খুলনা বিভাগ
সড়কে বাড়ছে বেপরোয়া অটোরিকশা, বাড়ছে যানজট-দুর্ঘটনা
খুলনায় অনিয়ন্ত্রিতভাবে চলছে ইজিবাইক (অটো)। দিন দিন বেড়েই চলেছে ব্যাটারিচালিত এই যান। দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সড়ক-মহাসড়ক। অনভিজ্ঞ চালকদের যত্রতত্র পার্কিংয়ে দুর্ভোগে পথচারীরা। ছুটছে অনুমোদনের চেয়ে তিন-চারগুণ বেশি ইজিবাইক। আমদানির পাশাপাশি অবৈধভাবে গড়ে উঠছে এই বাহনের কারখানা।
ইজিবাইকের সংখ্যার পাশাপাশি বাড়ছে বিদ্যুতের চাহিদাও। প্রশাসনের চোখের সামনেই ইজিবাইক-অটোরিকশা চললেও কার্যকর পদক্ষেপ নেই বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। শিল্পনগরী খুলনার পাটকলগুলো বন্ধ থাকায় শ্রমিকরা বেকার হয়ে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক-রিকশা চালানোর পেশায় ঝুঁকছে। শহরে ব্যাটারিচালিত যানবাহন বৃদ্ধির পেছনে অন্যতম কারণ এটি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এতে একদিকে তৈরি হচ্ছে অসহনীয় যানজট, অন্যদিকে বাড়ছে দুর্ঘটনা। ঝড়ছে অসংখ্য প্রাণ, পঙ্গুত্ববরণ করছেন অনেকেই। শুধু খুলনা শহরে নয়, গোটা বিভাগেই ইজিবাইকের একই চিত্র।
বিজ্ঞাপন
জানা গেছে, গত ২৫ আগস্ট সকালে ডুমুরিয়া উপজেলার খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কের জিলেরডাঙ্গা এলাকায় ইজিবাইক ও পিকআপের সংঘর্ষের ঘটনায় চারজন নিহত হন। এতে মুহূর্তেই নিভে যায় চারটি পরিবারের আলোক প্রদীপ। এ সময় আহত হয় আরও চারজন। এর আগে গত ৯ জুন সকাল ৬টার দিকে খানজাহান আলী সেতুর (রূপসা সেতু) পশ্চিম প্রান্তে দারোগার লিজ নামক স্থানে ট্রাকের ধাক্কায় ইজিবাইকের চালকসহ দুইজন নিহত হন। চলতি বছরে ইজিবাইকের শুধু এই দুটি ঘটনায় নয়, ঘটেছে আরও দুর্ঘটনা। হতাহত হয়েছে অসংখ্য মানুষ। গেল ৮ মাসে শুধুমাত্র ওই মহাসড়কে ১৬টি দুর্ঘটনা ঘটেছে।
বিজ্ঞাপন
খুলনার খর্নিয়া হাইওয়ে থানা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত গেল ৮ মাসে খুলনা-ডুমুরিয়া-পাইকগাছা-সাতক্ষীরা সড়কে ১৬টি দুর্ঘটনায় ২০ জন নিহত ও ১৭ জন আহত হন।
শুধু ওই সড়কটিই নয়, ২০২৪ সালে খুলনা জেলা ও মহানগরসহ বিভাগের ১০ জেলায় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে ৬৮৯টি। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ৬৩৩ জন। আহত হয়েছেন ৬৫১ জন।
সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথোরিটির (বিআরটিএ) খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিসংখ্যান মতে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভাগের জেলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে যশোরে। এ জেলায় ১৫০টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন ১৩৪ জন এবং আহত হন ১৫৫ জন। খুলনা জেলায় সংঘটিত সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ৩৬টি। এতে নিহত হন ৪০ জন এবং আহত হন ২৯ জন। বাগেরহাট জেলায় সংঘটিত ৭৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন ৭৪ জন এবং আহত ১০৬ জন।
সাতক্ষীরা জেলায় সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ৫৩টি, এতে নিহত হন ৫৮ জন এবং আহত হন ৬৩ জন। যশোর জেলায় সংঘটিত ১৫০টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন ১৩৪ জন এবং আহত হন ১৫৫ জন। নড়াইলে ২৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন ২৯ জন এবং আহত হন ৪০ জন। মাগুরায় ৩৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩০ জন নিহত এবং ৩০ জন আহত হন। ঝিনাইদহে ৭৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন ৭৯ জন এবং আহত হন ৬৬ জন। কুষ্টিয়ায় ৯৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৮১ জন নিহত ও ৪৩ জন আহত হন। চুয়াডাঙ্গায় ৯৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭৭ জন নিহত এবং ৭৭ জন আহত হন। মেহেরপুরে ৪২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩১ জন নিহত এবং ৪২ জন আহত হন।
ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে, খুলনায় ৭২টি ইজিবাইকের চার্জিং পয়েন্ট রয়েছে। তাদের জন্য দৈনিক ৮৯১ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ বরাদ্দ থাকে। তবে স্থানীয় একাধিক সূত্র বলছে, খুলনায় কয়েকশ ইজিবাইকের চার্জিং পয়েন্ট রয়েছে। প্রতিটি চার্জিং পয়েন্টে ৫-২০টি ইজিবাইক চার্জ দেওয়া হয়। কোনো কোনো স্থানে এই সংখ্যা আরও বেশি। ফলে বিদ্যুৎ ঘাটতির অন্যতম কারণ হিসেবে দাঁড়াচ্ছে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও রিকশা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি ইজিবাইক চার্জিং পয়েন্টের মালিক জানান, একটি ইজিবাইকের ব্যাটারি চার্জে দৈনিক ১০-১২ ইউনিট বিদ্যুৎ প্রয়োজন হয়। প্রতি ইউনিটের জন্য ১৬ টাকা করে নেন তারা।
খুলনা সিটি কর্পোরেশনের লাইসেন্স অফিসার শেখ মো. দেলওয়ার হোসেন বলেন, সর্বশেষ ২০১৯ সালে নগরীতে ৭ হাজার ৮৯৮টি যাত্রীবাহী এবং ২০২১ সালে ২ হাজার ৯৬টি পণ্যবাহী ইজিবাইকের লাইসেন্স দেওয়া হয়। এছাড়া ২০০৫-২০০৬ সালে ১৭ হাজার রিকশার লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল। তবে বর্তমানে রিকশার পরিমাণ কম রয়েছে। নগরীতে এখন ১৫ থেকে ২০ হাজার ইজিবাইক চলাচল করছে।
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) খুলনার সাধারণ সম্পাদক মো. মাহাবুবুর রহমান মুন্না বলেন, সিটি কর্পোরেশন ৭ থেকে ৮ হাজার লাইসেন্স দিয়েছে, কিন্তু ২৫-৩০ হাজার ইজিবাইক নগরীতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ফলে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে, যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। নগরীতে ইজিবাইক চলাচল নিয়ন্ত্রণে কেসিসি এবং কেএমপির ট্রাফিক বিভাগ সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। বার বার বলা স্বত্ত্বেও তারা কাজের কাজ করছে না। ইজিবাইক এখন নগরবাসীর কাছে বিষফোড়া হয়ে দেখা দিয়েছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) খুলনা জেলা কমিটির সম্পাদক অ্যাডভোকেট কুদরত-ই-খুদা বলেন, ইজিবাইক শুধু খুলনা নয়, সারাদেশে চলাচল করছে। বিআরটিএ আছে, তাদের পলিসি নিতে হবে কী পরিমাণ ইজিবাইক রাস্তায় চলাচলের অনুমোদন দেবে। একেবারেই নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ইজিবাইক আমদানি, তৈরি ও বিপণন হচ্ছে। ইজিবাইক চললে তার যন্ত্রাংশ লাগবে। কতুটুকু পরিমাণ যন্ত্রাংশ আনা যাবে, এর বাইরে যন্ত্রাংশ আমদানি করতে দেবে না। এই পলিসির জায়গায় যদি সরকার চিন্তা করতে পারে তাহলে ইজিবাইক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।
বিভাগের অন্যান্য জেলায়ও অটোরিকশার একই চিত্র দেখা গেছে।
সাতক্ষীরা
সাতক্ষীরা শহরে দিন দিন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে যানজট। সরু সড়ক, ফুটপাত দখল আর নিয়ন্ত্রণহীন ইজিবাইকের চলাচল মিলে জনজীবন হয়ে পড়েছে দুর্বিষহ। অনুমোদনের ৬/৭ গুণ বেশি ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত ভ্যান চলাচল করছে।
পৌরসভা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে পৌরসভা ৬৯৫টি ইজিবাইকের লাইসেন্স অনুমোদন করে। এরপর থেকে নতুন কোনো লাইসেন্স দেওয়া হয়নি। তবে চলছে ৪ থেকে ৫ হাজারের বেশি।
সাতক্ষীরার ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টিআই) প্রশাসন শাহাবুদ্দিন মোল্লা ঢাকা পোস্টকে বলেন, “পৌরসভার অনুমতি পাওয়া ইজিবাইক ৬৯৫টি হলেও শহরে ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি গাড়ি চলছে। এজন্য প্রতিটি আইনশৃঙ্খলা সভায় পৌরসভাকে বলা হয়েছে তাদের অনুমোদিত গাড়িগুলোকে নির্দিষ্ট রঙে চিহ্নিত করতে। আর অন্যান্য উপজেলার গাড়িগুলোকে বলা হয়েছে তারা যেন নিজ নিজ থানার এলাকায় চলে, শহরে না আসে।
সাতক্ষীরা পৌরসভার প্রশাসক মাশরুবা ফেরদৌস বলেন, জেলা আইনশৃঙ্খলা সভায় আলোচনা হয়েছে—পৌরসভার অনুমোদিত ইজিবাইক সংখ্যা আপাতত ৬৯৫। তবে নিয়ন্ত্রণে আনতে লাইসেন্স সংখ্যা বাড়ানোর প্রস্তাব এসেছে। একইসাথে আমরা পুলিশ বিভাগের সহযোগিতা চেয়েছি, যাতে লাইসেন্সবিহীন যানবাহন পৌর এলাকায় চলাচল করতে না পারে।
সমাজকর্মী মাধব চন্দ্র দত্ত বলেন, যানজট আর সড়ক দুর্ঘটনা এখন সাতক্ষীরার মানুষের নিত্যদিনের দুঃখ। অনুমতিবিহীন ইজিবাইক, ফুটপাত দখল আর সড়কের অব্যবস্থাপনাই এর মূল কারণ। এতে প্রতিদিন মানুষ শুধু সময়ই হারাচ্ছে না, অনেক পরিবার পঙ্গুত্ব ও অকাল মৃত্যুতে নিঃস্ব হচ্ছে। এখনই যদি কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে।
বাগেরহাট
এক সময়ের শান্ত-নিরিবিলি শহর বাগেরহাট এখন ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকের ভিড়ে হাঁসফাঁস করছে। জেলা সদর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রাম সর্বত্রই এ যানবাহনের দাপট। কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হলেও লাগামহীন বৃদ্ধির কারণে ভয়াবহ যানজট, দুর্ঘটনা আর প্রাণহানি এখন প্রতিদিনের দৃশ্য।
আরও পড়ুন
ট্রাফিক পুলিশের তথ্যমতে, গত এক বছরে শুধু সদর ও আশপাশের এলাকায় ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকে অন্তত ৫০টির বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে আহত হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করেছে অনেকেই। জেলায় নিবন্ধিত রিকশার সংখ্যা এক হাজারেরও কম, সেখানে অনিবন্ধিত সংখ্যা ৬ হাজারেরও বেশি বলে ধারণা করে থাকেন অধিকাংশ মানুষ। এর ফলে প্রতিদিন সদর হাসপাতাল মোড়, দশানী মোড় আর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল এলাকায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজট লেগে থাকে। অটোরিকশা চার্জ দেওয়াই এখন বিদ্যুৎ সংকটের বড় কারণ। রাত ৯টার পর গ্যারেজে গ্যারেজে ব্যাটারি চার্জ শুরু হলে চাহিদা হঠাৎ বেড়ে যায় বিদ্যুতের।
জেলা পল্লী বিদ্যুতের জেনারেল ম্যানেজার সুশান্ত রায় জানান, প্রতিটি ইজিবাইক চার্জে প্রায় ২ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ লাগে। হিসাব অনুযায়ী প্রতি দুই হাজার ইজিবাইকের জন্য প্রায় ৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন।
সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এমএ লিটন বলেন, শহরগুলো এখন ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা-ইজিবাইকের জঞ্জালে পরিণত হয়েছে। মানুষের জীবন ঝুঁকির মুখে। এখনই সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আনতে কঠোর নীতি দরকার।
অটোরিকশা চালক মো. রহিম মিয়া বলেন, আগে কোনো কাজ ছিল না। রিকশা চালিয়ে দিনে ৫০০-৭০০ টাকা আয় হতো। কিন্তু এখন গাড়ি এত বেড়েছে যে আয়ও কমে গেছে। জেলার তিনটি পৌরসভা ও স্থানীয় প্রশাসন থেকে হাজার ইজিবাইক নিবন্ধিত থাকলেও আরও ৬-৭ হাজার যান নিবন্ধন ছাড়াই চলছে। ফলে একদিকে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ ভেঙে পড়েছে, অন্যদিকে অটোরিকশা নির্ভর শহর বাগেরহাটের ওপর নেমে আসছে অঘোষিত ‘যানবাহন সংকট’।
ঝিনাইদহ
ঝিনাইদহে সড়ক-মহাসড়ক, শহর-গ্রাম দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কয়েক হাজার ইজিবাইক। নতুন নতুন কারখানা গড়ে, সেখানে তৈরি হচ্ছে ব্যাটারি চালিত ইজিবাইক। অতিরিক্ত ইজিবাইকের কারণে দুর্ঘটনায় মৃত্যু, পঙ্গুত্ববরণসহ অসহায় জীবনযাপন করা মানুষের সংখ্যাও কম নয়। আর বেপরোয়া চালকদের যত্রতত্র ইজিবাইক পার্কিং করায় তীব্র যানজটের ফলে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছে শহরবাসী।
আরাপপুর হাইওয়ে পুলিশের দেওয়া তথ্যে জানা যায়, ঝিনাইদহ-চুয়াডাঙ্গা মহাসড়ক, ঝিনাইদহ- কুষ্টিয়া মহাসড়ক, ঝিনাইদহ-মাগুরা মহাসড়কে গত ২০২৪ সালে তিনটি ইজিবাইক দুর্ঘটনা ঘটে। সেখানে তিনটি ইজিবাইক চালকের মৃত্যু হয়। এছাড়াও ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত দুইটি ইজিবাইক দুর্ঘটনায় দুইজনের মৃত্যু হয়েছে।
ঝিনাইদহের পৌরসভাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে ঝিনাইদহ পৌরসভায় ২ হাজার ৫০০টি ইজিবাইকের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তবে পৌরসভা এলাকায় সাড়ে তিন হাজারের বেশি ইজিবাইক চলাচল করে থাকে। যার কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই। এসব ইজিবাইক গ্রামাঞ্চল থেকে শহরে রোগী এবং কৃষিপণ্য আনা নেওয়ার কাজ করে। এছাড়াও জেলা শহরের বাইরে ১ হাজার ৫৭০টি ইজিবাইকের অনুমোদন দেওয়া হলেও ১ হাজার ৩০০টির বেশি লাইসেন্সবিহীন ইজিবাইক চলাচল করছে।
ঝিনাইদহ ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ওজোপাডিকো) নির্বাহী প্রকৌশলী দীন মোহাম্মদ মহিম বলেন, জেলায় অনুমোদিত ৮০টির মতো প্রি-পেইড চার্জিং স্টেশন রয়েছে। সেখানে ইজিবাইকের ব্যাটারি চার্জ দেওয়া হয়। যেখানে চার্জিং লোডে প্রতি ঘণ্টায় ১ হাজার ৬৪০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হয়। একটি ইজিবাইকের জন্য মাসে গড়ে ৩৫০ থেকে ৪০০ ইউনিট বিদ্যুৎ খরচ হয়ে থাকে।
ঝিনাইদহ পৌরসভার প্রাশাসক (উপপরিচালক, স্থানীয় সরকার) রথীন্দ্র নাথ রায় বলেন, চলতি বছরে ঝিনাইদহ পৌরসভায় ২ হাজার ৫০০ ইজিবাইক অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও গ্রামাঞ্চল থেকে শহরে রোগী এবং কৃষিপণ্য আনা নেওয়া করে যে সকল ইজিবাইক সেগুলো আমাদের হিসাবের বাইরে। তবে অবৈধ ইজিবাইকের বিরুদ্ধে সপ্তাহে একদিন পৌরসভা থেকে অভিযান চালানো হয়। অভিযানে কোনো ইজিবাইক ধরা পড়লে তাদেরকে জরিমানা করে অনুমোদন দেওয়া হয়।
মাগুরা
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রবেশদ্বার মাগুরা জেলা। ১০৪৯ বর্গকিলোমিটারের ছোট এই জেলা শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থান ভায়না মোড়, ঢাকা রোড, চৌরঙ্গী মোড়, নতুন বাজার, পুলিশ লাইন ও ভিটাশাইর এলাকায় এখন প্রতিদিনই চোখে পড়ে তীব্র যানজটের দৃশ্য। যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং, অনভিজ্ঞ চালক, ফুটপাত দখল করে ব্যবসা— সব মিলিয়ে শহরের সড়কগুলোতে নিত্যদিন তৈরি হচ্ছে অসহনীয় যানজট।
ইজিবাইক সংশ্লিষ্টরা জানান, কয়েক বছরের ব্যবধানে জেলায় ইজিবাইকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬-৭ হাজারে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও ২-৩ হাজার ব্যাটারি চালিত রিকশা ও ভ্যান। শহরের অভ্যন্তরীণ সড়কগুলো থেকে শুরু করে রাস্তার মোড়ে অবৈধ স্ট্যান্ডে সারাদিনই যানজট লেগে থাকে। চালকদের অনেকেই নিয়ম-কানুন মানেন না। এমনকি ১২-১৩ বছরের কিশোররাও গাড়ি চালায়। অদক্ষ চালক ও অনিয়ন্ত্রিত ইজিবাইকের কারণে প্রতিদিন ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা।
শ্রীপুর থেকে নিয়মিত মাগুরা শহরে আসা চাকরিজীবী শাহনেওয়াজ বলেন, আগে শহরে এত ভিড় ও যানজট ছিল না। এখন শহরে প্রবেশই দুরূহ হয়ে উঠেছে। জানি না প্রশাসন এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে কিনা।
ইজিবাইক চালক আল আমিন ও সাইফুল জানান, পৌরসভা থেকে নিবন্ধন করলেও হাইওয়েতে উঠলে পুলিশ মামলা দেয়। এতে আয় কমে যাচ্ছে, আবার ঝামেলাও বাড়ছে।
রামনগর হাইওয়ে পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলমগীর কবীর বলেন, হাইওয়ে ছোট যানবাহনের জন্য নয়। তাই ইজিবাইক হাইওয়েতে উঠলে আমরা সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ অনুযায়ী মামলা দেই।
মাগুরা পৌরসভার নির্বাহী কর্মকর্তা গাজী মো. আবুল কাশেম জানান, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে পৌরসভায় মোট ১ হাজার ১৫৬টি ইজিবাইক নিবন্ধিত হয়েছে। সেগুলোকে লাল ও সবুজ রঙে বিভক্ত করে একদিন অন্তর শহরে চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে নিবন্ধিত যানবাহনের বাইরেও হাজারো অবৈধ ইজিবাইক শহরে অবাধে চলছে। এজন্য ইতোমধ্যে অনিবন্ধিত ইজিবাইক নিয়ন্ত্রণে ১৩ সদস্যের একটি টিম কাজ করছে।
ওজোপাডিকোর মাগুরার সহকারী প্রকৌশলী মো. আব্দুল হালিম জানান, মাগুরা পৌর এলাকায় বর্তমানে ব্যাটারি চার্জিং স্টেশন রয়েছে ২৮টি। এগুলোতে মাসে প্রায় ৪৫ হাজার ইউনিট বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে। তবে চার্জিং স্টেশন ছাড়াও অনেক চালক সাধারণ গ্রাহক হিসেবে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে ব্যাটারি চার্জ করেন।
যশোর
যানজটে যশোর শহর চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। প্রতিনিয়ত ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে জনসাধারণকে। শুধু যানবাহনই নয়, গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে এখন সাধারণ মানুষের হেঁটে চলাই কষ্টকর হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে ব্যাটারিচালত ইজিবাইক ও রিকশার দৌরাত্ম্য কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। শহরের দড়াটানা, চৌরাস্তা, মণিহার, আরএন রোড, বড়বাজার, কাঠেরপুল, চুয়াডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডে যানজট লেগেই থাকে।
যশোর পৌরসভার তথ্য অনুযায়ী, চার হাজার ৪৭৮টি ইজিবাইক, দুই হাজার ৯৭৩টি রিকশা, ২৪টি স্মার্ট রিকশা ও ২৯৩টি ভ্যানের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। সবমিলিয়ে শহরে সাত হাজার ৭৬৮টি বৈধ যানবাহন রয়েছে। তবে শহরজুড়ে প্রায় ২০-৩০ হাজার অনিবন্ধিত ভ্যান-ইজিবাইক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।
মোটরসাইকেল চালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, যশোর শহর এখন যানজটের শহরে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে সকাল ১০টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত এবং বিকেল ৫টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত এ অবস্থা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। এর মধ্যে সাড়ে ১১টায় পুরো শহর ব্লক হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়।
লাইসেন্সবিহীন কয়েকজন ইজিবাইক চালক ও রিকশা চালকদের জানান, তাদের অধিকাংশের বাড়ি যশোর সদর উপজেলার বাইরে। ভোরেই তারা যানবহন নিয়ে শহরে চলে আসেন। রাতে বাড়ি ফেরেন।
যশোর জেলা পুলিশের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর মাহাফুজুর রহমান বলেন, শহরজুড়ে অনিবন্ধিত ভ্যান-ইজিবাইকের সংখ্যা ২০-৩০ হাজার। শুক্রবার ও শনিবার শহরে যানজট ভয়াবহ রুপ ধারণ করে। সরকারি ছুটির এ দুই দিনে যশোরে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আসেন। ফলে সব উপজেলা থেকে ইজিবাইক শহরে রোগী নিয়ে ঢুকে যানজট সৃষ্টি করে। মানবিক বিবেচনায় আমরা ব্যবস্থা নিতে পারছি না। অতিরিক্ত পুলিশ সড়কে দায়িত্ব পালন করলেও যানজট নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছি।
যশোর পল্লীবিদ্যুৎ সমিতি-১ এর সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার হরেন্দ্রনাথ বর্মন জানান, প্রতিটি ভ্যান এক কিলোওয়াট লোড নেয়। অর্থ্যাৎ প্রতিদিন তিন ইউনিট বিদ্যুৎ গ্রহণ করে। বর্তমানে ১০০-১০৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমাদের চাহিদা রয়েছে। যখন এসব ব্যাটারিচালিত যানবাহন ছিল না তখন প্রতি মাসে ৬০-৬৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ব্যয় হতো।
যশোর পৌরসভার প্রশাসক রফিকুল হাসান বলেন, আমরা যানজট নিরসনে কাজ শুরু করেছি। ইতোমধ্যে অনিবন্ধিত ইজিবাইকের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়েছে। বেশ কয়েককটি আটক করা হয়েছে। অভিযান নিয়মিত হলে আশা করছি যানজট কমবে।
মেহেরপুর
সারাদেশের ন্যায় মেহেরপুর জেলাতেও সড়ক-মহাসড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক। এতে জেলা শহরে ব্যাপক যানজট বৃদ্ধির পাশাপাশি সড়কে বেড়েছে দুর্ঘটনা।
জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ের দেওয়া তথ্য মতে, জেলাতে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক (অটোরিকশা), পাখি ভ্যানসহ বিভিন্ন যানবাহনের দুর্ঘটনায় এক বছরে ২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে আর গুরুত্বর আহত হয়েছেন ১১ জন।
মেহেরপুর জেলা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালক ও মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা জানান, জেলাতে নিবন্ধিত ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক রয়েছে ২ হাজার আর অনিবন্ধিত ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক, পাখিভ্যান রয়েছে ১০ হাজারের বেশি। ছোট জেলার তুলনায় যা অনেক বেশি। এতে জনদুর্ভোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি ব্যাটারির সীসার কারণে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে।
মেহেরপুর স্থানীয় সরকার ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক মো. তরিকুল ইসলাম জানান, শুধু পৌর শহরেই ৮৮২টি নিবন্ধিত ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা রয়েছে। আর অনিবন্ধিত ইজিবাইক আনুমানিক দেড় হাজার থেকে ২ হাজারের বেশি।
মেহেরপুরের অটোরিকশা প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান সিজান অটোজ-এর মালিক সাইফুল ইসলাম জানান, শুরুর দিকে অটোরিকশার দাম এক লাখ থেকে এক লাখ দশ হাজার হলেও চাহিদা এবং তৈরির যন্ত্রাংশের দাম বেশি হওয়াতে বর্তমানে এগুলো আড়াই লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর এগুলোর টায়ার, মোটর, ব্যাটারি এবং বডিগুলো চীন থেকে আমদানি করা হয়। পরে আমাদের কারখানায় এনে আমরা সেটিং করি। কিছু কিছু যন্ত্রাংশ দেশেই পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন
গাংনী পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মুস্তাফিজুর রহমান বাবলু জানান, জেলাতে বেকারত্বের হার দিন দিন বাড়ার কারণে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অদক্ষ চালকদের কারণেই সড়কে দুর্ঘটনা ঘটছে। এছাড়া জেলাতে হাজার হাজার ইজিবাইকের ব্যাটারি চার্জ দেওয়ার কারণে বিদ্যুতের ঘাটতি হচ্ছে।
মেহেরপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার স্বদেশ কুমার ঘোষ জানান, জেলাতে প্রায় ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ রয়েছে। যা চাহিদার সমপরিমাণ, পুরোটি আমরা সরবরাহ করছি। জেলাতে ১০ হাজার অটোবাইক এবং পাখি ভ্যানে চার্জ দিতে প্রতিদিন প্রায় ১৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হয়।
জেলা ট্রাফিক পুলিশের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর আব্দুল হান্নান জানান, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বর্তমানে জাতীয় ইস্যু। এটি রোধ করতে শুধু প্রশাসন নয়, পাশাপাশি সাধারণ জনগণকে কাজ করতে হবে চালকদের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য।
কুষ্টিয়া
কুষ্টিয়া শহরে ইজিবাইক ও অটো রিকশার সংখ্যা ব্যাপকহারে বেড়েই চলেছে। কুষ্টিয়া শহরে বর্তমানে প্রায় ১০ হাজার ইজিবাইক ও ৭ হাজার অটো রিকশা চলাচল করে। যার বেশিরভাগই অনিবন্ধিত। এসব গাড়ির দৌরাত্ম্যে সড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েন পথচারীরা। এছাড়াও মাঝেমধ্যেই ঘটে দুর্ঘটনা।
কুষ্টিয়া পৌরসভা সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালে কুষ্টিয়া পৌরসভা দুই হাজার ২৭৮টি ইজিবাইককে লাইসেন্স দেয়। সেসময় অনিবন্ধিত ইজিবাইকের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫ হাজার। চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এ পর্যন্ত নবায়ন হয়েছে ৫০০ টি। বর্তমানে কুষ্টিয়া শহরে প্রায় ১০ হাজার ইজিবাইক চলাচল করে। তারমধ্যে তিন হাজার নিবন্ধিত এবং ৭ হাজার অনিবন্ধিত ইজিবাইক। কুষ্টিয়া শহরে বর্তমানে সাত হাজার ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচল করে। যার মধ্যে এক হাজার ৪০০টি নিবন্ধিত, বাকিগুলো অনিবন্ধিত।
কুষ্টিয়া পৌরসভার ভারপ্রাপ্ত লাইসেন্স পরিদর্শক শরিফুল ইসলাম ইয়ামিন বলেন, কুষ্টিয়া শহরে প্রায় ১০ হাজার ইজিবাইক ও সাত হাজার অটোরিকশা চলাচল করে। সেগুলো বেশিরভাগই অনিবন্ধিত। সচেতনতার অভাবে এসব যানবাহন বেড়েই চলেছে। এতে শহরে যানজট লেগেই থাকে। পৌরসভার পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় অভিযান চালানো হয়, ব্যবস্থা নেয়া হয়।
কুষ্টিয়া ট্রাফিক পুলিশের ইন্সপেক্টর শেখ শাহাদাত আলী বলেন, ইজিবাইক ও অটোরিকশা টোটালি দায়-দায়িত্ব পৌরসভার। তারা অভিযান পরিচালনা করলে আমরা ফোর্স দিয়ে সাপোর্ট দিয়ে থাকি। ইজিবাইক আটক করার এখতিয়ার আমাদের নেই।
কুষ্টিয়ার ওজোপাডিকোর দুই কর্মকর্তা বলেন, দিনদিন ইজিবাইক ও অটোরিকশার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। চার্জিং সেন্টারও বাড়ছে। ওজোপাডিকোর আওতায় নিবন্ধিত ৬০টি চার্জিং সেন্টার রয়েছে। এছাড়াও অনেকেই ব্যক্তিগত বিদ্যুৎ লাইনের মাধ্যমে চার্জ দেন।
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) কুষ্টিয়া জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক শাহারিয়া ইমন রুবেল বলেন, কুষ্টিয়া শহরে ব্যাটারি চালিত অটোরিকশার অনিয়ন্ত্রিত বিস্তার মারাত্মক সমস্যা তৈরি করেছে। যেখানে পৌরসভার অনুমোদন দেওয়ার সীমা সর্বোচ্চ ৩ হাজার, সেখানে বর্তমানে ১০ থেকে ১২ হাজার অটোরিকশা শহরে চলাচল করছে। ফলে সড়কে তীব্র যানজট সৃষ্টি হচ্ছে এবং প্রায়ই ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। অটোরিকশা নাগরিক জীবনে এক বড় অভিশাপে পরিণত হয়েছে।
কুষ্টিয়া পৌরসভার প্রশাসকের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মো. মিজানুর রহমান বলেন, ইজিবাইক ও অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব শুধু পৌরসভার একার না, পৌরসভা পারমিশন দিয়ে থাকে। যাদের পৌর পারমিশন নেই, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে পুলিশ। অবৈধ ইজিবাইক ও অটোরিকশার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য ট্রাফিক বিভাগকে আমরা বলে দিয়েছি। আমরা এ সমস্যা সমাধানে সম্মিলিতভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
চুয়াডাঙ্গা
চুয়াডাঙ্গায় লাগামহীনভাবে বাড়ছে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক। যার ফলে দুর্ঘটনা, যানজট, বিদ্যুতের ওপর বাড়তি চাপ ও জনভোগান্তি এখন নিত্যদিনের চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। জেলায় বর্তমানে লক্ষাধিকের বেশি ইজিবাইক চলাচল করছে। অথচ চারটি পৌরসভার মধ্যে কেবল জীবননগর পৌরসভায় ২০২৪ সালে ২০৪টি ইজিবাইক নিবন্ধিতের তথ্য পাওয়া গেছে। তবে জেলা ট্রাফিক পুলিশের হিসেবে প্রায় লক্ষাধিক ইজিবাইক জেলাজুড়ে চলছে। এর অধিকাংশই চলছে অদক্ষ ও কিশোর চালকের হাতে।
চুয়াডাঙ্গা বিআরটিএ অফিসের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের ১ আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ইজিবাইক সংশ্লিষ্ট ২২টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ১৬ জন প্রাণ হারিয়েছেন এবং ২৫ জন আহত হয়েছেন।
স্থানীয়রা বলছেন, এসব দুর্ঘটনার বড় অংশ ঘটছে কিশোর ও অদক্ষ চালকের বেপরোয়া আচরণের কারণে।
একদিকে ইজিবাইকের চাহিদা যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে দামও। কয়েক বছর আগে ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকায় একটি ইজিবাইক কেনা যেত। বর্তমানে আড়াই লাখ থেকে ২ লাখ ৭০ হাজার টাকার নিচে কোনো ইজিবাইক নেই।
চালক জসিম উদ্দিন বলেন, শুরুতে ১ লাখ টাকা দিয়ে ইজিবাইক কিনেছিলাম। এখন সেই ইজিবাইকের দাম আড়াই থেকে ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা।
বিদ্যুতের ওপরও চাপ তৈরি করছে এসব যান। সদর উপজেলায় ৪০টি, দামুড়হুদায় ২১৭টি ও আলমডাঙ্গায় ২টি চার্জিং গ্যারেজ আছে। জীবননগরে কোনো আনুষ্ঠানিক চার্জিং গ্যারেজ না থাকলেও ঘরোয়াভাবে চার্জ দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পল্লী বিদ্যুতের কর্মকর্তারা।
ওজোপাডিকো চুয়াডাঙ্গার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আহসান হাবীব দাবি করেন, গ্যারেজ ও ব্যক্তিগত ইজিবাইক সাধারণত রাতে চার্জ দেওয়া হয়। এজন্য বড় ধরনের চাপ পড়ে না। তবে গরমের সময় লোডশেডিং কিছুটা বেড়ে যায়।
ইজিবাইকের কারণে তৈরি হওয়া যানজট এখন অসহনীয় হয়ে উঠেছে বলে জানান সাধারণ যাত্রীরা। সদর হাসপাতালের সামনে অপেক্ষমাণ যাত্রী আব্দুল আওয়াল বলেন, আগে ১০ মিনিটে যেতাম এমন রাস্তা এখন আধাঘণ্টায়ও যাওয়া যায় না। ইজিবাইক যেখানে খুশি থামে, উল্টোপথে চলে। দুর্ঘটনাও নিয়মিত ঘটছে।
তবে চালকদের বক্তব্য ভিন্ন। আকাশ নামের একজন ইজিবাইক চালক বলেন, আমরা সংসার চালানোর জন্য ইজিবাইক চালাই। প্রতিদিন ভাড়া মিটিয়ে যা থাকে তা দিয়েই বাঁচি। কিন্তু মামলা আর হয়রানিতে কষ্ট হচ্ছে। সরকার যদি নিয়ম করতো, নিবন্ধন দিতো, তাহলে স্বস্তিতে গাড়ি চালাতে পারতাম।
চুয়াডাঙ্গা ট্রাফিক পুলিশের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আমিরুল ইসলাম জানান, জেলাজুড়ে আনুমানিক প্রায় লক্ষাধিক ইজিবাইক রয়েছে। তাদের লাইসেন্স বা নিবন্ধন নেই। আগে পৌরসভা থেকে কার্ডের মাধ্যমে নিবন্ধন দেওয়া হতো, যা গত এক বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। এখন শহরে প্রতিদিন যানজট হয়। এজন্য অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন করতে হয়। অনেক অদক্ষ চালক ও কিশোর ইজিবাইক চালায়, ফলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়েছে। শুধু গত মাসেই ৪২টি মামলা দিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চুয়াডাঙ্গা জেলার সভাপতি ও সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ইজিবাইক একদিকে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সাশ্রয়ী যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি করেছে। কিন্তু নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ছড়িয়ে পড়ায় এটি এখন জনদুর্ভোগের কারণ। সরকারের উচিত জরুরি ভিত্তিতে নীতিমালা প্রণয়ন করে খাতটিকে নিয়ন্ত্রণে আনা। চুয়াডাঙ্গার মতো ছোট্ট জেলায় হাজার হাজার ইজিবাইক চলছে। দুর্ভোগ, জ্যাম, অদক্ষ চালকের কারণে দুর্ঘটনা বাড়ছে। তবে শুধু নিয়ন্ত্রণ দিলেই সমাধান হবে না, আগে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। না হলে তারা বেকার হয়ে অপরাধে জড়িয়ে পড়বে।
এই প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন সাতক্ষীরা প্রতিনিধি ইব্রাহিম খলিল, বাগেরহাট প্রতিনিধি আবু তালেব, ঝিনাইদহ প্রতিনিধি আব্দুল্লাহ আল মামুন, মাগুরা প্রতিনিধি তাছিন জামান, যশোর প্রতিনিধি রোজোয়ান বাপ্পী, মেহেরপুর প্রতিনিধি তরিকুল ইসলাম, কুষ্টিয়া প্রতিনিধি রাজু আহমেদ ও চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি আফজালুল হক।
আরএআর