দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রধান কার্যালয়

দেশের অর্থ পাচার করে মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছেন এমন এক হাজার ৫০ জনের একটি তালিকা নিয়ে ২০১৪ সালে অনুসন্ধানে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা পাচারের এমন অভিযোগ অনুসন্ধানের একপর্যায়ে অর্ধশতাধিক ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য পেতে ২০১৮ সালের প্রথম দিকে মালয়েশিয়ায় মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট (এমএলআর) পাঠায় সংস্থাটি।

তবে মালয়েশিয়া থেকে পাওয়া যায়নি কাঙ্ক্ষিত তথ্য-উপাত্ত। ফলস্বরূপ ওই অভিযোগের অধিকাংশেরই সুরাহা হয়নি কিংবা আইনের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে গেছেন অনেক ভিআইপি। পাচার করা অর্থও আর দেশে ফেরানো যায়নি।

বিষয়টির সত্যতা মেলে সংস্থাটির বর্তমান চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহর বক্তব্যেও। তিনি বলেন, ‘অল্প সময়ের মধ্যে আমার অভিজ্ঞতা হচ্ছে, মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত ডকুমেন্ট এবং তথ্য পাওয়াই এখন আমাদের জন্য প্রধান অন্তরায়। অনেক দেশ প্রশ্ন করে, সংশ্লিষ্ট অভিযোগের বিষয়ে মামলা হয়েছে কি না? মামলা হলে তারা তথ্য দেবে। কিন্তু আমরা মামলা করার জন্যই তথ্য চাই। এমন নানা ধরনের সমস্যা রয়েছে। এ সমস্যা অতিক্রমের জন্য আমরা পরিকল্পনা করছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট ফোরামে স্বাক্ষরও করেছি। সত্য কথা কী, সব দেশ থেকে সময় মতো তথ্য ও সহযোগিতা পাচ্ছি না।’

বিদেশে এমএলআর পাঠানোর বিষয়ে দুদক থেকে প্রাপ্ত এক পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, অর্থপাচারসহ বিভিন্ন অভিযোগের অনুসন্ধান ও তদন্তের স্বার্থে ২০০৭ সাল থেকে বিভিন্ন ব্যক্তির অর্থপাচারের তথ্য চেয়ে যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এখন পর্যন্ত অর্ধশতাধিক এমএলআর পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ২৫টি এমএলআর’র মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ তথ্য আদায় করতে সক্ষম হয়েছে সংস্থাটি। বাকিগুলোর বিষয়ে পাওয়া যায়নি কাঙ্ক্ষিত তথ্য-উপাত্ত কিংবা জবাব।অনেকগুলোর আদৌ কোনো জবাব দেয়নি সংশ্লিষ্ট দেশ।

বিদেশে চিঠি (এমএলআর) পাঠানোর পরও তথ্য-উপাত্ত না পাওয়ার বিষয়টি অনেকে জিটুজি (সরকার টু সরকার) সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর না থাকাকে দায়ী করছেন। তবে কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, চুক্তি থাকলেই যে সব তথ্য মিলবে এমন গ্যারান্টিও দেওয়া যায় না। এছাড়া নিজেদের সুরক্ষার বিষয়টি মাথায় রেখে অধিকাংশ দেশ সমঝোতা চুক্তি সই করতে চায় না। এজন্য দুদকের বর্তমান কমিশন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বা কনসালটেন্ট নিয়োগের বিষয়টি বিবেচনা করছে। যারা সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করে বাংলাদেশের স্বার্থে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করবে।

সংবাদ সম্মেলনে দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ

এ বিষয়ে দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মো. মোজাম্মেল হক খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, অর্থপাচারকারীদের তথ্য-উপাত্ত পেতে বিভিন্ন দেশে এমএলআর পাঠানো হয়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জবাব পাওয়া যায় না। ফলে মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত অভিযোগ কিংবা মামলার তদন্তে গতি পাচ্ছে না। যে কারণে আমরা এমএলআর জবাব পেতে কনসালটেন্ট (পরামর্শদাতা) নিয়োগের বিষয়টি ভাবছি। আগেও এমন পদ্ধতি চালু ছিল। সে সময় তুলনামূলকভাবে এমএলআর’র জবাব কিংবা কাঙ্ক্ষিত তথ্য-উপাত্ত বেশি পাওয়া যেত।

এমএলআর’র মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত পেতে সহযোগী হিসেবে ফেরদৌস আহমেদ খানের মালিকানাধীন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘অক্টোখান’ নামের একটি কনসালটেন্ট ফার্মকে ২০০৯ সালের ৪ জানুয়ারি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছিল দুদক। দুই দফা চুক্তির নবায়ন হলেও ২০১৫ সালের পর চুক্তি আর নবায়ন হয়নি। সে সময় ২২টি এমএলআর’র মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ তথ্য পেতে সহায়তা করতে এমএলআরপ্রতি ফি হিসাবে ১৫ লাখ টাকা করে দিতে হয়েছিল দুদককে। পরবর্তীতে খরচের বিষয়সহ নানা কারণে চুক্তি আর নবায়ন হয়নি বলে জানা গেছে।

যদিও দুদক আইন ২০০৪ অনুযায়ী, সরাসরি কোনো কনসালটেন্ট নিয়োগের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই। তবে আইনের ১৭ এর (ট)’তে ‘দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজনীয় বিবেচিত অন্য যেকোনো কার্য সম্পাদন করা’ এবং  আইনের ১৯ এর (চ)’তে অনুসন্ধান বা তদন্তকার্যে কমিশনের বিশেষ ক্ষমতার বিষয়ে বলা আছে। মূলত সেই ক্ষমতায় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বা কনসালটেন্ট প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দিয়েছিল দুদক।

ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি ও রফতানির মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে বছরে ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়

২০১২ সালের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী, ঘুষ বা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ বিদেশে পাচারের ঘটনা দুদক অনুসন্ধান ও তদন্ত করে থাকে। বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থ বিদেশে পাচারের ঘটনা তদন্ত করে এনবিআর (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড)। আর হুন্ডি বা অন্য কোনো উপায়ে অর্থপাচার হলে তা পুলিশের সিআইডি তদন্ত করে।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রধান কার্যালয়

অর্থপাচার রোধে বাংলাদেশে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন করা হয় ২০১২ সালে। সর্বশেষ ২০১৫ সালের ২৬ নভেম্বর এ আইন সংশোধন করা হয়। আইন অনুযায়ী বৈধ বা অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ বা সম্পত্তি নিয়মবহির্ভূতভাবে বিদেশে পাচার মানি লন্ডারিং অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হবে।

এমএলআর কী

এমএলআর’র পূর্ণাঙ্গ রূপ হচ্ছে মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট। অভিযোগসংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্ত পাওয়ার এক ধরনের চিঠি বা আবেদন। একটি দেশের দায়িত্বশীল সংস্থা সুনির্দিষ্ট তথ্যের বিষয়ে জানতে অন্য দেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার কাছে আইনি প্রক্রিয়ায় এ ধরনের এমএলআর প্রেরণ করে থাকে। এর আগে বাংলাদেশ থেকে অ্যাটর্নি জেনারেলের মাধ্যমে এমএলআর প্রেরণ করা হতো। বর্তমানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এমএলআর প্রেরণ করা হয়।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অর্থপাচার নিয়ে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই)। জিএফআই’র সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি ও রফতানির মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে বছরে ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়।

বিদেশ থেকে টাকা ফেরত আনার নজির মাত্র একটি

দুদকের ইতিহাসে বিদেশ থেকে টাকা ফেরত আনার একটি মাত্র নজির রয়েছে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকারের আমলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো ঘুষ হিসাবে মোট ২১ কোটি ৫৫ হাজার ৩৯৪ টাকা গ্রহণ করে সিঙ্গাপুরের একটি ব্যাংকে জমা রাখেন। বিষয়টি সিঙ্গাপুরের আদালতে প্রমাণিত হওয়ায় সিঙ্গাপুর ওভারসিস ব্যাংক থেকে তিন দফায় টাকাগুলো দুদকের অ্যাকাউন্টে ফেরত আনা হয়। ২০১২ ও ২০১৩ সালে তিন দফায় ওই অর্থ ফেরত আসে। সেখান থেকে ১০ শতাংশ কনসালটেন্সি ফি হিসাবে মোট দুই কোটি ১০ লাখ পাঁচ হাজার ৫৩৯ টাকা অক্টোখানকে পরিশোধ করতে হয়।

আরএম/এমএআর/