বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে এখন দৃশ্যমান ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। কোনো ধরনের ফিটনেস পরীক্ষা ও কোনো সরকারি ট্যাক্স ছাড়াই এই বাহন সড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে দিব্যি। ন্যূনতম শারীরিক পরিশ্রমে চালানো যায় বলে রিকশাটি এখন প্রায় সব বয়সীর হাতেই চলে এসেছে। তবে, প্রশ্ন রয়ে গেছে— যাত্রীদের নিরাপত্তা কোথায়?

এই নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখেই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) তৈরি করেছে বৈদ্যুতিক অটোরিকশা বা ই-রিকশা। গবেষকরা দাবি করছেন, এটি বর্তমানের অনিরাপদ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার কার্যকর বিকল্প হতে পারে। কিন্তু কখন এই প্রকল্প সফলভাবে বাস্তবায়ন হবে, তা এখনো অনিশ্চিত।

২০২০ সালের দিকে শহর ও গ্রামে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। প্রতিটি রিকশা গ্যারেজে নিয়মিত বানানো হয় এসব অটোরিকশা, আজও হচ্ছে। কোনো মানদণ্ড ছাড়াই তৈরি হওয়া এসব যানবাহনে দুর্ঘটনার ঝুঁকি ছিল বেশি। একইসঙ্গে হচ্ছিল বিদ্যুৎ অপচয়, আর পরিবহন খাতে তৈরি হচ্ছিল বিশৃঙ্খলা। নিরাপদ ও মানসম্মত বিকল্প খুঁজতেই বুয়েটকে ই-রিকশা বানাতে বলা হয়। বাংলাদেশ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা কাউন্সিলের (বিইপিআরসি) অর্থায়নে কাজটি করে বুয়েট।

বুয়েটের ই-রিকশা দেখতে সাধারণ অটোরিকশার মতো হলেও প্রযুক্তি ও নিরাপত্তার দিক থেকে অনেক উন্নত বলে জানান গবেষক দল / ছবি- ঢাকা পোস্ট

এরপর বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. এহসানের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের গবেষক দল মাঠপর্যায়ে কাজ শুরু করেন। তারা অটোরিকশার চালক, মেরামতকারী ও যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে বাস্তব সমস্যাগুলো চিহ্নিত করেন। সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নতুন যানটির নকশা তৈরি করা হয়। ২০২৫ সালের শুরুতে প্রোটোটাইপ তৈরি সম্পন্ন হয়।

বুয়েটের ই-রিকশা দেখতে সাধারণ অটোরিকশার মতো হলেও প্রযুক্তি ও নিরাপত্তার দিক থেকে অনেক উন্নত বলে জানায় গবেষক দল। একবার চার্জে এটি প্রায় ৭০ কিলোমিটার চলতে পারে। এতে রয়েছে চারটি ব্যাটারি, যা চার্জ করতে সাত থেকে আট ঘণ্টা সময় লাগে। গতি ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা নির্দিষ্ট মানদণ্ডে রাখা হয়েছে, যাতে রাস্তার শৃঙ্খলা বজায় থাকে

বুয়েটের এই ই-রিকশা দেখতে সাধারণ অটোরিকশার মতো হলেও প্রযুক্তি ও নিরাপত্তার দিক থেকে অনেক উন্নত বলে জানায় গবেষক দল। একবার চার্জে এটি প্রায় ৭০ কিলোমিটার চলতে পারে। এতে রয়েছে চারটি ব্যাটারি, যা চার্জ করতে সাত থেকে আট ঘণ্টা সময় লাগে। গতি ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা নির্দিষ্ট মানদণ্ডে রাখা হয়েছে, যাতে রাস্তার শৃঙ্খলা বজায় থাকে।

নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এ যানটিতে রাখা হয়েছে হাইড্রোলিক ডিস্ক ব্রেক, আলাদা পার্কিং ব্রেক, রিয়ারভিউ মিরর, ইন্ডিকেটর, ক্যানোপি, উইন্ডশিল্ড ও আধুনিক হেডলাইট। এতে রয়েছে হাই বিম-লো বিম এবং ডে-টাইম রানিং লাইট, যাতে রাত-দিন যেকোনো সময় চালানো যায়। ব্যাটারির আয়ুষ্কাল প্রায় দেড় বছর ধরা হয়েছে। এসব পুরনো ব্যাটারি পুনর্ব্যবহারযোগ্য। ফলে এটি পরিবেশবান্ধবও।

গবেষক দলের হিসাবে, একটি ই-রিকশা তৈরি করতে খরচ পড়বে প্রায় দেড় লাখ টাকা। বাজারে প্রচলিত অটোরিকশার দাম কাছাকাছি হলেও নতুন ই-রিকশা অনেক বেশি শক্তপোক্ত ও টেকসই। এই রিকশা চালানোর জন্য চালকদের তিন থেকে সাত দিনের প্রশিক্ষণ যথেষ্ট।

বুয়েটের তৈরি ই-রিকশার পাশে গবেষক দলের প্রধান ও বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. এহসান / ছবি- সংগৃহীত

এদিকে, অন্তর্বর্তী সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া গত ২৮ জুন গুলশানে ঢাকা উত্তর সিটির নগর ভবনে রিকশাচালকদের প্রশিক্ষণ দিতে প্রশিক্ষক (মাস্টার ট্রেইনার) তৈরির কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জানান, বুয়েটের তৈরি ব্যাটারিচালিত রিকশা শুরুতে ঢাকার দুই সিটি (দক্ষিণ ও উত্তর) কর্পোরেশনের পল্টন, ধানমন্ডি ও উত্তরা এলাকায় চালানোর অনুমতি দেওয়া হবে। এর আগে রিকশাচালকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। পরে তারা লাইসেন্স পাবেন। এরপর তারা ব্যাটারিচালিত রিকশা কিনে নির্ধারিত এলাকার সড়কে চালাতে পারবেন।

নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যানটিতে রাখা হয়েছে হাইড্রোলিক ডিস্ক ব্রেক, আলাদা পার্কিং ব্রেক, রিয়ারভিউ মিরর, ইন্ডিকেটর, ক্যানোপি, উইন্ডশিল্ড ও আধুনিক হেডলাইট। এতে রয়েছে হাই বিম-লো বিম এবং ডে-টাইম রানিং লাইট, যাতে রাত-দিন যেকোনো সময় চালানো যায়। ব্যাটারির আয়ুষ্কাল প্রায় দেড় বছর ধরা হয়েছে। এসব পুরনো ব্যাটারি পুনর্ব্যবহারযোগ্য। ফলে এটি পরিবেশবান্ধবও

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ সম্প্রতি (৪ সেপ্টেম্বর) ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বাজারে যে অটোরিকশাগুলো চলে তার চাইতে আমি এখানে নতুন কিছু দেখি না। কারণ, বাজারে ব্যাটারিচালিত রিকশা দেখা যাচ্ছে, এখানেও ব্যাটারিতে চলবে। ফলে ব্যাটারির সংখ্যা বাড়ছে। এটার ব্রেকিং সিস্টেমটা ভালো, কিন্তু এই ধরনের ব্রেকিং সিস্টেমের রিকশা এর আগে থেকেই বাজারে প্রচলিত।’

‘এটার গতিটা বলা হচ্ছে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৩০ কিলোমিটার। ঢাকা শহরে মোটরসাইকেলের সর্বোচ্চ গতিসীমাও হচ্ছে ৩০ কিলোমিটার। এটা সিএনজির মতো ডিজাইন হয়েছে। রিকশার কিন্তু একটা আবেদন আছে। কেউ রিকশায় উঠে খোলা আকাশের নিচে বাতাস খেতে খেতে ঘুরে, আবার কেউ বৃষ্টিতে ভিজে। এটাকে আবদ্ধ করাটা ঠিক হয়নি।’

ই-রিকশা আবদ্ধ করা ঠিক হয়নি। কারণ, অনেকে খোলা আকাশে বাতাস খেতে খেতে কিংবা বৃষ্টিতে ভিজতে পছন্দ করেন— যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ / ছবি- ঢাকা পোস্ট

ফাংশন নিয়ে তিনি বলেন, ‘এটার বিকল্প বিদ্যুৎ হিসেবে সোলার ব্যবহার করা যেতে পারত। এতে করে গ্রিন এনার্জি হতো। এটাকে ফ্লাইহুইল ডিজাইন করা যেত। যাতে করে অল্প চাপে বেশি ঘুরত। চাইলে বেশি গতিতে কেউ চালাতে পারত না।’

ই-রিকশার গবেষক দলের প্রধান ও বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. এহসান সম্প্রতি (৪ সেপ্টেম্বর) ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এটাতে মেইনলি আমরা ব্রেক অ্যান্ড সেফটির দিকে বেশি জোর দিয়েছি। প্রায় ১৪–১৫টা আইটেম যুক্ত করেছি। এগুলোর মধ্যে প্যাসেঞ্জার সেফটির সংখ্যাই বেশি। এর মধ্যে হাইড্রোলিক ব্রেকিং সিস্টেমটা অন্যতম।’

‘এটা তো অনেক দূর এগিয়েছে। কিন্তু এখন প্রশাসনিকভাবে এটা কত দিনে ইমপ্লিমেন্ট করে, বিশেষ করে সিটি কর্পোরেশন, সেটা এখন দেখার বিষয়। ইমপ্লিমেন্টের জায়গায় আমাদের এখানে অলরেডি পাঁচ–ছয়টা কোম্পানি প্রোটোটাইপ টেস্টিং করে সার্টিফিকেট নিয়ে গেছে।’

তবে, তিনি সংশয়ও প্রকাশ করেন। বলেন, ‘সার্টিফিকেট নিয়ে যাওয়ার পরে পরবর্তীতে আর খুব বেশি অগ্রগতি হয়নি।’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগস্ট মাস পার হলেও ঢাকার রাস্তায় বুয়েটের ডিজাইন করা অটোরিকশার দেখা মেলেনি। এ বিষয়ে অগ্রগতি জানার জন্য ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজের মোবাইল ফোনে কল করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি।

এমএইচএন/এমএআর/