এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রাসেল শাহরিয়ারের একক স্বাক্ষরে ৭০০ কোটি টাকা ঋণের প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়। যার বিপরীতে ছিল না কোনো মর্টগেজ (ঋণের জন্য স্থাবর সম্পত্তি গচ্ছিত রাখা)। লোক দেখানো বোর্ড মিটিংয়ে তা পাস করিয়ে অর্থছাড়ও করা হয়।

যদিও এর পেছনের কারিগর আলোচিত প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদার। সিন্ডিকেটের অন্যতম অংশীদার ছিলেন রাসেল শাহরিয়ার, গ্রেফতার হওয়া উজ্জ্বল কুমার নন্দী, এফএএস ফাইন্যান্সের সাবেক চেয়ারম্যান সিদ্দিকুর রহমান ও ভাইস চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর আলম প্রমুখ।

দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) গত তিনদিনের জিজ্ঞাসাবাদে মেলে এমন স্বীকারোক্তি। এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের ১৩০০ কোটি টাকা আত্মসাতের রহস্য উদঘাটনে তিনদিনে ওই প্রতিষ্ঠানের সাবেক চেয়ারম্যান, পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ ২২ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক।

যদিও এর পেছনের কারিগর আলোচিত প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদার। সিন্ডিকেটের অন্যতম অংশীদার ছিলেন রাসেল শাহরিয়ার, গ্রেফতার হওয়া উজ্জ্বল কুমার নন্দী, এফএএস ফাইন্যান্সের সাবেক চেয়ারম্যান সিদ্দিকুর রহমান ও ভাইস চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর আলম প্রমুখ

এ বিষয়ে দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানসহ পরিচালকরা ঋণ অনুমোদনে তাদের অনিয়মের কথা স্বীকার করেন। এজন্য তারা দুঃখ প্রকাশ করেন। ঋণের টাকা পুনরুদ্ধারের জন্য তারা একটু সময়ও প্রার্থনা করেন।

এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড

অন্যদিকে, দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে এমডি রাসেল শাহরিয়ার প্রথম দিকে দোষ স্বীকার না করলেও শেষে এসে স্বীকার করেন এবং ক্ষমা চান। ভুল শোধরাতে এবং ঋণের অর্থ আদায়ে কিছুদিন সময় প্রার্থনা করেন।

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, এফএএস ফাইন্যান্সের কর্মকর্তারা জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেন যে, পি কে হালদার প্রায় সময়ই এমডি রাসেল শাহরিয়ারের রুমে আসতেন এবং বোর্ড মিটিংয়েও উপস্থিত থাকতেন। যদিও পি কে হালদার প্রতিষ্ঠানের কেউ ছিলেন না। ঋণ নেওয়া প্রকৃত মালিকরা বর্তমানে পলাতক রয়েছেন।

দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে এমডি রাসেল শাহরিয়ার প্রথম দিকে দোষ স্বীকার না করলেও শেষে এসে স্বীকার করেন এবং ক্ষমা চান। ভুল শোধরাতে এবং ঋণের অর্থ আদায়ে কিছুদিন সময় প্রার্থনা করেন

এ বিষয়ে অনুসন্ধান কর্মকর্তা ও দুদকের উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত তিনদিনে মোট ২২ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এ পর্যায়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের কাজ অব্যাহত আছে। এর বাইরে তথ্য জানতে জনসংযোগ দফতরে যোগাযোগ করুন।

বিষয়টি নিয়ে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হয় দুদক সচিব মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদারের। তিনি বলেন, এখানে ঋণের নামে অর্থের লোপাট হয়েছে। যে কারণে সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদ করছেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা। জিজ্ঞাসাবাদে অর্থ আত্মসাতের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলেছে

প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদার

দুদক সূত্রে আরও জানা যায়, ২০১৪ সালের শেষের দিকে পি কে হালদার সিন্ডিকেট এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের শেয়ার ক্রয় করে প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নেয়। কৌশলে পুরাতন কর্মচারীদের ছাঁটাই করে তাদের পছন্দের লোক নিয়োগ দেওয়া হয়। রাসেল শাহরিয়ার এমডি হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি (রাসেল শাহরিয়ার) হলেন পি কে হালদারের পূর্বপরিচিত। ২০০৭ সালে তারা একই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন।

অন্যদিকে, উজ্জ্বল কুমার নন্দী পরিচালনা পর্ষদে তার পছন্দের পরিচালক নিয়োগ দেন। সিদ্দিকুর রহমান ও জাহাঙ্গীর আলম হলেন পি কে হালদারের বন্ধু ও ব্যবসায়িক পার্টনার। সেই সুবাদে এফএএস ফাইন্যান্সের দায়িত্ব পড়ে সিদ্দিক ও জাহাঙ্গীরের হাতে। অস্তিত্বহীন কোন কোন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিতে হবে সেই সিদ্ধান্ত পি কে হালদার আগেই দিয়ে দিতেন। লোক দেখানো বোর্ড মিটিং হতো এবং এমডিকে ডেকে বলে দেওয়া হতো এসব বোর্ডের ফাইল এবং দ্রুত ঋণের ব্যবস্থা করো। এমন নির্দেশনা পেয়ে রাসেল শাহরিয়ার অস্তিত্ব যাচাই ছাড়াই এবং কোনো মর্টগেজ না নিয়ে তার একক স্বাক্ষরে ক্রেডিট মেমো প্রস্তুত করে বোর্ডে উপস্থাপন করতেন এবং ঋণ অনুমোদন করে নিতেন। পরবর্তীতে ঋণের অর্থ পি কে হালদারের সিন্ডিকেটের হিসাবে পাঠিয়ে দেওয়া হতো।

ঋণের বিপরীতে কোনো প্রকার মর্টগেজ না থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংকের বিএফআইইউ’র প্রতিবেদনেও অর্থ ফেরতের ঝুঁকির বিষয়টি উঠে আসে।

গত ৮ আগস্ট এফএএস ফাইন্যান্সের শীর্ষ ২৬ কর্মকর্তা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের চারজনসহ মোট ৩০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করে দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠানটি। তাদের মধ্যে এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের সাবেক চেয়ারম্যান, এমডি ও ডিএমডিসহ ২২ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।

দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান কার্যালয়

অভিযোগ রয়েছে, প্রায় ২০টি কাগুজে ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানকে ১৩০০ কোটি টাকা ঋণ পাইয়ে দিতে সহযোগিতা করা হয়েছে। কাগুজে প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- এসএ এন্টারপ্রাইজ, মুন ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, সুখাদা প্রোপার্টিজ লিমিটেড, ন্যাচার এন্টারপ্রাইজ, আরবি এন্টারপ্রাইজ, দিয়া শিপিং লিমিটেড, নিউটেক এন্টারপ্রাইজ, নিউট্রিক্যাল লিমিটেড, মেসার্স বর্ণ, কণিকা এন্টারপ্রাইজ, দ্রিনান অ্যাপারেলস, অ্যান্ড বি এন্টারপ্রাইজ, এমার এন্টারপ্রাইজ, জি অ্যান্ড জি এন্টারপ্রাইজ, তামিম অ্যান্ড তালহা, হাল ইন্টারন্যাশনাল, মেরিন ট্রাস্ট লিমিটেড, আর্থস্কোপ ও এম টি বি মেরিন।

ক্যাসিনো অভিযানের ধারাবাহিকতায় প্রায় ২৭৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে আলোচিত পি কে হালদারের বিরুদ্ধে প্রথম মামলা করে দুদক। এর কিছুদিন পর আর্থিক কেলেঙ্কারিতে ১৫টি মামলা করে দুদক। যার মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা ভুয়া নামে ঋণ উত্তোলন করে আত্মসাতের অভিযোগে ৩৭ জনের বিরুদ্ধে ১০টি মামলা এবং ৩৫০ কোটি ৯৯ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ৩৩ শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পৃথক পাঁচটি মামলা করে দুদক।

আরএম/এমএআর/