সাক্ষাৎকার : জোনায়েদ সাকি
রক্তস্নাত অভ্যুত্থান : বিচার-সংস্কার ছাড়া জনগণকে ঐক্যবদ্ধ রাখা অসম্ভব
রক্তস্নাত অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণে বিচারব্যবস্থা সংস্কার ও গণতান্ত্রিক কাঠামো পুনর্গঠন ছাড়া জনগণকে ঐক্যবদ্ধ রাখা সম্ভব নয় বলে মনে করেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি। তার মতে, ‘সংস্কার সনদ (জুলাই সনদ) বাস্তবায়নে গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন একসঙ্গে অনুষ্ঠিত হওয়াই সবচেয়ে কার্যকর পথ।’ পাশাপাশি তিনি সতর্ক করেন, রাজনৈতিক অনৈক্য বা দলীয় স্বার্থে এই পথরেখা ব্যাহত করা হলে তা কেবল ফ্যাসিবাদী শক্তিকেই শক্তিশালী করবে।
উপদেষ্টা পরিষদের নিরপেক্ষতা, জোটবদ্ধ নির্বাচন, রাজনৈতিক ঐকমত্য, ছোট দলগুলোর অবস্থানসহ নানা প্রসঙ্গ নিয়ে তিনি ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন আদিত্য রিমন (চিফ অব পলিটিক্যাল অ্যান্ড স্টেট অ্যাফেয়ার্স) ও মুছা মল্লিক (নিজস্ব প্রতিবেদক)।
বিজ্ঞাপন
ঢাকা পোস্ট : দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আগামী নির্বাচন নিয়ে কোনো শঙ্কা দেখেন কি না?
জোনায়েদ সাকি : রক্তস্নাত অভ্যুত্থানের পরে গণতান্ত্রিক উত্তরণ এবং রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জন্য বিচার-সংস্কার ও নির্বাচন একটি অপরিহার্য বিষয়। এটা আমরা দীর্ঘদিন থেকে বলে আসছি। বিচার-সংস্কার এবং নির্বাচন এখন আমাদের জাতীয় স্বার্থে পরিণত হয়েছে। কারণ, ন্যায়বিচার ছাড়া জনগণকে ঐক্যবদ্ধ রাখা সম্ভব নয়। অন্যদিকে, যথাযথ সংস্কার করতে না পারলে রাষ্ট্র পুনর্গঠন হবে না, স্বৈরতান্ত্রিক ও ফ্যাসিবাদী কাঠামোই টিকে থাকবে। সেই সংস্কার প্রক্রিয়ায় আমাদের যেতে হবে।
বিজ্ঞাপন
এর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ‘জুলাই সনদ’ তৈরি করেছি। রাজনৈতিক দলগুলোর মতপার্থক্য সত্ত্বেও আমরা অনেকগুলো বিষয়ে একমত হয়েছি। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য নেই, সেগুলো জনমতের ভিত্তিতে সমাধান করার চেষ্টা করব। কিন্তু এসব কাজ সম্পন্ন করতে গেলে নির্বাচন অপরিহার্য। নির্বাচন ছাড়া সাংবিধানিকসহ আনুষঙ্গিক পরিবর্তনকে স্থায়ী করা সম্ভব নয়। সংসদের মাধ্যমেই এই পরিবর্তনগুলোকে স্থায়িত্ব দিতে হবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনাস্থা থাকায় আগামী সংসদের জন্য আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি করতে গণভোটের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে আমরা একমত হয়েছি। গণভোটের মাধ্যমে জনগণ আগামী সংসদকে সনদ বাস্তবায়নের ক্ষমতা দেবে।
গণভোট এবং জাতীয় নির্বাচন একসঙ্গে অনুষ্ঠিত হওয়ার মাধ্যমে আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত সংস্কারকে একটি টেকসই ও স্থায়ী রূপ দিতে পারব। ফলে নির্বাচন একদিকে যেমন অপরিহার্য, তেমনি সংস্কার বাস্তবায়নের জন্যও বিকল্প কিছু নেই। এদিক থেকে আমরা মনে করি, নির্বাচনকে যদি কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়, তবে নানা ধরনের শঙ্কা তৈরি হবে, যা আমাদের রাজনৈতিক উত্তরণ ও গণতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। আন্দোলনকারী দলগুলোর মধ্যে সংস্কার ও নির্বাচনের পথরেখা নিয়ে কোনো অনৈক্য থাকলে তা ফ্যাসিস্টদেরই সুবিধা করে দেবে।
আমরা দেখছি, কোনো কোনো দল তাদের রাজনৈতিক দলীয় স্বার্থের জন্য এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে, যাতে আমাদের এই পথরেখায় একটি আশঙ্কার জন্ম নিচ্ছে। এই আশঙ্কা তৈরি করা ঠিক হবে না। প্রতিযোগিতা স্বাভাবিক, কিন্তু এই প্রতিযোগিতা যেন জাতীয় ঐকমত্যকে ছাপিয়ে না যায়, সে বিষয়ে সব দলকে মনোযোগী হতে হবে।
ঢাকা পোস্ট : আপনারা বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করেছেন। আসন সমঝোতা হয়েছে কি না? হলে গণসংহতি আন্দোলন কয়টি আসন চেয়েছে?
জোনায়েদ সাকি : গণসংহতি আন্দোলন প্রাথমিকভাবে শতাধিক দলীয় প্রার্থীর তালিকা বাছাই করেছে এবং আমরা আমাদের প্রচার-প্রচারণাও শুরু করেছি। আমরা যেহেতু একইসঙ্গে ফ্যাসিবাদবিরোধী গণতন্ত্র মঞ্চ গড়ে তুলেছিলাম, সেখানে ছয়টি রাজনৈতিক দল আছে। ফলে জোটের দলগুলোর মধ্যেও আমরা আসন সমন্বয় করছি। গণতন্ত্র মঞ্চ থেকে আমাদের প্রায় ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেওয়ার লক্ষ্য রয়েছে।
পাশাপাশি, বিএনপিসহ যে ৩৯টি দল আমরা যুগপৎ আন্দোলন করেছি, সেই ধারাবাহিকতায় আসন্ন নির্বাচনে কোনো আসন সমঝোতা হবে কি না, সে বিষয়টি নিয়েও আলোচনা চলমান। ফলে, একদিকে দলীয় প্রচারণা, অন্যদিকে গণতন্ত্র মঞ্চের সম্প্রসারণ এবং বিএনপির সঙ্গে আসন সমঝোতা— এই তিনটি ধাপেই আমাদের কাজ চলছে। এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্টভাবে এই কাজগুলো চূড়ান্ত হয়নি।
ঢাকা পোস্ট : আপনারা নির্বাচনের দিন গণভোট চান। জামায়াত ও এনসিপি নির্বাচনের আগে গণভোট চায়। এ বিষয়টি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
জোনায়েদ সাকি : এ কথাটা আমরা কমিশনেও বলেছি। গণভোটের মাধ্যমে আমরা যা অর্জন করতে চাই, তা আগে গণভোট হলেও যা হবে, জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোট হলেও তাই হবে। যেহেতু তাৎপর্যের দিক থেকে কোনো পার্থক্য নেই, তাই একই দিনে গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন হওয়াই ভালো। ভোটার উপস্থিতি থেকে শুরু করে অনেক গুরুতর দিক বিবেচনায় এটা শ্রেয়তর।
ঢাকা পোস্ট : জুলাই সনদে বেশকিছু প্রস্তাবে বিএনপি ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে। তারা বলছে, ক্ষমতায় গেলে সেইগুলো বাস্তবায়ন করবে না— এটাকে আপনারা কীভাবে দেখছেন?
জোনায়েদ সাকি : বিষয়টি আসলে সেরকম না। মূলত জুলাই সনদের ভিত্তিতে মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়নের ক্ষমতা সংসদের ওপর অর্পণ করা হচ্ছে; একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই সংস্কারটা শেষ করার জন্য। যে সব প্রস্তাবে ঐকমত্য আছে, সেগুলো কেবল আইনি ভাষায় উপস্থাপন করার কাজ বাকি আছে।
অন্যদিকে যেসব প্রস্তাবে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ আছে, আপনি খেয়াল করে দেখবেন, প্রতিটি নোট অব ডিসেন্টের নিচে একটি ‘নোট’ দেওয়া আছে। তাতে বলা হয়েছে, যে দল জনগণের কর্তৃক ম্যান্ডেট পাবে, তাদের প্রস্তাবনাটাই বিবেচিত হবে। তার মানে হচ্ছে— এখানে ভিন্নমত আছে, কিন্তু যে দল জয়লাভ করবে, তাদের মতামতের ভিত্তিতে ওই ভিন্নমতের অংশগুলো বাস্তবায়ন করবে। কোনো দল যদি সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায়, তাহলে সংসদে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তা ঠিক হবে।
ঢাকা পোস্ট : বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের নির্বাচনী সমঝোতা হলে আপনারা সেখানে যাবেন কি না?
জোনায়েদ সাকি : কার সঙ্গে কার নির্বাচনী সমঝোতা হচ্ছে সেটা তো একটি বিবেচনার মধ্যে থাকবেই। তবে, আমরা এখন যে প্রেক্ষাপটে নির্বাচনী সমঝোতার বিবেচনা করছি, সেটা হচ্ছে জাতি পুনর্গঠনের পর্ব। ৫২ বছর পরে এসেও আমাদের রাষ্ট্রকে আবার সাংবিধানিকভাবে, আইনগতভাবে, কাঠামোগতভাবে, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পুনর্গঠন করতে হচ্ছে। এই পুনর্গঠনের কাজটিকে আমরা জাতীয় কর্তব্য হিসেবে সামনে রেখে এগোচ্ছি। যেহেতু এটা এককভাবে কারো পক্ষে করা সম্ভব নয়, তাই আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি ঐকমত্যের দিকে পৌঁছাচ্ছি। সংস্কারগুলোকে সংবিধানে সংযোজন এবং বাস্তবায়ন করা পর্যন্ত একটি জাতীয় ঐকমত্য রক্ষা করা জরুরি।
ঢাকা পোস্ট : আরপিওতে কিছু সংশোধন এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে ‘নিজ দলের প্রতীকে নির্বাচন করতে হবে’। যদিও এ নিয়ে বিএনপির মতভেদ আছে...
জোনায়েদ সাকি : আমরা মনে করি, এটা উন্মুক্ত থাকা উচিত। তবে, অনেক আগে থেকেই আমাদের দলগত সিদ্ধান্ত হচ্ছে— নিজেদের দলীয় প্রতীকেই নির্বাচন করার। আসন সমঝোতা হলেও আমরা আমাদের দলীয় প্রতীকেই নির্বাচন করব।
ঢাকা পোস্ট : বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি— এই তিনটি দলই বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদের অনেকের ওপর অনাস্থা জানিয়েছে। আপনারা কি মনে করেন বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদ দিয়েই নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব?
জোনায়েদ সাকি : এটা করা তাদের কর্তব্য। ছাত্র-জনতার রক্তের প্রতি তাদের দায় আছে। একটি রক্তস্নাত অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সকলের সমর্থনে তারা এখানে এসেছেন। তারা পুরো পর্বটা নিরপেক্ষতার সঙ্গে পালন করবেন— এটাই প্রত্যাশিত। পক্ষপাতিত্ব করার নানা রকমের যে অভিযোগ উঠছে, সেগুলোর কিছু কিছু ভিত্তিও আছে। আমরা মনে করি— এই সবকিছু উপেক্ষা করেই তাদের একটি নিরপেক্ষ ভূমিকার জায়গায় নিতে হবে।
ঢাকা পোস্ট : ছোট দলগুলো জোটে গেলে জনগণের প্রতি তাদের রাজনৈতিক যে প্রতিশ্রুতি, সেটা বাস্তবায়নের সুযোগ কম থাকে। বড় দলগুলোর নির্দেশনায় চলতে হয়। সেই বাস্তবতায় আপনাদের দলের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পারবেন বলে মনে হয়?
জোনায়েদ সাকি : যদি কোনো দল কোয়ালিশন বা আসন সমঝোতার মাধ্যমে সরকার গঠনে যায়, তাহলে সেটাও একটি রাজনৈতিক লক্ষ্যের ওপর দাঁড়িয়ে করে। রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন না করলে তো সেই ঐক্য একই জায়গায় থাকে না।
ঢাকা পোস্ট : বিএনপির সঙ্গে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের সময় ‘জাতীয় সরকার’ গঠনের কথা বলেছিলেন। সেই অবস্থান থেকে সরে এসেছেন কি না?
জোনায়েদ সাকি : জাতীয় সরকার গঠনের বিষয়টি বিএনপি আন্দোলনের সময় থেকে বলে আসছে। এসব বিষয়ে কনক্রিট কোনো আলোচনা না হলেও আমরা জাতীয় সরকারের অবস্থানেই আছি।
ঢাকা পোস্ট : কবে নাগাদ আপনাদের মধ্যে আসন সমঝোতা হতে পারে?
জোনায়েদ সাকি : আলোচনা চলমান। দ্রুততম সময়ের মধ্যে সম্পন্ন হবে বলে মনে করছি। আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে হবে বলে আশা করি।
ঢাকা পোস্ট : বিএনপির কাছে আপনারা কতটি আসন চাইবেন?
জোনায়েদ সাকি : এটা নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। আলোচনার মাধ্যমেই চূড়ান্ত হবে।
ঢাকা পোস্ট : আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ রয়েছে। এখন জাতীয় পার্টিও নিষিদ্ধের দাবি উঠেছে। বিষয়টি কীভাবে দেখেছেন?
জোনায়েদ সাকি : ১৫ বছরের গুম, খুন, লুটপাট, অত্যাচার, পাশাপাশি জুলাই-আগস্টে নির্বিচারে হত্যা চলেছে। এর বিচার যেমন হতে হবে, তেমনি যারা এর পেছনে দায়ী, তাদেরও বিচার করতে হবে। এখানে দল হিসেবেও যাদের দায় আছে, তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। আমি মনে করি, সরকার এ বিষয়ে উদ্যোগ নেবে। আদালত বিষয়টি নির্ধারণ করবে।
ঢাকা পোস্ট : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
জোনায়েদ সাকি : আপনাদেরকেও ধন্যবাদ। ঢাকা পোস্টের জন্য শুভকামনা।
এএইচআর/এমএম