করোনার কারণে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে

দেশে বর্তমানে প্রায় এক হাজার ৭০০টি উন্নয়ন প্রকল্প চলমান। অর্থ বরাদ্দের পাশাপাশি প্রকল্পগুলোর কাজও এগিয়ে যাচ্ছে সমানতালে। বিশ্বব্যাপী করোনার থাবায় দেশে দেশে উন্নয়ন কার্যক্রম থমকে গেলেও বাংলাদেশ সরকার পিছু হটেনি। করোনায় সাময়িক বন্ধ থাকলেও পরবর্তীতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বেশির ভাগ প্রকল্পের কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। তবে, যেসব প্রকল্পে বিদেশি ঠিকাদার ও জনবল কাজ করছেন সেসব প্রকল্প বাস্তবায়নে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, দেশে বর্তমানে পদ্মা সেতুসহ আটটি মেগা প্রকল্প চলমান। এগুলো বাস্তবায়ন হলে দেশের অর্থনৈতিক দৃশ্যপট পুরোপুরি বদলে যাবে। এজন্য প্রকল্পগুলোর গুরুত্ব বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সরাসরি এগুলো দেখভাল করছে। চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ নিয়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে প্রকল্পগুলো।

তারা বলছেন, গত বছর ভয়াল করোনাভাইরাসের আবহ এসব প্রকল্পের কাজ অনেকটা পিছিয়ে দিয়েছে। মেগা প্রকল্পগুলোতে বিদেশি কোম্পানিগুলো কাজ করছে। তাদের অনেক কর্মী ও প্রকৌশলী বিদেশি। করোনার কারণে ভ্রমণে বিধিনিষেধ থাকায় তাদের আসা-যাওয়া ব্যাহত হচ্ছে। ফলে পূর্বনির্ধারিত সময়ে প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ করা সম্ভব হচ্ছে না। ইতোমধ্যে কয়েকটি প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।

পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামো ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। চলতি বছর প্রকল্পটি উদ্বোধনের কথা থাকলেও করোনা মহামারির হানায় তা শেষ করা সম্ভব হয়নি। ব্যয় বৃদ্ধি না করে প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। তবে, মেয়াদ দুই বছর বাড়ানো হলেও আগামী বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের মার্চে গাড়ি চলাচলের জন্য সেতুটি খুলে দেওয়া হবে

সরকারের চলমান মেগা প্রকল্পগুলো হচ্ছে- পদ্মা সেতু, পদ্মা রেলসেতু, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, ঘুমধুম রেল প্রকল্প, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর, মাতারবাড়ি ও রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প।

গাড়ি চলাচলের জন্য ২০২২ সালের মার্চ খুলে দেওয়া হবে সেতুটি

সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামো ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। চলতি বছর প্রকল্পটি উদ্বোধনের কথা থাকলেও করোনা মহামারির হানায় তা শেষ করা সম্ভব হয়নি। ব্যয় বৃদ্ধি না করে প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। তবে, মেয়াদ দুই বছর বাড়ানো হলেও আগামী বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের মার্চে গাড়ি চলাচলের জন্য সেতুটি খুলে দেওয়া হবে।

গত বছর ভয়াল করোনাভাইরাসের আবহ এসব প্রকল্পের কাজ অনেকটা পিছিয়ে দিয়েছে। মেগা প্রকল্পগুলোতে বিদেশি কোম্পানিগুলো কাজ করছে। তাদের অনেক কর্মী ও প্রকৌশলী বিদেশি। করোনার কারণে ভ্রমণে বিধিনিষেধ থাকায় তাদের আসা-যাওয়া ব্যাহত হচ্ছে। ফলে পূর্বনির্ধারিত সময়ে প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ করা সম্ভব হচ্ছে না। ইতোমধ্যে কয়েকটি প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে

সেতু বিভাগ জানায়, পদ্মা সেতু চালু হলে দেশের সড়ক যোগাযোগ খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। খুলনা ও বরিশাল বিভাগসহ দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে রাজধানী ঢাকার সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপন হবে। সেতুটি ঘিরে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও ব্যবসা-বাণিজ্য বিস্তৃত হচ্ছে, বাড়ছে বিনিয়োগ। এসব জেলায় নতুন নতুন শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে। সেখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। এছাড়া কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য সরাসরি ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানে সহজে পাঠানো যাবে। সার্বিকভাবে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে আমূল পরিবর্তন আসবে। বিশেষ করে মংলা ও পায়রা বন্দরের ব্যবহার বাড়বে। ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর চাপ কমবে। সবমিলিয়ে পদ্মা সেতু দিয়ে গাড়ি চলাচল শুরু হলে দেশ অনন্য উচ্চতায় উন্নীত হবে।

এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনার ফলে দেশের উন্নয়ন ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এরপরও আমরা বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিঠি দিয়ে, ফোন করে প্রকল্পের গতি বাড়াতে বলেছি। করোনার বিনাশ হলে প্রয়োজনে বিভিন্ন শিফটে ২৪ ঘণ্টা ডিউটির ব্যবস্থা করে বড় বড় প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ করব। করোনায় মূলত মেট্রোরেল, পদ্মা বহুমুখী সেতু, রূপপুরসহ বিদেশি নাগরিক সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

পদ্মা সেতু প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ও চ্যালেঞ্জিং প্রকল্প হচ্ছে পদ্মা বহুমুখী সেতু। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ঢাকার সঙ্গে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ আরও সহজ হবে। দক্ষিণাঞ্চলে উন্নয়নের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আরও সচল হবে। দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়বে এক দশমিক ২৬ শতাংশ। 

‘প্রকল্পটি খুবই চ্যালেঞ্জিং ছিল। বর্তমানে এটি বাস্তবায়নের চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। উন্নয়ন সহযোগীদের আমরা দেখিয়ে দিয়েছি যে, বাংলাদেশও নিজেদের অর্থে বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্ষম। আমি আশা করি, বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান এবার যে সময় পেয়েছে তাতে তারা কাজ শেষ করতে পারবে’— বলেন পরিকল্পনামন্ত্রী।

পদ্মা সেতুর সড়কপথের নিচে হবে রেলপথ। দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে রেলপথ নির্মাণের কাজ

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনায় ভালো প্রভাব পড়েছে উন্নয়ন প্রকল্পে। প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। যদি করোনা না থাকত তাহলে এডিপি’র বাস্তবায়ন আরও বাড়ত। তারপরও একনেক/এনইসি’র (জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ) অনুশাসন ও সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতার মাধ্যমে এডিপি’র বাস্তবায়ন হার সন্তোষজনক।

পদ্মা সেতু প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যেকোনো প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর আগে নিয়ম অনুযায়ী আইএমইডি থেকে পরিদর্শন করে রিপোর্ট দিতে হয়। এ রিপোর্টের জন্য আমি নিজে প্রকল্প পরিদর্শন করেছি। আমাকে প্রকল্প পরিচালক এবং প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন যে, প্রকল্প এলাকায় এখন প্রায় চার হাজার দেশি-বিদেশি জনবল নিয়োজিত। কোভিডের কারণে বিদেশি কর্মকর্তাদের উপস্থিতি ও পরামর্শক সেবা ব্যাহত হওয়ায় কিছু সময়ের জন্য প্রকল্পের অগ্রগতি আশানুরূপ হয়নি। বর্তমানে এর গতি ফের ত্বরান্বিত হয়েছে।

পদ্মা সেতু প্রসঙ্গে আইএমইডি সুপারিশে যা বলা হয়েছে

প্রকল্পে মূল সেতু ও নদীশাসন কাজসহ অবশিষ্ট কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্নের লক্ষ্যে ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত এক বছর এবং দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী রক্ষণাবেক্ষণ কাজ ও ঠিকাদারদের দেনা-পাওনা মিটিয়ে দেওয়ার জন্য আরও এক বছরসহ কিছু সুপারিশ/মতামত প্রতিপালন-সাপেক্ষে প্রকল্পটির ব্যয় বৃদ্ধি ব্যতিরেকে মেয়াদ (তৃতীয়বার) ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত নির্ধারণ করা যেতে পারে।

পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামো দাঁড়াচ্ছে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার

বিভিন্ন অঙ্গভিত্তিক কাজ নির্ধারিত মেয়াদে সমাপ্তের লক্ষ্যে সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন এবং নিয়মিত ফলোআপ সভা করে বাস্তবায়ন অগ্রগতির মূল্যায়ন প্রয়োজন। পুনর্বাসন কার্যক্রমের আওতায় গৃহীত আয়বর্ধকমূলক কর্মসূচির যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিতসহ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ যাতে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হতে পারে, সেই লক্ষ্যে ‘জব প্লেসমেন্টের’ বিষয়ে গুরুত্ব প্রদান করা যেতে পারে। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট এলাকায় ডিপিপি’র সংস্থান অনুযায়ী জীববৈচিত্র্য এবং পরিবেশ ও প্রতিবেশগত উৎকর্ষতার ওপর অগ্রাধিকারপূর্বক কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন নিশ্চিতের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ও অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনার ফলে দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বাধা কাটিয়ে ওঠার আগেই একের পর এক করোনার ঢেউ আসছে। ফলে পুরোদমে প্রকল্পের কাজ করা যাচ্ছে না। যেসব প্রকল্পে বিদেশিরা কাজ করেন, সেসব প্রকল্পে তারা ফিরে না এলে কাজে গতি আসবে না। ফলে উন্নয়ন পিছিয়ে পড়ার পাশাপাশি এডিপি’র বাস্তবায়ন কমবে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, উন্নয়ন টেকসই করতে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এখনও সরকারি বা বেসরকারি খাতে ব্যাপক দুর্নীতি হয়। সরকারি বিভিন্ন খাতে দুর্নীতি হলেও প্রাপ্য সার্ভিস নিশ্চিত করতে হবে। এটি নিশ্চিত করতে পারলে দুর্নীতি থাকা সত্ত্বেও দেশ এগিয়ে যাবে।

এসআর/এমএআর