উড়ালপথে ‘বাংলার টেসলা’, পাল্লা দিচ্ছে বাসের সঙ্গে
রাজধানীর যানজট নিরসনে নির্মিত হয়েছিল দ্রুতগতির ফ্লাইওভারগুলো। উদ্দেশ্য ছিল দ্রুতগামী যানবাহনের চলাচল নির্বিঘ্ন করা এবং সড়কের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। কিন্তু এখন সেসব উড়ালসড়কও দখল করে নিয়েছে অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা। প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে অলিগলি— সবখানে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেওয়ার পর এখন তারা পাল্লা দিচ্ছে বাস-প্রাইভেটকারের সঙ্গে, সরাসরি উড়ালপথে।
যেখানে ঘণ্টায় ৫০-৬০ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চলার কথা, সেখানে ধীরগতির এসব যানের অবাধ চলাচল শুধু দুর্ঘটনার ঝুঁকিই বাড়াচ্ছে না, বরং পুরো ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাকে এক নতুন সংকটের মুখে ঠেলে দিয়েছে। সরেজমিনে রাজধানীর খিলগাঁও, মগবাজার-মৌচাক, রামপুরা ও শান্তিনগরসহ একাধিক ফ্লাইওভার ঘুরে অবৈধ এই বাহনের উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করা গেছে। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ফ্লাইওভারগুলোতে বাংলার এই টেসলাকে প্রতিযোগিতায় নামতে দেখা যাচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
রাজধানীর খিলগাঁও ফ্লাইওভার সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, প্রতিনিয়ত ব্যাটারিচালিত রিকশা এই ফ্লাইওভারে বিনা বাধায় উঠে পড়ছে। মূলত যাত্রীদের সুবিধার্থে চালকেরা রাস্তার জ্যাম এড়াতে বিকল্প পথ হিসেবে ফ্লাইওভার ব্যবহার করছেন। তবে, এসব রিকশার গতিবেগ কম হওয়ায় দ্রুতগামী যানবাহনের সঙ্গে সংঘর্ষের ঝুঁকি তৈরি করছে।
মৌচাক ফ্লাইওভারেও একই ধরনের চিত্র দেখা গেছে। বিশেষ করে সকাল ও বিকেলে শত শত যাত্রী ব্যাটারিচালিত রিকশায় চড়ে ফ্লাইওভার অতিক্রম করছেন। এসব রিকশার কারণে ফ্লাইওভারে যানচলাচলের গতি কমে যাচ্ছে। পাশাপাশি তীব্র যানজটেরও কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে ফ্লাইওভারটি। দ্রুতগতির গাড়ির জন্য নকশা করা উড়ালপথে দুর্বল কাঠামো ও ধীরগতির এই যান উঠলেই পুরো লেনের গতি কমে যাচ্ছে। অনেক সময় ফ্লাইওভারে উঠে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ব্যাটারিচালিত এসব রিকশা। ফলে রাস্তা বন্ধ হয়ে তৈরি হচ্ছে যানজট।
বিজ্ঞাপন
সকাল ও বিকেলে শত শত যাত্রী ব্যাটারিচালিত রিকশায় চড়ে মৌচাক ফ্লাইওভার অতিক্রম করছেন। এসব রিকশার কারণে ফ্লাইওভারে যানচলাচলের গতি কমে যাচ্ছে। পাশাপাশি তীব্র যানজটেরও কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে ফ্লাইওভারটি। দ্রুতগতির গাড়ির জন্য নকশা করা উড়ালপথে দুর্বল কাঠামো ও ধীরগতির এই যান উঠলেই পুরো লেনের গতি কমে যাচ্ছে। অনেক সময় ফ্লাইওভারে উঠে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ব্যাটারিচালিত এসব রিকশা। ফলে রাস্তা বন্ধ হয়ে তৈরি হচ্ছে যানজট
এসব ফ্লাইওভার দিয়ে চলাচল করা বাস ও প্রাইভেটকারের চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফ্লাইওভারে বাস ও প্রাইভেটকার সাধারণত ৫০-৬০ কিলোমিটার গতিতে চলে। কিন্তু এসব রিকশা ফ্লাইওভারে উঠলে তাদের গতি হয় ১০-১৫ কিলোমিটার। ফলে ফ্লাইওভারে যানচলাচলের গতি কমে যায়। গতি কম হওয়ায় প্রায় সময় হার্ড ব্রেক করতে হয়। এতে যেমন যানজটের সৃষ্টি হয়, তেমনি দুর্ঘটনার শঙ্কাও বাড়ে।
রামপুরা থেকে শান্তিনগরগামী ভিক্টর ক্লাসিক পরিবহনের চালক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা ফ্লাইওভারে বাস চালাই ৫০-৬০ কিলোমিটার গতিতে। কিন্তু সকালে ও বিকেলের দিকে নিচের রাস্তার যানজট থেকে বাঁচতে ব্যাটারিচালিত রিকশা ফ্লাইওভারে উঠে যায় বিনা বাধায়। এসব রিকশার গতি থাকে ১০-১৫ কিলোমিটার। পরে দেখা যায় হঠাৎ সামনে রিকশা চলে এলে জোরে ব্রেক করতে হয়। তখন যাত্রীরা পড়ে যায়, আবার পেছনের গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লাগার ঝুঁকিও তৈরি হয়। প্রতিদিনই এমন অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়।’
আরও পড়ুন
প্রাইভেটকারের চালক মো. আল-আমিন বলেন, ‘ফ্লাইওভারে রাতে সমস্যা বেশি হয়। অনেক ব্যাটারিচালিত রিকশার হেডলাইটই থাকে না। ফ্লাইওভারে হঠাৎ সামনে পড়লে সামলানো কষ্টকর হয়ে যায়। গত মাসে খিলগাঁও ফ্লাইওভারে আমার গাড়ির সঙ্গে একটি রিকশার ধাক্কা লাগে। রিকশাটি ফ্লাইওভারের মাঝামাঝি হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। পরে জোরে ব্রেক করার পরও ধাক্কা লাগে। গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কেউ হতাহত হননি। অথচ বড় দুর্ঘটনা হতে পারত। এসব রিকশা কীভাবে ফ্লাইওভারে উঠে পড়ে, এটা আমার প্রশ্ন!’
অন্যদিকে, ফ্লাইওভারে ব্যাটারিচালিত রিকশার ওঠা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন যাত্রীরাও। তারা বলেন, ‘ট্রাফিক পুলিশ থাকতে কীভাবে ফ্লাইওভারে রিকশা ওঠে? এটা কি রিকশার ওঠার জায়গা? নিচের রাস্তায় পরিস্থিতি এমন যে রিকশার ছড়াছড়ি। এখন ফ্লাইওভারও রক্ষা পাচ্ছে না।’
এ বিষয়ে বাড্ডা থেকে মতিঝিলগামী প্রতিদিনের যাত্রী দিদারুল খান বলেন, অফিস করতে প্রতিদিন মতিঝিল যাই। কিন্তু রামপুরা আবুল হোটেলের সামনে থেকে বাস ফ্লাইওভারে উঠলে দেখা যায়, ব্যাটারিচালিত রিকশার কারণে এটি এক লেন হয়ে গেছে। গাড়ি চলে না তাদের কারণে। আবার মাঝেমধ্যে বন্ধও হয়ে যায়। অফিস টাইমে ও অফিস ছুটির পর কী যে ভোগান্তি হয় ফ্লাইওভারে! আমার প্রশ্ন, ফ্লাইওভারে ওঠার ও নামার রাস্তাতে তো ট্রাফিক পুলিশ থাকে। উনারা কী করেন? কেন তাদের আটকান না?
বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সরকারি অনুমোদন না থাকলেও রাজধানীতে অন্তত ৮-১০ লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশার অবাধ বিচরণ। আইন অনুযায়ী ব্যাটারিচালিত রিকশা ফ্লাইওভার, প্রধান সড়ক ও মহাসড়কে চলতে পারবে না। কারণ, এই ধরনের যানবাহন ধীরগতির এবং উচ্চগতির গাড়ির সঙ্গে চলতে গিয়ে সহজেই দুর্ঘটনার শিকার হতে পারে। কিন্তু রাজধানীতে এই আইন কার্যকর হচ্ছে না। মাঝে মাঝে পুলিশি অভিযান হলেও তা টেকসই হয় না। কিছুদিন পর আবারও আগের মতো ফ্লাইওভারে রিকশা চলতে দেখা যায়।
আরও পড়ুন
বর্তমানে রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনার বড় একটি অংশের সঙ্গে ব্যাটারিচালিত রিকশা জড়িত। গবেষণায় দেখা গেছে, এগুলোর নকশা দুর্বল, ব্রেক সিস্টেম অনিরাপদ এবং চালকদের প্রশিক্ষণ নেই। ফ্লাইওভারে যেখানে গাড়ির গতি তুলনামূলক বেশি, সেখানে এই যান উঠলে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা কয়েক গুণ বেড়ে যায়।
তবে অনেকের মতে, ফ্লাইওভারে ব্যাটারিচালিত রিকশার এই নৈরাজ্যের পেছনে যাত্রীদের পাশাপাশি ট্রাফিক পুলিশেরও দায় আছে। অনেকে সময় বাঁচাতে ফ্লাইওভারে রিকশা উঠাতে চান। ফলে চালকেরা উৎসাহ পান। যাত্রীরা যদি নিয়ম মেনে চলতে রাজি হতেন, তাহলে পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে রাখা যেত। আর ট্রাফিক পুলিশ যদি সঠিকভাবে আইন প্রয়োগ করত তাহলে এই নৈরাজ্য হতো না।
এ বিষয়ে মাঠপর্যায়ের ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজধানীতে তাদের একার পক্ষে ব্যাটারিচালিত রিকশার নৈরাজ্য ঠেকানো সম্ভব নয়। লাখ লাখ রিকশা কীভাবে ঠেকাবে ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা? যাদের কোনো লাইসেন্স বা রেজিস্ট্রেশন নেই।
আরও পড়ুন
রাজধানীর খিলগাঁও ফ্লাইওভারের নিচে দায়িত্বরত এক ট্রাফিক সার্জেন্ট নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নিচে বা উপরে সব জায়গায় ব্যাটারিচালিত রিকশা। সর্বত্র এই রিকশা ছড়িয়ে পড়েছে। ডাম্পিং করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। রিকশা সামলানোর জন্য ৪-৫ জন ট্রাফিক পুলিশ দরকার প্রতিটি পয়েন্টে। এত লোক কোথায়? আর শুধু রিকশা নিয়ে পড়ে থাকলে বাকি যানবাহন ও রাস্তার শৃঙ্খলা কীভাবে দেখব আমরা?
তবে, ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, ফ্লাইওভারে রিকশার বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হয়। ট্রাফিক বিভাগ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে।
এ বিষয়ে ডিএমপির ট্রাফিক মতিঝিল বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. ফজলুল করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘খিলগাঁওসহ আমাদের বিভাগের ফ্লাইওভারগুলোতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হয়। সেখানে ব্যাটারিচালিত রিকশা পেলেই অভিযান চালিয়ে ডাম্পিংয়ে পাঠানো হয়। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য।’
অন্যদিকে বিশেষজ্ঞদের দাবি, শুধু ফ্লাইওভার নয়, রাজধানীর প্রধান প্রধান সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশার চলাচল দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। তা না হলে সামনে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে।
আরও পড়ুন
এ প্রসঙ্গে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ইমিডিয়েটলি ব্যাটারিচালিত রিকশাকে সরকারের নিবন্ধন দেওয়া উচিত। এটাকে নিবন্ধনের আওতায় আনতেই হবে। কারণ, জীবিকার প্রয়োজনে অনেকে অটোরিকশা নিয়ে নামছেন, এটা যেমন সত্য; অন্যদিকে অনেক কোট-টাই পরা ভদ্রলোক আছেন যারা চিন্তা করেন যে একটা গাড়ি বা একটা সিএনজি কিনতে ৩০-৩৫ লাখ টাকা লাগে, সেখানে একই টাকা দিয়ে যদি ৩৫টা অটোরিকশা কেনা যায় তাহলে দৈনিক আয় অনেক বেশি হবে। অটোরিকশার জন্মটাই হয়েছে অনিয়ন্ত্রিতভাবে। এই জন্মটা ঠেকাতে হলে নিবন্ধনের আওতায় আনতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।’
এভাবে চলতে থাকলে সামনে ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে— উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘শুধু ঢাকা নয়, পুরো বাংলাদেশই যানজটের কবলে ডুবে যাবে। আগে আমরা ভাবতাম যানজট কেবল ঢাকার সমস্যা, কিন্তু এখন প্রায় প্রতিটি শহর, এমনকি উপজেলা পর্যন্ত এই সমস্যার শিকার হচ্ছে। বাণিজ্যিক বাহন চালানোর ক্ষেত্রে যাত্রী ও অন্য যানবাহনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এখানে সেটা মানা হচ্ছে না। এটা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে অবহেলারই প্রতিফলন, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’
এমএসি/এমএআর/