মোহাম্মদ এজাজ, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রশাসক। গত ১২ ফেব্রুয়ারি তিনি এই দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দেখতে দেখতে সাত মাস অতিবাহিত হয়েছে। এর আগে তিনি বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান রিভার অ্যান্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান ছিলেন।

দায়িত্ব গ্রহণের পর মাত্র সাত মাসে ঢাকা শহরের একাধিক বড় সমস্যা সমাধানে হাত দিয়েছেন উত্তর সিটির এ প্রশাসক। জলাবদ্ধতা দূরীকরণ থেকে শুরু করে ঢাকার পরিবেশগত পরিবর্তন, জনবল ব্যবস্থাপনা ও রাস্তা সংস্কারের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোতে তিনি এনেছেন নতুন গতি। কর্মীদের বেতন বৈষম্য দূর করে কর্মপরিবেশে স্বাচ্ছন্দ্য ফিরিয়ে আনা এবং গণশুনানির মাধ্যমে সরাসরি নাগরিকদের সমস্যা চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী কাজ করার মতো ব্যতিক্রমী উদ্যোগও নিয়েছেন।

এছাড়া, ঢাকার সড়কগুলোতে বর্তমানে ব্যাটারিচালিত রিকশা বড় বিশৃঙ্খলার অন্যতম কারণ। এই সমস্যা সমাধানে প্রচলিত ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে একটি ভিন্নধর্মী উদ্যোগ নিয়েছেন মোহাম্মদ এজাজ। পাশাপাশি রাস্তা সংস্কার, পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং রিকশার জন্য নতুন ও নিরাপদ ব্যবস্থাপনার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোতে তিনি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি এনেছেন।

এই সাত মাসে উল্লেখযোগ্য কী কী কাজ করেছেন, কোন ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছেন এবং ভবিষ্যতের জন্য কী পরিকল্পনা রয়েছে— সার্বিক বিষয় নিয়ে ঢাকা পোস্টের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক আবু সালেহ সায়াদাতের সঙ্গে কথা বলেছেন মোহাম্মদ এজাজ।

ঢাকা পোস্ট : ব্যাটারিচালিত রিকশা বর্তমানে একটি বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে, সমস্যা সমাধানে কী উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন?

মোহাম্মদ এজাজ : মোটরচালিত যেসব রিকশা বা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা আছে, সেগুলো নিয়ন্ত্রণে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। বর্তমানে যে বাহনটি আছে, সেটি নিরাপদ নয়। প্রথমে আমরা একটি নিরাপদ বাহন হিসেবে এর নকশা তৈরি করিয়ে নিয়েছি বুয়েট থেকে। এরপর এই নকশাটি আমরা উন্মুক্ত করে দিয়েছি, যাতে যেসব প্রতিষ্ঠানের এগুলো বানানোর সক্ষমতা আছে, তারা যেন এটি তৈরি করতে পারে। ডিজাইন অনুযায়ী বানানো হচ্ছে কি না, কোনো সমস্যা আছে কি না— এসব আমরা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যাচাই করব। এরপর তারা উৎপাদন শুরু করবে।

আমরা এখন চিহ্নিত করছি কোন কোন এলাকায় কত সংখ্যক রিকশার প্রয়োজন। এরপর আমরা সেসব এলাকার জন্য রিকশার নম্বর প্লেট এবং চেসিস নম্বর দেব। যখন কোনো জোনে আমরা এসব রিকশার অনুমোদন দেব, তখন ওই এলাকায় অন্য কোনো রিকশা আমরা আর ঢুকতে দেব না।

এ ছাড়া, এসব রিকশাচালককে আমরা প্রশিক্ষণ দিচ্ছি, যেন নতুন রিকশা পেলে সড়ক নিরাপত্তা ও চালানোর বিষয়ে তারা আগে থেকেই প্রশিক্ষিত থাকে। প্রাথমিক লক্ষ্য হলো— এক লাখ রিকশাচালককে প্রশিক্ষণ দেওয়া। এই কাজ চলমান আছে। এসব রিকশা যেন মূল সড়কে উঠতে না পারে, সেটারও ব্যবস্থা নিচ্ছি। নতুন রিকশাগুলো নামতে শুরু করলে ধীরে ধীরে আগের অনিরাপদ রিকশাগুলো সড়ক থেকে উঠে যাবে।

নতুন রিকশাগুলোতে ডিভাইস দেওয়া থাকবে, যা মূল সড়কে বা অন্য জোনে যাওয়ার চেষ্টা করলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। তারা এক জোন থেকে অন্য জোনে যেতে পারবে না। আগামী মাস থেকে আমরা পরীক্ষামূলকভাবে দুটি জোনে এই কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছি। আমরা তাদের পাঁচ বছরের জন্য লাইসেন্স দেব। এর মধ্যে একবার ফিটনেস পরীক্ষা করা হবে। প্রতি মাসে তারা নির্দিষ্ট পরিমাণ রোড পারমিট চার্জ দেবেন।

ঢাকা পোস্ট : দায়িত্ব গ্রহণের ৭ মাস হলো, এই সময়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কী কী কাজ করলেন?

মোহাম্মদ এজাজ : ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় আমরা এয়ার কোয়ালিটি মনিটরিং সেন্সর লাগিয়েছি। নতুন কোনো নির্মাণকাজ হলে সেখানে এয়ার কোয়ালিটি মনিটরিং সিস্টেম স্থাপন করা বাধ্যতামূলক করেছি। ঢাকার রাস্তার মাঝখানের ফাঁকা অংশে যেন খোলা মাটি না থাকে, সে লক্ষ্যে কাজ করে আমরা সেখানে ঘাস লাগিয়ে দিয়েছি, যাতে ধুলোবালি উড়ে দূষণ না ছড়ায়। সব মিলিয়ে ঢাকায় পরিবেশগত একটি পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছি।

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের অনেক অভ্যন্তরীণ সমস্যা ছিল। আমাদের প্রায় নয় হাজার কর্মী, যার মধ্যে প্রায় সাত হাজার পরিচ্ছন্নতা কর্মী ও মশক নিধন কর্মী রয়েছে। কর্মীদের ওপর অনেক বৈষম্য করা হয়েছিল। আমি আসার পর সেগুলো সমাধান করেছি। আউটসোর্সিংয়ের যে কর্মীরা আছেন, তাদের জন্য আমরা ১৮-২০ হাজার টাকা বরাদ্দ দিতাম। কিন্তু মধ্যস্বত্বভোগীরা তাদের ৫-৬ হাজার টাকা বেতন দিত। আমি এসে সরাসরি তাদের কাছে টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। এখন একেকজন ১৫-১৬ হাজার টাকা করে বেতন পায়। তারা এখন স্বাচ্ছন্দ্যে ও আনন্দের সঙ্গে কাজ করছে।

মাস্টার রোলে আমাদের প্রায় ২৭০০ কর্মী ছিল। আমরা বোর্ড সভা করে তাদের চাকরির নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছি। এ ছাড়া, প্রতিটি বিভাগের যেসব ঘাটতি আছে, সেগুলো ঠিক করতে কাজ করে যাচ্ছি। কর্মী থেকে শুরু করে কর্মকর্তা পর্যন্ত কোন স্তরে কী ঘাটতি বা সমস্যা আছে, সেগুলো আমি চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছি। সিটি কর্পোরেশনের জন্য যে পরিমাণ জনবল দরকার, সে অনুযায়ী আমাদের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ জনবল আছে। কিন্তু ভালো দিক হলো তারাই শতভাগ কাজ করে। কাজের মান আরও ভালো করার জন্য আমরা একটি নিয়োগের ব্যবস্থা করেছি, সামনে একটি বড় নিয়োগ হবে।

ঢাকা পোস্ট : ঢাকায় আর জলাবদ্ধতা থাকবে না, এটি কি বাস্তবতাসম্মত?

মোহাম্মদ এজাজ : ঢাকায় জলাবদ্ধতার ইতিহাস আমার জানা। আমি জানি কোথায় সমস্যা, তাই দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রচুর খাল ও ড্রেনেজ লাইন পরিষ্কার করেছি। সঠিক মানুষকে সঠিক জায়গায় বসালে সঠিক কাজ হবে, এটাই স্বাভাবিক। আমি কাজ করেছি, যার ফলস্বরূপ এই বছর রেকর্ড বৃষ্টিপাতের পরও ঢাকা শহরের মূল সড়কে জলাবদ্ধতা হয়নি।

ভেতরের দিকে জলাবদ্ধতা এখনো আছে, এটা আমি স্বীকার করি। কিন্তু মূল সড়কে এবার জলাবদ্ধতা হয়নি। পুরো ঢাকাকে ঠিক করতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও কাজ করতে কিছুটা সময় লাগবে। তবে মূল সড়কের মতো বড় সমস্যাটি আমি দুই-তিন মাসের মধ্যে ঠিক করেছি। এটা স্থায়ীভাবে সমাধানের জন্য কী কী উদ্যোগ নিতে হবে, সে বিষয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং সেই অনুযায়ী কাজ করছি।

ঢাকা পোস্ট: নাগরিক সমস্যা সমাধানে উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ নিতে পেরেছেন?

মোহাম্মদ এজাজ : ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন অনেক বড় একটি এলাকা। কোন কোন এলাকায় কী কী কাজ করতে হবে, সে বিষয়ে আমাদের একটি দাপ্তরিক চিন্তাভাবনা আছে। তা সত্ত্বেও আমি প্রতিটি এলাকায় গিয়ে গণশুনানি করেছি। এলাকার মানুষের কথা শুনেছি, তাদের কী কী সমস্যা আছে বা কী দরকার, সেগুলো আমরা গণশুনানির মাধ্যমে জেনে নোট করেছি। এই গণশুনানির মাধ্যমে একটি সোশ্যাল ম্যাপিং হয়েছে, যেখানে কোথায় কী করা দরকার তা চিহ্নিত করা গেছে। সে অনুযায়ী আমরা কাজ করছি।

আমি দায়িত্ব গ্রহণের পর দেখেছি পুরো ঢাকা শহরের রাস্তাঘাট ভাঙাচোরা ছিল, অনেকের অভিযোগ ছিল। জুলাইয়ের আন্দোলনের সময় আওয়ামীপন্থী যেসব ঠিকাদার ছিল, তারা পালিয়ে গিয়েছিল, কাজগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এই অমীমাংসিত কাজগুলো কীভাবে শেষ করা যায়, তার একটি পরিকল্পনা করেছি এবং সে অনুযায়ী কাজ করেছি। যার ফলে মূল সড়কে বর্তমানে আর কোনো ভাঙাচোরা নেই।

মিরপুর ডিওএইচএস-এর যে রাস্তাটি অনেকে চেষ্টা করেও আগে করতে পারেননি, আমি বর্তমানে সেটা দুই লেনের রাস্তা করে দিয়েছি। মিরপুর ৬০ ফিট রাস্তা চলাচলের অনুপযোগী ছিল, আমি সেটা করে দিয়েছি। দক্ষিণখানের রাস্তা আমি কার্পেটিং করে চলাচলের ব্যবস্থা করে দিয়েছি।

এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আছে। এটার জন্য আমরা প্রচুর কাজ করেছি এবং স্থানীয় কমিউনিটির সঙ্গে কাজ করছি। ঢাকায় ঈদ মিছিল, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মেলা— এগুলো তিন-চারশো বছরের ইতিহাস। সেগুলো আমরা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি, প্রথমবারের মতো আমরা ঈদ মিছিল ও এ ধরনের অনুষ্ঠান করেছি।

ঢাকা পোস্ট: অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আগামীর জন্য উল্লেখযোগ্য কোন কাজগুলো করতে চান?

মোহাম্মদ এজাজ : ঢাকার অনেক সমস্যা ও ইস্যু আছে। সেগুলো চিহ্নিত করা এবং সে অনুযায়ী কাজ করাই আমার উদ্দেশ্য। প্রথমে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় একটা শৃঙ্খলা আনতে চাই। পরিবেশের সঙ্গে জনস্বাস্থ্য জড়িত, তাই ঢাকার পরিবেশ ঠিক করার জন্য যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার, সেগুলো বাস্তবায়ন করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

ঢাকায় যেন আর জলাবদ্ধতা না থাকে, সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। আমি বলতে চাই, ঢাকায় আর জলাবদ্ধতা থাকবে না। এর জন্য আমরা এরই মধ্যে ব্যবস্থা নিয়েছি। জলাবদ্ধতার কারণগুলো আমরা চিহ্নিত করেছি এবং সে অনুযায়ী কাজ শুরু করেছি। আরও অনেক কাজ বাকি আছে, সেগুলোও করার পরিকল্পনা রয়েছে। আমাদের কাজের ফলে এখন মূল সড়কে জলাবদ্ধতা নেই এবং আশা করি ভবিষ্যতে অলিগলিতেও এই সমস্যা থাকবে না।

ঢাকা পোস্ট : ঢাকা পোস্টকে সময় দিয়ে আপনার কার্যক্রম ও পরিকল্পনাগুলো তুলে ধরার জন্য ধন্যবাদ।

মোহাম্মদ এজাজ : ঢাকা পোস্টকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।

এএসএস/এমজে