‘প্রাণভয়ে বাংলাদেশে এসেছি। নিরাপদে থাকতেই এ দেশে আসা। বাংলাদেশও আমাদের সাদরে গ্রহণ করে। কিন্তু এখানে আমরা শরণার্থী। বছরের পর বছর শরণার্থী হিসেবেই আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। এখানে আমাদের ভবিষ্যৎ নেই। তাই এখন মিয়ানমারে ফিরতে চাই। নিরাপত্তাহীনতার কারণে আগে আমরা ফিরতে চাইনি। এখন ফিরতে চাই। ক্যারিয়ারটা সেখানে (মিয়ানমার) গড়তে চাই।’

ঢাকা পোস্টের কাছে এভাবেই নিজ দেশে (মিয়ানমার) ফিরে যাওয়ার আকুতি ব্যক্ত করেন রোহিঙ্গা নেতা ও রোহিঙ্গা ইয়ুথ অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা খিন মং (Khin Maung)। ২০১৭ সালে অন্যদের মতো মংও তার পরিবারের সঙ্গে মিয়ানমারের মংডু থেকে বাংলাদেশে আসেন। এখানে আসার আগে মংডুতে আইন বিষয়ে অনার্স পড়ছিলেন। তবে পাস করার আগেই প্রাণ বাঁচাতে চলে আসেন বাংলাদেশে। এখানে এসেও থামাননি পড়াশোনা। অনলাইনে সেই আইন বিষয়ে করেছেন ডিপ্লোমা।

মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসা, সেখানে আবারও ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা; মিয়ানমারে যাওয়ার পরিবেশ আছে কি না— প্রভৃতি বিষয়ে কথা বলেন রোহিঙ্গা ইয়ুথ অ্যাসোসিয়েশনের এ নেতা। এছাড়া জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা- ইউএনএইচসিআর কর্তৃক রোহিঙ্গাদের তথ্য মিয়ানমার সরকারকে দেওয়ার বিষয়েও তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের প্রথমটি থাকছে আজ।

ঢাকা পোস্ট : শরণার্থী জীবনের বাস্তবতা কেমন? মিয়ানমারে আবার ফিরতে চান কি না?
 
খিন মং : প্রাণ বাঁচাতেই বাংলাদেশে এসেছিলাম। চার বছর ধরে এখানে (বাংলাদেশ) শরণার্থী হিসেবে আছি। কারও জন্যই লং টার্ম রিফিউজি লাইফ (দীর্ঘমেয়াদি শরণার্থী জীবন) সুখকর নয়। বর্তমানে বাংলাদেশে আমরা তরুণরা কোনো ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি না। শুধু তরুণরা নয়, রোহিঙ্গাদের ঘরের সন্তান যারা বাংলাদেশে ভূমিষ্ঠ হচ্ছেন, সেসব ছোট ভাই-বোনেরও কোনো ভবিষ্যৎ আমরা দেখতে পাচ্ছি না। এ কারণে যত দ্রুত সম্ভব আমরা আমাদের দেশে (মিয়ানমার) ফিরে যেতে চাই।

২০১৭ সালে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন সাত লাখের অধিক রোহিঙ্গা 

এ দেশে আমরা পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা পাচ্ছি না। দীর্ঘদিন ধরে এখানে থেকে গেলে আমাদের একটি জেনারেশন হারিয়ে যাবে। যত দিন এখানে (বাংলাদেশ) আছি, পড়াশোনার পাশাপাশি সরকার যদি আমাদের কাজের সুযোগ দিত তাহলে ভালো হতো।

ঢাকা পোস্ট : মিয়ানমারে ফিরে যেতে আপনারা কিছু দাবি-দাওয়া উপস্থাপন করেছিলেন।  সেগুলো পূরণ হয়নি। এর মধ্যেও কি আপনারা মিয়ানমারে যেতে চান?

খিন মং : চার বছর আগে (২০১৭ সালে) আমাদের ওপর প্রচুর জুলুম-নির্যাতন হয়েছিল। বেঁচে থাকার জন্য বাংলাদেশে এসেছিলাম। আমরা নিজ দেশে ফিরে যেতে চাই। সেখানে (মিয়ানমার) ফিরে যাওয়ার জন্য আমাদের কিছু দাবি-দাওয়া ছিল। সেগুলো মিয়ানমার এখনও পূরণ করেনি। দাবিগুলো সবসময় আমাদের থাকবে। তবে, সেগুলো পূরণের অপেক্ষা করতে করতে আমাদের ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাই এখন আমরা ভাবছি, যেকোনো ভাবে আগে আমরা নিজ দেশে ফিরতে চাই। আপাতত এটাই আমাদের প্রথম দাবি। দেশে ফিরে আমরা অন্যান্য দাবি-দাওয়া নিয়ে কথা বলব। তবে এটাও ঠিক যে, দেশে ফেরার জন্য সর্বপ্রথম আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

রোহিঙ্গাদের ৫ দাবি-
১. রোহিঙ্গারা আরাকানের স্থানীয় আদিবাসী এবং সেজন্য তাদের ন্যাটিভ স্ট্যাটাস বা স্থানীয় মর্যাদা সংসদে আইন করে পুনর্বহাল করতে হবে। এর আন্তর্জাতিক গ্যারান্টি থাকতে হবে।
২. নাগরিকত্ব : প্রথমত, আরাকান রাজ্যে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের ‘সিটিজেন কার্ড’ দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থীদেরও সিটিজেনশিপ কার্ড দিয়ে প্রত্যাবাসন করে স্থানীয় নাগরিকের মর্যাদা দিতে হবে। তৃতীয়ত, বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় থাকা রোহিঙ্গাদের একইভাবে স্থানীয় নাগরিকের মর্যাদা দিতে হবে।
৩. প্রত্যাবাসন : রোহিঙ্গাদের তাদের নিজস্ব গ্রামে ফিরিয়ে নিতে হবে এবং তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া জমিজমা যথাযথ ক্ষতিপূরণসহ ফেরত দিতে হবে।
৪. নিরাপত্তা : আরাকানে রোহিঙ্গাদের জীবন ও সম্পদ রক্ষার জন্য রোহিঙ্গা পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করতে হবে।
৫. জবাবদিহিতা : মিয়ানমারের স্থানীয় আদালতের পরিবর্তে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বা আইসিসি’র মতো কোনো ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনালে অপরাধীদের বিচার করতে হবে।

ঢাকা পোস্ট : জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা- ইউএনএইচসিআর রোহিঙ্গাদের তথ্য মিয়ানমার সরকারকে দিয়েছে বলে অভিযোগ আছে। এ বিষয়ে আপনার কোনো পর্যবেক্ষণ আছে কি না?
 
খিন মং : হ্যাঁ, এটা ঠিক। ইউএনএইচসিআর একটি ফরমে আমাদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক তথ্য নিয়েছে। তারা এসব তথ্য মিয়ানমার সরকারকে দিয়ে আমাদের নিরাপত্তা হুমকির মুখে ফেলেছে।

পরিচিতি কার্ড গলায় ঝুলিয়ে এক রোহিঙ্গা শিশু

আমরা ভেবেছিলাম, আমাদের প্রত্যাবাসনে ইউএনএইচসিআর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তাই আমরা সরল মনে তাদের (ইউএনএইচসিআর) তথ্য দিয়েছিলাম। কিন্তু তারা আমাদের কনসার্ন ছাড়াই তথ্য মিয়ানমারকে দিয়েছে।

ঢাকা পোস্ট : ইউএনএইচসিআর আপনাদের কাছ থেকে কোন ধরনের তথ্য নিয়েছে? আপনাদের ক্ষোভের কারণ-ই বা কী?

খিন মং : তারা একটি ফরমে আমাদের কাছ থেকে তথ্য নেয়। সেই ফরমে আমাদের (রোহিঙ্গা) নাম, বাংলাদেশে আসার তারিখ, রেজিস্ট্রেশনের তারিখ, জন্ম তারিখ, বয়স, জন্মস্থান (শহর ও দেশ), ধর্ম, লিঙ্গ, বাবা-মায়ের নাম, স্বামী-স্ত্রীর নাম, সন্তানের নাম, তাদের প্রত্যেকের মিয়ানমারের ঠিকানা (জেলা, শহর, এলাকা, গ্রামের নাম, ওয়ার্ড নম্বর)— এসব তথ্য নিয়েছে। এছাড়া রোহিঙ্গাদের পড়াশোনা, তাদের পেশা (বাংলাদেশে বসবাসকালীন), দক্ষতার বর্ণনা, বিশেষ কোনো চাহিদা আছে কি না, শরীরে বা মুখে শনাক্তকরণ চিহ্ন (গালে বা মুখে তিল, স্থায়ী কোনো দাগ বা চিহ্ন), দুই হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলের ছাপ, পোর্ট্রেট ছবি, পারিবারিক ছবি ইত্যাদিও ছিল।

জন্মের পর থেকে আমরা মিয়ানমারে ছিলাম। ইউএনএইচসিআর তাদের যেসব তথ্য দিয়েছে, মিয়ানমারের কাছে এসব কখনও ছিল না।

তারা (ইউএনএইচসিআর) আমাদের তথ্য শেয়ার করে রোহিঙ্গাদের অধিকার ক্ষুণ্ন করেছে। এছাড়া তারা আমাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনেছে। এটা সম্পূর্ণ আপত্তিকর এবং অগ্রহণযোগ্য।

পারিবারিক ছবিসহ একটি রোহিঙ্গা পরিবারের পরিচিতি। আছে মিয়ানমারের সিটিজেন কার্ডও 

তারা আমাদের প্রতিটি পরিবারের গ্রুপ ছবি নিয়েছে। আমাদের মুসলিম বোনদেরও ছবি নিয়েছে। আমাদের মেয়েরা বিয়ের আগে তাদের চেহারা অন্য কাউকে দেখান না। পর্দা মেনে চলেন। তারা ইউএনএইচসিআর’র প্রস্তাবে সেসময় ছবি তুলতে রাজি ছিল না। কথা ছিল ইউএনএইচসিআর এসব ছবি গোপন রাখবে। কিন্তু তারা এগুলো প্রকাশ করে আমাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনেছে। তারা (ইউএনএইচসিআর) গুরুতর অপরাধ করেছে। আমরা তাদের ওপর খুবই বিরক্ত।

ঢাকা পোস্ট : এসব তথ্য নিয়ে মিয়ানমার আপনাদের কোনো ক্ষতি করতে পারে কি না?

খিন মং : মিয়ানমার থেকে আমাদের একটি ফরম দেওয়া হয়েছিল। সেই ফরমে তারা জানতে চেয়েছিল যে, আমরা মিয়ানমার যেতে চাই, কি চাই না? আমরা রোহিঙ্গারা নিরাপত্তার স্বার্থে সেই ফরম পূরণ করিনি। অথচ এখন ইউএনএইচসিআর আমাদের ডাটা (তথ্য) তাদের দিয়ে দিল।

এখন মিয়ানমার এসব তথ্য নানাভাবে মিসইউজ (অপব্যবহার) করতে পারে। ওই ফরমে আমাদের এ টু জেড (সম্পূর্ণ) তথ্য রয়েছে। বাংলাদেশের সরকার আমাদের কাছ থেকে কিছু তথ্য নিয়ে একটি আইডি কার্ড দিয়েছিল। সেই আইডির নম্বরও দেওয়া হয়েছে। মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের সময় এসব তথ্য আগে থেকে জেনে তারা (মিয়ানমার সরকার) আমাদের ক্ষতি করতে পারে।

রোহিঙ্গা ইয়ুথ অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা খিন মং

ইউএনএইচসিআর কী

শরণার্থী ও বলপ্রয়োগে বাস্তুচ্যুত জনগণের সুরক্ষা, উপযুক্ত জীবনমান ও সংকটের কার্যকর সমাধানে কাজ করে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার, সংক্ষেপে ইউএনএইচসিআর। বাংলাদেশে সংস্থাটির কাজ শুরু হয় ১৯৭১ সালে। সে সময় শরণার্থী বাংলাদেশিদের পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগী হয়। গত শতকের সত্তরের দশকে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সুরক্ষা থেকে শুরু করে ২০১৭ সালের আগস্ট মাসের পর প্রায় সাত লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীর সহায়তায় এ সংস্থার কার্যক্রম চলছে বাংলাদেশে।

ঢাকা পোস্ট : ইউএনএইচসিআর’র ফরমে ইংরেজিতে তিনটি প্রশ্ন ছিল। এর মধ্যে দ্বিতীয়টি ছিল, ‘ইউএনএইচসিআর তথ্যগুলো মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে শেয়ার করতে পারবে?’ প্রশ্নের উত্তরে ‘হ্যাঁ’ ও ‘না’ বোধক উত্তর দেওয়ার সুযোগ ছিল। আপনারা কেন ‘হ্যাঁ’ উত্তর দিয়েছেন?

খিন মং : ইউএনএইচসিআর’র তথ্য সংগ্রহকারীরা আমাদের হাতে ফরম দেয়নি। তিনটি ‘হ্যাঁ’ ও ‘না’ সূচক প্রশ্নের ঘর তারা নিজেরাই পূরণ করেছে। অন্যান্য প্রশ্নের উত্তরগুলো তারা আমাদের কাছে জিজ্ঞাসা করেছে। আমরা তাদের উত্তর দিয়েছি। ফরম পূরণ তারা নিজেরাই করেছে।

এআর/জেইউ/এমএআর/