বাচনী সমঝোতা’ হবে কি?
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ধর্মভিত্তিক কয়েকটি দল নিজেদের মধ্যে একটি ‘নির্বাচনী সমঝোতা’ তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে চলতি বছরের জুন মাসে ছয়টি ইসলামী দল মিলে একটি লিয়াজোঁ কমিটি গঠন করে। যদিও ইতোমধ্যে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম সরে গিয়ে বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করেছে। বর্তমানে পাঁচটি দল এই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও জামায়াতকে অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে তাদের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি দেখা দিয়েছে। জামায়াত ইস্যুসহ একে-অপরের প্রতি আস্থাহীনতার কারণে শেষ পর্যন্ত এই সমঝোতা চূড়ান্ত রূপ পাবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
ধর্মভিত্তিক দলগুলোর নির্বাচনী সমঝোতা কিংবা ‘এক মঞ্চে’ আসার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে প্রাথমিক সমঝোতা হয়েছিল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, নেজামে ইসলাম পার্টি (একাংশ) ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মধ্যে। সেখান থেকে ইতোমধ্যে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বেরিয়ে গেছে। বর্তমানে পাঁচটি দল দুজন করে সদস্য নিয়ে লিয়াজোঁ কমিটি গঠন করেছে। তারা কয়েক দফা বৈঠক করলেও এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি।
বিজ্ঞাপন
ধর্মভিত্তিক দলগুলোর নির্বাচনী সমঝোতা কিংবা ‘এক মঞ্চে’ আসার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে প্রাথমিক সমঝোতা হয়েছিল ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, নেজামে ইসলাম পার্টি (একাংশ) ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মধ্যে। সেখান থেকে ইতোমধ্যে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বেরিয়ে যায়। বর্তমানে পাঁচটি দল দুজন করে সদস্য নিয়ে লিয়াজোঁ কমিটি গঠন করেছে। তারা কয়েক দফা বৈঠক করলেও এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি
তবে, নির্বাচনের সময়সূচি নির্ধারিত হলে বিষয়টি চূড়ান্ত রূপ নেবে বলে মনে করেন তারা। ধর্মভিত্তিক দলগুলোর নেতারা বলছেন, গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনকে মাথায় রেখে কওমি মাদ্রাসা ঘরানা ও ধর্মভিত্তিক সমমনা দলগুলোকে ‘এক মঞ্চে’ আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এর উদ্দেশ্য, যাতে প্রত্যেক সংসদীয় আসনে সবগুলো ধর্মভিত্তিক দল একজন প্রার্থী দিতে পারে এবং তাদের সব ভোট যেন এক বাক্সে পড়ে। এছাড়া, ধর্মভিত্তিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ থাকলে তখন অন্য দলগুলোর সঙ্গে জোট হলে আসন ছাড়ের বিষয়ে ‘দর-কষাকষি’ করতে সুবিধা হবে এবং বড় ধরনের ছাড় পাওয়ারও সম্ভাবনা তৈরি হবে।
এ প্রসঙ্গে ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা ইউনুস আহমদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, “এটা চলমান। এখনো মাঝেমধ্যে আমাদের মধ্যে বৈঠক হচ্ছে। নিজেদের মধ্যে অগ্রগতির জন্য একটি লিয়াজোঁ কমিটি গঠন করা হয়েছে। অর্থাৎ, সর্বশেষ ফলাফল ভালো।”
বিজ্ঞাপন
এদিকে, দলগুলোর নেতারা বলছেন, সবচেয়ে বড় জটিলতা তৈরি হয়েছে জামায়াতে ইসলামীর অংশগ্রহণ ঘিরে। কেউ মনে করছেন নির্বাচনী সমঝোতা আদর্শিক জোট নয়, তাই জামায়াতও থাকতে পারে। আবার অনেকে মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের বিতর্কিত ভূমিকার কারণে তাদের অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করছেন।
আরও পড়ুন
এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত দুটি দলের শীর্ষনেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “ইতোমধ্যে খবর বেরিয়েছে যে, জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপির সঙ্গে আসন সমঝোতার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও তারা এর প্রতিবাদ করেছেন। এই ধরনের উদ্যোগ যদি দলটি গ্রহণ না করে, তাহলে বিষয়টি সামনে আসবে কেন? তারা যদি বিএনপির সঙ্গে আসন সমঝোতা করে নির্বাচন করে, তাহলে আমরা কেন তাদেরকে সঙ্গে রাখব? আমরা নিজেরাই তো বিএনপির সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা করতে পারি।”
দুটি দলের শীর্ষনেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “ইতোমধ্যে খবর বেরিয়েছে যে, জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপির সঙ্গে আসন সমঝোতার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও তারা এর প্রতিবাদ করেছেন। এই ধরনের উদ্যোগ যদি দলটি গ্রহণ না করে, তাহলে বিষয়টি সামনে আসবে কেন? তারা যদি বিএনপির সঙ্গে আসন সমঝোতা করে নির্বাচন করে, তাহলে আমরা কেন তাদেরকে সঙ্গে রাখব?
আপনাদের ঐক্যের মধ্যে ধর্মভিত্তিক কোন কোন দল থাকছে— জানতে চাইলে মাওলানা ইউনুস বলেন, “আলোচনার মধ্যে আছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস, নেজামে ইসলাম পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোটসহ আরও অনেকের সঙ্গে কথাবার্তা চলছে।”
“এখন আপাতত প্রত্যেক দল নিজ নিজ সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে যাবে। যখন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হবে, তখন নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে আসন বণ্টন করব।”
খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমদ আব্দুল কাদের ঢাকা পোস্টকে বলেন, “আমাদের সমমনাদের মধ্যে একটি লিয়াজোঁ কমিটি হয়েছে। আলোচনা চলছে। কিন্তু ‘নির্বাচনী সমঝোতা’ কিংবা ‘এক মঞ্চে’ আসার বিষয়ে এখনো কিছু হয়নি।”
“লিয়াজোঁ কমিটিতে জামায়াতে ইসলামী নেই। তাদের সঙ্গে এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো আলোচনা হয়নি। ব্যক্তিপর্যায়ে কেউ কেউ তাদের সঙ্গে কথা বলছেন, কিন্তু আমাদের ভেতরে জামায়াত নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো আলোচনা হয়নি।”
“ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে কোনো আদর্শিক জোট হচ্ছে না”— জানিয়ে আহমদ আব্দুল কাদের আরও বলেন, “এটা কোনো জোট না, নির্বাচনী সমঝোতা। এক আসনে আমরা সবাই মিলে একজন প্রার্থী দিতে পারি কি না, সেটাই সমঝোতা করা।”
আরও পড়ুন
বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের ‘নির্বাচনী সমঝোতা’ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “এমন চেষ্টা চলছে— আমাদের কানেও এসেছে এমন খবর। কিন্তু এটি আমরা এখনো যাচাই করতে পারিনি।”
নির্বাচনী সমঝোতার সঙ্গে যুক্ত থাকা একটি দলের শীর্ষনেতা ঢাকা পোস্টকে বলেন, “জামায়াতকে নিয়ে আমাদের মধ্যে একটি সমস্যা আছে, সেটা তো জানেন। তাই শেষ পর্যন্ত যদি ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনী সমঝোতা হয়, সেখানে যদি জামায়াত থাকে, তাহলে আমরা দলীয় ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব— আমরা থাকব কি থাকব না। আমার ধারণা, জামায়াত থাকলে এর মধ্যে আমাদের দল থাকবে না। পাশাপাশি ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা হওয়ার সম্ভাবনাও খুব কম।”
বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের সাংগঠনিক সম্পাদক মুফতি সুলতান মহিউদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, “প্রথমত, আমাদের দলের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, সমমনা ছয়টি ইসলামী দলের সঙ্গে ঐক্য করতে কোনো দ্বিমত নেই। আর জামায়াতের সঙ্গে ঐক্য হবে কি না, সেই বিষয়ে এখন পর্যন্ত আমাদের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, যখন জামায়াতের ইস্যুটি সামনে আসবে, তখন দলীয় ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”
নিজেদের মধ্যে ঐকমত্য গঠন প্রসঙ্গে দলগুলোর নেতারা বলছেন, ধর্মভিত্তিক দলগুলো যদি শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে যে নিজেদের মধ্যে নির্বাচনী সমঝোতা করবে, তখন পরবর্তী ধাপ নিয়ে আলোচনা হবে। সেখানে আসবে এই সমঝোতার কাঠামো কী হবে, কোন দল কত প্রার্থী দেবে বা ধর্মভিত্তিক দলগুলো অন্য কারও সঙ্গে সমঝোতা করবে কি না কিংবা এই জোটে অন্য কোনো দলকে যুক্ত করা হবে কি না— এসব বিষয় আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
আরও পড়ুন
ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি সাখাওয়াত হোসেন রাজী ঢাকা পোস্টকে বলেন, “এখানে তিনটি ধাপ রয়েছে। প্রথমত, আমাদের কওমি মাদ্রাসা ঘরানার ইসলামী দলগুলো চেষ্টা করছে একটি সমঝোতায় পৌঁছাতে। দ্বিতীয় পর্যায়ে, ফ্যাসিবাদবিরোধী দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতা এবং তৃতীয় ধাপে, জামায়াতসহ অন্য দলগুলো আসবে কি না; এ বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।”
“এখন পর্যন্ত আমরা পাঁচটি দল নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করছি। বাকি দুটি ধাপ নিয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি।”
ধর্মভিত্তিক আরেকটি দলের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “লিয়াজোঁ কমিটি হলেও অন্যদের না জানিয়ে জামায়াতের সঙ্গে জোট গঠনে এককভাবে সবকিছু ঠিক করছে ইসলামী আন্দোলন। এতে আমাদের দল ও অন্যদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে।” তিনি আরও বলেন, “শুনছি জামায়াত বিএনপির কাছে একটি তালিকা দিয়েছে। তাহলে তাদের সঙ্গে জোট কীভাবে হবে?”
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আতাউল্লাহ আমীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, “আমরা ইসলামী জোট গঠনের জন্য শেষপর্যন্ত চেষ্টা করব। যদি হয় ভালো, না হলে আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত নেব। দলগতভাবে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার কাজ আমাদের চলমান, ইতোমধ্যে ২৭২টি আসনের প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে।”
আরও পড়ুন
অন্যদিকে, ধর্মভিত্তিক একাধিক দলের নেতারা বলছেন, সমমনা পাঁচটি ইসলামী দল ছাড়াও নির্বাচনী সমঝোতায় আরও কয়েকটি দলের যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এটি নিয়ে ইতোমধ্যে এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। যদিও গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর থাকার বিষয়ে আগ্রহ দেখালেও তার দলের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান আবার বিএনপির সঙ্গে নির্বাচন করতে বেশি আগ্রহী। এর বাইরে আরও কয়েকটি দলের সঙ্গে আলোচনা চলছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এবি পার্টির চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান মঞ্জু ঢাকা পোস্টকে বলেন, “শুধু ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনী সমঝোতা হলে আমরা সেখানে যাব না। অন্যান্য দল মিলে কিছু হলে আমরা সেখানে যেতে পারি।”
সংসদের উচ্চকক্ষে পিআর হলে বদলাবে সমীকরণ
“এখন পর্যন্ত সংসদের উচ্চকক্ষে পিআর হওয়ার সম্ভাবনা খুবই প্রবল। সেই ক্ষেত্রে খেলাফত মজলিস সারাদেশে এককভাবে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেবে। তখন আর কোনো জোটে যাব না আমরা”— নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খেলাফত মজলিসের শীর্ষপর্যায়ের এক নেতা এভাবে কথাগুলো বলেন ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদকের কাছে। তিনি আরও বলেন, “আমরা যদি সারাদেশে ৩০ থেকে ৪০ লাখ ভোট পাই, তাহলে উচ্চকক্ষে এক-দুটি আসন তো পাব। সুতরাং আমরা কোনো জোটে যাব না।”
বিপরীত মতও প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ। তারা বলছেন, সংসদে উচ্চকক্ষের পিআর হলে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে জোট হওয়ার সম্ভাবনা আরও বেশি তৈরি হবে। কারণ, তখন সবগুলো দলের ভোট একটি প্রতীকে এবং একটি বাক্সে আনা যাবে। ফলে ভোটের শতাংশে আমরা এগিয়ে যাব। শতাংশের হিসাবে তখন উচ্চকক্ষে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর আসন সংখ্যাও বেশি হবে।
তাদের যুক্তি, এককভাবে ভোটে অংশ নিলে নিম্নকক্ষে জয়ের সম্ভাবনা যেমন থাকবে না, তেমনি ইসলামী মূল্যবোধের ভোট ভাগ হওয়ার ফলে এককভাবে হয়তো সব দলের পক্ষে উচ্চকক্ষে আসন পাওয়ার সুযোগও থাকবে না। এছাড়া, শুধু পিআর নয়; বর্তমানে রাজনৈতিক কর্মীর বাইরে বিশাল একটি জনগোষ্ঠী রয়েছে। তারা পরিবর্তন চান। সেই প্রেক্ষাপটে ইসলামী দলগুলো যদি এক হতে পারে তখন একপাশে বিএনপি থাকবে, অন্যপাশে ইসলামী দলগুলোর জোট হবে। তখন হিসাব অনেক ভিন্ন হবে। পিআর-এর মাধ্যমে আমরা উচ্চকক্ষে কিছু পাব তো বটেই, একইসঙ্গে এই জোট ক্ষমতায় আসতে না পারলেও প্রধান বিরোধী দল হতে পারবে।
এএইচআর/এমএআর/