চাকরিজীবীদের দক্ষতা বাড়াতে আন্তর্জাতিকমানের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে ‘বাংলাদেশ জাপান পলিসি ল্যাবে’

জাপানি টেকনোলজি ব্যবহারের মাধ্যমে ‘বাংলাদেশ জাপান পলিসি ল্যাব’ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সরকারি ও বেসরকারি চাকরিজীবীদের জাপানি পলিসি ব্যবহারের মাধ্যমে দক্ষতা উন্নয়নে আন্তর্জাতিকমানের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে এ ল্যাবে। ফলে উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য আর দেশের বাইরে যেতে হবে না। দেশেই প্রশিক্ষণ নিয়ে আন্তর্জাতিকমানের বড় বড় ডিগ্রি অর্জন করা সম্ভব হবে।

পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, ‘বাংলাদেশ জাপান পলিসি ল্যাব’ শীর্ষক প্রকল্পটি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাবনা আকারে পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পটির মাধ্যমে ৭২ হাজার বর্গফুটের আটতলা একটি ভবন নির্মাণ হবে। পাশাপাশি থাকবে এক হাজার ৮০০ ফুটের একটি রাস্তা। আগামী দুই বছরের মধ্যে এটি বাস্তবায়নের কথা বলছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। 

প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২২৭ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) অনুদান থেকে ১৯৩ কোটি ৩২ লাখ টাকা, সরকারি কোষাগার থেকে ৩৩ কোটি ৪৪ লাখ টাকা এবং বাস্তবায়নকারী সংস্থা থেকে এক কোটি ২০ লাখ টাকা ব্যয় হবে। অনুমোদনের পর প্রকল্পটি চলতি বছরের (২০২১) এপ্রিল থেকে ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়ন করবে গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট’- বিআইজিএম।

প্রকল্পটির মাধ্যমে ৭২ হাজার বর্গফুটের আটতলা একটি ভবন নির্মাণ হবে। পাশাপাশি থাকবে এক হাজার ৮০০ ফুটের একটি রাস্তা। আগামী দুই বছরের মধ্যে এটি বাস্তবায়নের কথা বলছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। তবে দুই বছর মেয়াদি ল্যাব স্থাপন ও ভবন নির্মাণের এ প্রকল্পে ‘পরামর্শক’ খাতে ২৩ কোটি ৬২ লাখ টাকার আবদার করা হয়েছে! বিষয়টির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কাছে এ বিষয়ে ব্যাখ্যাও চাওয়া হয়েছে

তবে দুই বছর মেয়াদি ল্যাব স্থাপন ও ভবন নির্মাণের এ প্রকল্পে ‘পরামর্শক’ খাতে ২৩ কোটি ৬২ লাখ টাকার আবদার করা হয়েছে! বিষয়টির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কাছে এ বিষয়ে ব্যাখ্যাও চাওয়া হয়েছে।
 
পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগ প্রকল্পটির ওপর গত ৬ জুলাই মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সদস্যদের নিয়ে একটি ভার্চ্যুয়াল সভা করেছে। 

জানা গেছে, ওই সভায় এই প্রকল্পের বিভিন্ন খাতের ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। ভৌত অবকাঠামো বিভাগের যুগ্মপ্রধান মো. উবায়দুল হক স্বাক্ষরিত পিইসি সভার কার্যপত্রে বলা হয়েছে- জাইকার অনুদান সহায়তা থেকে ডিপিএ (বিশেষ হিসাবের মাধ্যমে) হিসেবে যে পরামর্শসেবা দেওয়া হবে তার কর্মপরিধি, কাজের বিবরণ, কর্মপরিকল্পনা, দায়বদ্ধতা, মাসিক সম্মানী হার এবং পরামর্শক খাতে ২৩ কোটি ৬২ লাখ টাকার যৌক্তিকতার বিষয়ে জানাতে হবে। জিওবি (বাংলাদেশ সরকার) থেকে  ‘জাপানিজ গার্ডেন’ নির্মাণে তিন কোটি টাকা ব্যয়ের প্রাক্কলনের যৌক্তিকতা এবং বাগানে জনসাধারণের প্রবেশাধিকার থাকবে কি না—এসব বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে ডিপিপিতে যুক্ত করতে হবে। এর বাইরে অভ্যন্তরীণ রাস্তা বাবদ দুই কোটি টাকা এবং দুই বছরের প্রকল্পে জিওবি খাতে ফুয়েল ও লুব্রিকেন্ট বাবদ ১৪ লাখ এবং সম্মানী বাবদ ১৫ লাখ টাকার বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে হবে।

ল্যাব স্থাপন প্রকল্পটিতে ‘পরামর্শক’ খাতে ২৩ কোটি ৬২ লাখ টাকার আবদার করা হয়েছে
প্রকল্পটিতে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) অনুদান থেকে ১৯৩ কোটি ৩২ লাখ টাকা, সরকারি কোষাগার থেকে ৩৩ কোটি ৪৪ লাখ টাকা এবং বাস্তবায়নকারী সংস্থা থেকে এক কোটি ২০ লাখ টাকা ব্যয় হবে। অনুমোদনের পর প্রকল্পটি চলতি বছরের (২০২১) এপ্রিল থেকে ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়ন করবে গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট’- বিআইজিএম

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, জাইকা বাংলাদেশে সুশাসন ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ক গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের উন্নয়ন শীর্ষক একটি প্রকল্প গ্রহণের অনুরোধ জানায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি উচ্চপর্যায়ের আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি বিআইজিএমকে ‘বাংলাদেশ জাপান পলিসি ল্যাব’ স্থাপনের জন্য উপযুক্ত স্থান হিসেবে নির্বাচিত করে।

বিআইজিএম গত ১৪ বছর ধরে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিশেষায়িত উচ্চতর মাস্টার্স শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। বর্তমানে মাস্টার্সে ১৩ ও ১৪তম ব্যাচের শিক্ষাকার্যক্রম চলমান। বিআইজিএমের ডিগ্রির নাম ‘মাস্টার্স অব পাবলিক অ্যাফেয়ার্স’, যা দেশে ও আন্তর্জাতিক মহলে সমাদৃত।

কর্মকর্তারা আরও জানান, কর্মক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের দক্ষতা নিশ্চিত করতে ‘নীতি-বিশ্লেষণ বিষয়ক’ বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ আধুনিক গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অত্যাধুনিক ‘কম্পিউটার সফটওয়্যারভিত্তিক’ প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। পাশাপাশি সঠিকভাবে দেশের উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনায় গবেষণার কোনো বিকল্প নেই। এসব বিষয়ে প্রাধান্য দিয়ে অর্থনীতি, সুশাসন, বাণিজ্য, উন্নয়ন, পরিবেশ, ব্যবস্থাপনাসহ আরও অনেক বিষয়ের ওপর গত তিন বছরে বিআইজিএম থেকে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে এবং গবেষণালব্ধ ফলাফল বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগে প্রয়োগ করা হয়েছে। বিআইজিএমের ভিশন অনুযায়ী, আগামীতে কাজের পরিধি আরও বৃদ্ধি পাবে। তাই এখানে বিশ্বমানের প্রশিক্ষণ নিশ্চিতে প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়েছে।

পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) মামুন-আল-রশিদ এ বিষয়ে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘জাইকার সহায়তায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে। এখানে যে ভবনটি নির্মাণ হবে, সেটিতে অনেক কিছুর রিফ্লেকশন (প্রতিফলন) থাকবে। ভবনের সামনে একটি গার্ডেন হবে। এটি সম্পূর্ণ জাপানের আদলে সাজানো হবে। প্রকল্পের ডিজাইন থেকে শুরু করে সবকিছু বিশেষ ধরনের হবে। তারপরও আমরা পিইসি সভায় বিভিন্ন খাতের ব্যয়গুলো যুক্তিযুক্তভাবে নির্ধারণের জন্য বলেছি।

প্রকল্পে পরামর্শক খাতে প্রায় ২৪ কোটি টাকার আবদার কতটুকু যৌক্তিক— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছেও পরামর্শকের ব্যয়টা বেশি মনে হয়েছে। এটা নিয়ে পিইসি সভায় আলোচনা হয়েছে। যেহেতু জাইকা এ প্রকল্পের পুরো টাকাই অনুদান হিসেবে দিচ্ছে, সেহেতু পরামর্শক ব্যয়সহ বেশকিছু খাতের বরাদ্দ নিয়ে তাদের লিবার্টি  (সুবিধা) দিতে হচ্ছে। কারণ জাইকা তাদের টাকায় আমাদের এটি করে দেবে। এরপরও আমি ব্যয়গুলো যতটুকু সম্ভব যুক্তিযুক্তভাবে নির্ধারণের জন্য বলেছি।’

পরামর্শক খাতে ২৩ কোটি ৬২ লাখ টাকা ব্যয়ের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন

শুধু গার্ডেন (বাগান) নির্মাণে পরামর্শকের জন্য ১৫ লাখ টাকা চাওয়া হয়েছে— এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এ গার্ডেনে জাপানের কালচার (সংস্কৃতি) অর্থাৎ বিশেষ ধরনের চিত্র ফুটে উঠবে। সে কারণে ব্যয়টা যুক্তিসঙ্গত মনে হয়েছে। তারপরও আমরা পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে অনুরোধ করেছি ব্যয়গুলো কমিয়ে আনার জন্য।’

প্রকল্পটি নিয়ে নিজের ব্যক্তিগত অভিমতের কথাও ঢাকা পোস্টের কাছে ব্যক্ত করেন মামুন-আল-রশিদ। বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে এটি (প্রকল্পটি) আমাদের প্রফেশনালদের (পেশাদার) প্রশিক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। এ ল্যাবে যেসব কোর্স করানো হবে সেগুলো পাবলিক-প্রাইভেট, উভয় সেক্টরের লোকজন উপকৃত হবেন। এটি প্রকল্পের একটি বিশেষ দিক। আসলে, সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া দেশকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। প্রকল্পটির মাধ্যমে এ সুযোগ তৈরি হবে।’

এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘যেকোনো সংস্থার অর্থায়নের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট শর্ত থাকে। হোক সেটা অনুদান বা ঋণ। এখানে শর্তের মধ্যে অর্থের ব্যবহারটা ঠিক মতো হচ্ছে কি না— এটাই মূল বিষয়। কেউ চাইলে অনুদানের টাকা যা খুশি করতে পারবে না বা এটা কোনো যুক্তিও হতে পারে না। উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার হোক বা সরকারের টাকা হোক, যথাযথ নিয়ম মেনে অর্থের ব্যবহার করতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এ প্রকল্পে যেসব পরামর্শককে নিয়োগ দেওয়া হবে তারা মূলত কী করবে, কোন ধরনের মূল্য সংযোজন করবে এবং সেটির জন্য এত টাকা ব্যয় যুক্তিযুক্ত কি না, বিনিয়োগের অর্থ অনুদান না ঋণ তার ওপর নির্ভর করা উচিত নয়। এমন হলে একটি প্রিসিডেন্ট (নজির) তৈরি হয়ে যাবে। ভবিষ্যতেও এমন প্রকল্পের আরও প্রস্তাব আসবে। তখন কিন্তু যে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারে যে, এমন একটি ল্যাব নির্মাণে এত কোটি টাকা পরামর্শককে দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে এটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।’

প্রকল্পে যা থাকছে

আটতলা বিশিষ্ট ভবন নির্মাণ, এক হাজার ৮০০ ফুটের রাস্তা নির্মাণ, সিভিল ও ইলেকট্রিক্যাল কাজ, নোটিশ বোর্ড, জাপানি বাগান নির্মাণ, লিফট ও দুই তলাবিশিষ্ট যান্ত্রিক গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থা, আসবাবপত্র (শ্রেণিকক্ষ, লাইব্রেরি, সেমিনার হল, অডিটোরিয়াম, ল্যাব ও লাউঞ্জ), অফিস সরঞ্জাম (শ্রেণি, লাইব্রেরি, সেমিনার হল, অডিটোরিয়াম, ল্যাব ও লাউঞ্জের সব আধুনিক যন্ত্রপাতি), আসবাবপত্র (প্রকল্প অফিস), অফিস সরঞ্জাম (প্রকল্প অফিস), গাড়ি ক্রয় (প্রকল্প পরিচালক), কেবিন পিকআপ ক্রয়, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ স্থাপন, প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র (অফিস), যান্ত্রিক কাজ (এসি), বিদ্যুতায়ন (জেনারেটর, সাব-স্টেশন ও সৌরবিদ্যুৎ ব্যবস্থাসহ অন্যান্য বৈদ্যুতিক কাজ), পানি সরবরাহ ও স্যানিটারি ব্যবস্থা, অগ্নিনির্বাপণসহ অন্যান্য কাজ।

এসআর/এমএআর/