আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনের রোডম্যাপের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের পর গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জন্য এটি হবে প্রথম নির্বাচন। বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেও এনসিপির কার্যক্রম জুলাই সনদে আটকে আছে। দলটির মধ্যে নির্বাচনের জন্য দৃশ্যমান কোনো প্রস্তুতি নিতে এখনো দেখা যায়নি। তবে, প্রাথমিকভাবে দলটি নিবন্ধন বাছাইয়ে টিকে গেছে।

এনসিপি ৩০০ আসনে এককভাবে নির্বাচন করবে নাকি জোটবদ্ধভাবে করবে— তাও অস্পষ্ট। কাকে, কোন আসনে মনোনয়ন দেওয়া হবে, সেই কাজও প্রায় নিষ্ক্রিয়। তবে, যারা আগ্রহ দেখাচ্ছেন তাদের নাম তালিকাবদ্ধ করলেও ‘গণপরিষদ নির্বাচন’ না হলে তারা আসন্ন নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন না বলে দলটির একাধিক সূত্র জানিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, “সরকার কি গণপরিষদ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে? যদি না নেয়, তাহলে এটাকে নির্বাচনের প্রস্তুতি বলা যায় না। সরকার আসলে বুঝতে পারছে না যে গণপরিষদ নির্বাচন না হলে বাংলাদেশের কোনো নির্বাচনই গ্রহণযোগ্য হবে না। জুলাই সনদের বাস্তবায়ন গণপরিষদের মাধ্যমে করতে হবে। সরকারকে অবশ্যই গণপরিষদ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। সেজন্য যদি অতিরিক্ত কোনো নিরাপত্তা, অতিরিক্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়, সেটির দিকেই এগোনো উচিত, এটিই ভালো হবে।”

জামায়াত ও ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আসনভিত্তিক প্রার্থীর নাম ঘোষণা করলেও এনসিপি এই বিষয়ে প্রায় নিশ্চুপ। কোন আসনে কাকে প্রার্থী দেওয়া হবে, সেই কাজও শুরু করেনি দলটি। তবে, সারাদেশ থেকে অনেকেই দলটির কার্যালয়ে যোগাযোগ করছেন। অনেকে দলটির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে দেখা করে তাদের প্রার্থীর প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছেন। ৩০০ আসনে নিজেরাই প্রার্থী দেবে নাকি অন্য কোনো দলের সঙ্গে জোটবদ্ধভাবে নির্বাচনে অংশ নেবে, সেটিও এখনো স্পষ্ট করেনি দলটি। তবে এরই মধ্যে গণমাধ্যমে খবর এসেছে, বিএনপির সঙ্গে আসন বণ্টনের সমঝোতা হয়েছে

প্রচলিত পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে আপনারা অংশ নেবেন কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “গণপরিষদ নির্বাচন না হলে এনসিপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না বরং আন্দোলনে যাবে।”

দলীয় সূত্র মতে, গত দুই মাস আগে জাতীয় নাগরিক পার্টির একটি সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত ছিল, এনসিপি নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতি না করে অভ্যুত্থানের যে রাজনীতি সেই রাজনীতিতে ব্যস্ত থাকবে। সেটিই ছিল দলটির মূল কাজ। এরই মধ্যে জুলাই মাসে দেশব্যাপী পদযাত্রা করেছে দলটি। জুলাই মাসজুড়ে পদযাত্রা নিয়ে ব্যস্ত ছিল তারা। পদযাত্রার মাধ্যমে সাংগঠনিকভাবে দলকে পরিচিত ও শক্তিশালী করার লক্ষ্য ছিল বলে মনে করছেন দলটির নেতারা।

তবে, দলটির সার্বিক নির্বাচন কার্যক্রম মূলত জুলাই সনদের ওপর নির্ভর করছে। মৌলিক সংস্কারের ভিত্তিতে জুলাই সনদ করা এবং আইনি ভিত্তি দেওয়া হলে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করছে দলটি। এরই মধ্যে দলটির পক্ষ থেকে ‘গণপরিষদ’ নির্বাচনের ওপর জোর দাবি জানানো হয়েছে।

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে বিশাল জমায়েতের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে এনসিপি / ছবি- সংগৃহীত

এদিকে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে আহ্বায়ক করে চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি রাজনৈতিক দল এনসিপি প্রতিষ্ঠিত হয়। দল গঠনের ছয় মাস পার হলেও এখনো নিবন্ধন পায়নি তারা। তবে, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)সহ ১৫টি রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য নির্বাচন কমিশনের প্রাথমিক বাছাইয়ে টিকেছে। এখন এনসিপি’র মাঠপর্যায়ের তদন্ত চলছে। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর এ বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।

জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য কী কী প্রস্তুতি নিচ্ছে? আপনারা কি ৩০০ আসনে প্রার্থী দিতে পারবেন— এমন প্রশ্নের জবাবে দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব ঢাকা পোস্টকে বলেন, “আমাদের রাজনৈতিক দলের যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, সেই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে নির্বাচনও অন্যতম একটি অংশ। তবে, প্রাথমিকভাবে আমাদের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে মৌলিক সংস্কারের ভিত্তিতে আমাদের আইনি ও সাংবিধানিক ভিত্তি নিশ্চিত করার জন্য সংগ্রাম করা। সেই জায়গা থেকে এখন পর্যন্ত আমাদের নির্বাচনমুখী কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়নি। দেশের প্রায় প্রত্যেকটি উপজেলায় আমাদের সাংগঠনিক কাজ চলছে। সেখানে সংগঠনকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে শহীদ পরিবার, আহত এবং ওই এলাকার যারা সুশীল সমাজের মানুষ ও সাধারণ মানুষ আছেন, দলের বার্তা নিয়ে তাদের কাছে যাচ্ছেন।”

আরও জানা গেছে, জামায়াত ও ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আসনভিত্তিক প্রার্থীর নাম ঘোষণা করলেও এনসিপি এই বিষয়ে প্রায় নিশ্চুপ। কোন আসনে কাকে প্রার্থী দেওয়া হবে, সেই কাজও শুরু করেনি দলটি। তবে, সারাদেশ থেকে অনেকেই দলটির কার্যালয়ে যোগাযোগ করছেন। অনেকে দলটির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে দেখা করে তাদের প্রার্থীর প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছেন। ৩০০ আসনে নিজেরাই প্রার্থী দেবে নাকি অন্য কোনো দলের সঙ্গে জোটবদ্ধভাবে নির্বাচনে অংশ নেবে, সেটিও এখনো স্পষ্ট করেনি দলটি। তবে এরই মধ্যে গণমাধ্যমে খবর এসেছে, বিএনপির সঙ্গে আসন বণ্টনের সমঝোতা হয়েছে। রাজনৈতিক মহলেও তাদের জোটবদ্ধভাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়টি শোনা যাচ্ছে।

আসন বণ্টনের সমঝোতা প্রসঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টি তাদের প্রতিবাদলিপিতে জানায়, এই দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, মনগড়া এবং কিছু গণমাধ্যমে চলমান ধারাবাহিক অপপ্রচারের অংশ। বাস্তবতা হলো, এনসিপি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি বা দর-কষাকষি নিয়ে কোনো ধরনের আলোচনা করেনি। আমাদের সুস্পষ্ট অবস্থান হলো— গণহত্যার দায়ে আওয়ামী লীগ ও এর নেতাকর্মীদের বিচারের দৃশ্যমান অগ্রগতি, গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন এবং নতুন সংবিধান প্রণয়ন নিশ্চিত করেই দেশে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে

এসব প্রসঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেছেন, “এনসিপিকে আসন দিয়ে কেনা যাবে না। আসন বণ্টনের মাধ্যমে সমঝোতার নির্বাচন আর রাতের ভোটের নির্বাচন একই, আমরা সেই ধরনের নির্বাচন চাই না।” তিনি বলেন, “জনগণ নির্বাচনে খেলোয়াড়ের ভূমিকা পালন করবে আর আম্পায়ারের ভূমিকা পালন করবে প্রশাসন। এ ধরনের ‘গেম চেঞ্জ’-এর কথাই বলছে এনসিপি। নির্বাচন যখনই হোক তাতে অসুবিধা নেই। তবে, অবশ্যই গণপরিষদ নির্বাচন ‘রুলস অব গেমস চেঞ্জ’-এর নির্বাচন হতে হবে।”

এদিকে শুধু দলীয় নেতাদের বক্তব্যে নয়, আসন বণ্টন সংক্রান্ত খবরের প্রতিবাদও জানিয়েছে দলটি। এ সংক্রান্ত এক প্রতিবাদলিপিতে তারা বলছে, ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সঙ্গে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০টি আসন নিয়ে দর-কষাকষি চলছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি দৃঢ়তার সঙ্গে জানাচ্ছে, এই দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, মনগড়া এবং কিছু গণমাধ্যমে চলমান ধারাবাহিক অপপ্রচারের অংশ। বাস্তবতা হলো, এনসিপি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি বা দর-কষাকষি নিয়ে কোনো ধরনের আলোচনা করেনি। আমাদের সুস্পষ্ট অবস্থান হলো— গণহত্যার দায়ে আওয়ামী লীগ ও এর নেতাকর্মীদের বিচারের দৃশ্যমান অগ্রগতি, গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন এবং নতুন সংবিধান প্রণয়ন নিশ্চিত করেই দেশে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।’ তবে দলটির একাধিক সূত্র বলছে, নির্বাচনের সময় হয়তো জোটবদ্ধভাবে যাওয়া যেতে পারে। আসন বণ্টনের বিষয়টি আলোচনার জন্য এখন গুরুত্বপূর্ণ না হলেও ভবিষ্যতের জন্য হয়তো গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। রাজনীতিতে শেষ বলে কোনো কথা নেই।

‘জুলাই সনদ’ বাস্তবায়ন না হলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ নয়, প্রয়োজনে আন্দোলনে নামবে এনসিপি / ছবি- সংগৃহীত

এসব প্রসঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব ঢাকা পোস্টকে আরও বলেন, “ছয় মাস হয়েছে আমাদের নতুন দলের আত্মপ্রকাশ। ফলস্বরূপ আমাদের একসঙ্গে দুই-তিনটি কাজ করতে হচ্ছে। একটি হচ্ছে- আমাদের জুলাই সনদের জন্য রাজনৈতিকভাবে সংগ্রাম করতে হচ্ছে, দ্বিতীয়টি হচ্ছে- আমাদের দলের বার্তা মানুষের কাছে অর্থাৎ তৃণমূলে পৌঁছানোর কাজ করতে হচ্ছে এবং তৃতীয়টি হলো- যেহেতু সামনে নির্বাচন, সেই নির্বাচনকেও আমাদের মাথায় রাখতে হচ্ছে। আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো আমাদের নির্বাচন নিয়ে কাজ শুরু হয়নি। তবে, সাংগঠনিকভাবে প্রত্যেকটা জায়গায় আমাদের কার্যক্রম চলছে।”

এনসিপি’র ধারাবাহিক এসব কার্যক্রমের মধ্যেই চলে আসে ৫ আগস্ট, জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস। সরকার দিবসটি পালনে নানা উদ্যোগ হাতে নেয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল- জাতীয় সংসদের সামনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের জাতির উদ্দেশ্যে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ। অথচ সেদিন জাতীয় নাগরিক পার্টির শীর্ষ পাঁচ নেতা কক্সবাজার ঘুরতে যান। অভ্যুত্থানের গুরুত্বপূর্ণ দিনে এনসিপির নেতাদের এমন কর্মকাণ্ড জাতিকে অনেকটা হতাশ করেছে— মনে করে রাজনৈতিক সচেতন মহল।

সেদিন মার্কিন সাবেক রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে নাকি তাদের মিটিং হয়েছিল বলে গুঞ্জন ওঠে। পরে দলটির পক্ষ থেকে বিষয়টি ‘গুজব’ বলে জানানো হয়। তবে, দলটির শীর্ষ পাঁচ নেতাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। কী কারণে দেশের গুরুত্বপূর্ণ দিনে কক্সবাজার গিয়েছিলেন, তা জানতে চাওয়া হয়। ১৬ আগস্ট এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব (দপ্তর) সালেহ উদ্দিন সিফাত স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে পাঁচ নেতাকে দেওয়া কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রত্যাহারের কথা জানানো হয়।

বিবৃতিতে বলা হয়, গত ৬ আগস্ট জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম, মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আব্দুল্লাহ, মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব তাসনিম জারা, যুগ্ম আহ্বায়ক খালেদ সাইফুল্লাহর প্রতি পৃথক পাঁচটি কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠানো হয়েছিল। তারা সবাই দপ্তরমারফত আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব বরাবর নোটিশের জবাব প্রদান করেন। শোকজের জবাব বিশ্লেষণ করে ওই ঘটনায় দলীয় শৃঙ্খলার ব্যত্যয় না ঘটায় আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম ও সদস্য সচিব আখতার হোসেনের নির্দেশক্রমে উল্লিখিত শোকজ নোটিশগুলো প্রত্যাহার করা হয়েছে এবং বিষয়টির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়েছে।

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন / ছবি- ঢাকা পোস্ট

বিষয়টি নিয়ে দলটির একাধিক নেতা ‘হতাশা’ প্রকাশ করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, যে জুলাই ঘোষণাপত্রের জন্য হাসনাত আব্দুল্লাহ রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার সামনে আন্দোলন করেছেন, সেই ঘোষাণাপত্র ঘোষণার দিন তিনি ঢাকায় ছিলেন না, এটি খুবই রহস্যজনক। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে হয়তো তাদের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে মনোমালিন্য হতে পারে, হয়তো রাগ-অভিমান বুঝাতেই তারা এমনটি করতে পারেন। এটি আসলে দলের জন্য ক্ষতিকর, সাধারণের কাছে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে। 

এদিকে, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন— এক্ষেত্রে দলটির ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার মতো সক্ষমতা আছে কি না— ঢাকা পোস্টের পক্ষ থেকে এমন প্রশ্ন করা হয় দলটির একাধিক নেতাকে। তারা বলেন, সারাদেশে আমরা পদযাত্রা করেছি। এ কারণে বাংলাদেশের প্রত্যেকটি জেলাপর্যায়ে আমাদের একটি সাংগঠনিক ভিত্তি মোটামুটি দাঁড়িয়ে গেছে। আরও কিছু কাজের মাধ্যমে এটিকে পূর্ণাঙ্গ সাংগঠনিক কাঠামোতে রূপান্তর করতে হবে।

নির্বাচন প্রসঙ্গে তাদের বক্তব্য হলো— ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হোক কিংবা জানুয়ারির আগে, নির্বাচনের সময় নিয়ে আমাদের আপত্তি নেই। তফসিল দিলে পুরোদমে কার্যক্রম শুরু হবে। আমাদের আসনভিত্তিক প্রার্থী চূড়ান্ত হয়নি। আমাদের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ আছেন, তাদের বাইরেও স্থানীয় প্রভাবশালী, সামাজিকভাবে যোগ্য লোক আছেন; অনেকেই আসনভিত্তিক প্রার্থী হতে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। আমাদের সাংগঠনিক কাঠামোতে তাদের নাম তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে। এখনই বিষয়টিকে সামনে এনে খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না।

জোটবদ্ধ নির্বাচন করার বিষয়ে তারা বলেন, অন্য কোনো দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ কিংবা এককভাবে নির্বাচন করার বিষয়ে এখনো আলোচনা হয়নি। তফসিল ঘোষণা হলে তখন আলোচনা করা যাবে। যদি জোটবদ্ধ না হয়, এককভাবেই আমরা নির্বাচন করব। এ বিষয়ে এখনো আলোচনা শুরু হয়নি। আপাতত সংস্কার প্রশ্নে বিভিন্ন পর্যায়ে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবে বৈঠক হচ্ছে, আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। মনোনয়ন পেতে স্থানীয়পর্যায়ে যারা গণ্যমান্য ব্যক্তি আছেন, তাদের অনেকে যোগাযোগ করছেন। আমাদের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ের আলাপ-আলোচনা হচ্ছে।

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব / ছবি- ঢাকা পোস্ট

এ বিষয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন ঢাকা পোস্টকে আরও বলেন, “নির্বাচনের কার্যক্রম আমাদের আরও দুই মাস আগে শুরু হয়েছে। এগুলো আসলে পার্টির অভ্যন্তরীণ বিষয়। আমরা আমাদের মতো এগিয়ে নিচ্ছি। এখানে প্রার্থীদের যে তালিকা এবং গণপরিষদ নির্বাচনের জন্য বিভিন্ন আসনভিত্তিক যে প্রস্তুতি, সেই কাজটি আমরা আরও দুই মাস আগে শুরু করে দিয়েছি।”

জুলাই সনদের ওপর আপনাদের নির্বাচনের কার্যক্রম অনেকটা নির্ভর করছে কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে এনসিপির এই নেত্রী বলেন, “জুলাই সনদ ভালোভাবে বাস্তবায়ন হবে না। এটির যে বাস্তবায়ন পদ্ধতি, সব দল একমত হতে পারবে না। এটি আমরা অনুমান করছি। একটি জিনিসের বাস্তবায়ন পদ্ধতি তখনই ফলপ্রসূ হয়, যখন আপনি নিশ্চিত করতে পারবেন যে, এটি কখনোই পরিবর্তন হবে না। রাষ্ট্র এটিকে কখনোই পরিবর্তন করতে পারবে না। কিন্তু আমরা সবসময় দেখেছি, যেকোনো একটি সিদ্ধান্ত পরের সরকার আদালতকে ব্যবহার করে বাতিল করে দেয়। আমাদের প্রজন্ম কিন্তু এই সিস্টেমের সঙ্গে পরিচিত। কোটা সংস্কারের ক্ষেত্রেও কাজটি করতে চেয়েছিল, সেটিই করেছে।”

“আমরা মনে করি, এটি সম্ভব যদি জুলাই সনদকেও এলএফও-এর মাধ্যমে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, এটিকে দায়বদ্ধ করা হয়। সেই সঙ্গে একই এলএফও-তে গণপরিষদ নির্বাচনের কথাও বলা হয়। তাহলে সনদের যে বিষয়বস্তু এবং সনদের যে চুক্তিনামা, এটি স্থায়ীভাবে থেকে যাবে”— যোগ করেন সামান্তা শারমিন।

সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জাতীয় নাগরিক পার্টির মধ্যে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যেই দলটির যুগ্ম সদস্যসচিব মাহিন সরকারকে বহিষ্কার করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, ডাকসু নির্বাচনে মনোনয়ন গ্রহণের আগে তিনি দলের অনুমতি নেননি, যা দলীয় শৃঙ্খলার গুরুতর ব্যত্যয় হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।

নির্বাচন নিয়ে এনসিপির মধ্যে দৃশ্যমান কোনো প্রস্তুতি নিতে এখনো দেখা যায়নি / ছবি- সংগৃহীত 

বহিষ্কারের প্রতিক্রিয়ায় মাহিন সরকার তার ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লিখেছেন, “মাহিন সরকারের তার অনাগত সন্তানের কাছে বলার মতো গল্প আছে। আমি তাদের একজন যার হাতে অভ্যুত্থানের ব্যানারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গঠিত হয়েছিল। অন্তত আমার কথাগুলো বলার সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল। মাহিন সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে রক্ত দিয়ে রাঙিয়েছে। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচারের আন্দোলনে যখন কেউ পাশে দাঁড়ায়নি, তখনও মাঠে ছিলেন তিনি। গানপয়েন্টে ছয়জন সমন্বয়কের কর্মসূচি প্রত্যাহারের পর মাহিন সরকার বলেছিলেন, ‘মানি না’। অথচ কোনো কারণ দর্শানোর নোটিশ ছাড়াই তাকে বহিষ্কার করা হলো।”

এদিকে, জেলাপর্যায়ে কমিটি করার ক্ষেত্রে আহ্বায়কের বয়স ন্যূনতম ৪০ বছর করা হয়েছে। দলীয় সূত্র মতে, এই সিদ্ধান্ত আগামী নির্বাচনে প্রার্থীর বিষয়টি মাথায় রেখে নেওয়া হয়েছে। যেহেতু জাতীয় নাগরিক পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির মূল নেতৃত্বে থাকা অনেকেই খুবই তরুণ, তাই ৪০-ঊর্ধ্ব প্রজন্মের কাছে এমন একটি বার্তা যাচ্ছিল যে এনসিপিতে হয়তো জ্যেষ্ঠদের জন্য সুযোগ সীমিত। এ কারণে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আহ্বায়কের জন্য ন্যূনতম বয়স ৪০ নির্ধারণ করা হয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থান তৈরি করতে বয়সের একটি প্রভাব থাকে, যা গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে সহায়ক হয়।

এমএসআই/এমএআর/