ইলেকট্রনিক সিগারেট বা ই-সিগারেট বর্তমানে বহুল পরিচিত একটি নাম। বিশেষ করে দেশের উঠতি বয়সীদের কাছে এর জনপ্রিয়তা বেশ। ব্যাটারিচালিত ভ্যাপিং সিস্টেম এটি। নানা স্বাদের লিকুইড দিয়ে চলে ই-সিগারেট সেবন। মূলত স্বাদ আর স্টাইলের কারণে বাড়ছে এর ব্যবহার।

এছাড়া ই-সিগারেট থেকে নির্গত ধোঁয়ার মাধ্যমে রিং তৈরির কৌশল এবং তা প্রদর্শনও এর জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ। আবার এটি প্রচলিত সিগারেটের তুলনায় স্বাস্থ্যের জন্য কম ক্ষতিকর— এমন ধারণাও আছে অনেকের মধ্যে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন,  যেকোনো রাসায়নিক পদার্থের আসক্তি স্বাস্থ্যের জন্য চরম ঝুঁকিপূর্ণ।

তারা বলছেন, প্রযুক্তির আধুনিকতার ছোঁয়া সব জায়গায় লাগতে শুরু করেছে। তবে সব আধুনিকতা আমাদের জন্য আশীর্বাদ বয়ে আনে না। এর কিছু কিছু আমাদের তরুণ ও যুব সমাজকে ধ্বংসের পথেও নিয়ে যায়। তেমনই একটি ক্ষতিকর জিনিস হচ্ছে ই-সিগারেট।

ই-সিগারেট থেকে নির্গত ধোঁয়ার মাধ্যমে রিং তৈরির কৌশল এবং তা প্রদর্শনও এর জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ। আবার এটি প্রচলিত সিগারেটের তুলনায় স্বাস্থ্যের জন্য কম ক্ষতিকর— এমন ধারণাও আছে অনেকের মধ্যে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন,  যেকোনো রাসায়নিক পদার্থের আসক্তি স্বাস্থ্যের জন্য চরম ঝুঁকিপূর্ণ

গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে, বাংলাদেশ ২০১৭ অনুসারে, ৬.৪ শতাংশ প্রাপ্ত বয়স্কই ই-সিগারেটের বিষয়ে অবগত, ০.৪ শতাংশ কখনও ব্যবহার করেছেন এবং ০.২ শতাংশ ব্যবহার করেছেন। ই-সিগারেট ব্যবহারকারীরা সরাসরি নিকোটিনের সংস্পর্শে আসেন এবং এটি কিশোর মস্তিষ্ক বিকাশে বাধাগ্রস্ত করে। গর্ভাবস্থায় ভ্রূণের বিকাশে এটি নেতিবাচক ভূমিকা রাখে। গবেষণায় বলা হয়েছে, ই-সিগারেটে অ্যাসিটালডিহাইড (সম্ভাব্য কার্সিনোজেন), ফর্মালডিহাইড (পরিচিত কার্সিনোজেন), অ্যাক্রোলিন (টক্সিন) এবং নিকেল, ক্রোমিয়াম ও সিসার মতো ধাতুসহ কমপক্ষে ৮০টি ক্ষতিকারক উপাদান রয়েছে।

ওপেন সিস্টেম (রিফিল ট্যাংকযুক্ত) ও ক্লোজ সিস্টেম (ডিসপোজেবল কার্টিজযুক্ত)— এ দুই ধরনের হয়ে থাকে ই-সিগারেট / ফাইল ছবি

২০০৫ সালের ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন এবং ২০১৩ সালের সংশোধিত আইনে ই-সিগারেট নিয়ন্ত্রণে কিছুই উল্লেখ করা হয়নি। ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ ৫০টিরও বেশি দেশে ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমাদের দেশে আইনি কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকায় তরুণদের মধ্যে এর ব্যবহার ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

ই-সিগারেট ব্যবহারকারীরা সরাসরি নিকোটিনের সংস্পর্শে আসেন এবং এটি কিশোর মস্তিষ্ক বিকাশে বাধাগ্রস্ত করে। গর্ভাবস্থায় ভ্রূণের বিকাশে এটি নেতিবাচক ভূমিকা রাখে। গবেষণায় দেখা গেছে, ই-সিগারেটে অ্যাসিটালডিহাইড (সম্ভাব্য কার্সিনোজেন), ফর্মালডিহাইড (পরিচিত কার্সিনোজেন), অ্যাক্রোলিন (টক্সিন) এবং নিকেল, ক্রোমিয়াম ও সিসার মতো ধাতুসহ কমপক্ষে ৮০টি ক্ষতিকারক উপাদান রয়েছে

সম্প্রতি ‘ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস’- এর কারিগরি সহায়তায় ঢাকা শহরের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর একটি গবেষণা পরিচালনা করে ঢাকা আহছানিয়া মিশন। ওই গবেষণায় দেখা যায়, সাধারণত ই-সিগারেট ওপেন সিস্টেম (রিফিল ট্যাংকযুক্ত) এবং ক্লোজ সিস্টেম (ডিসপোজেবল কার্টিজযুক্ত)— এ দুই ধরনের হয়ে থাকে। ই- লিকুইড ফ্লেভারের ভিন্নতা এবং ধোঁয়া নিয়ে বেশি কারুকাজ করার সুযোগ থাকে বিধায় বেশির ভাগ ব্যবহারকারী শিক্ষার্থী ওপেন সিস্টেম (রিফিল ট্যাংকযুক্ত) পছন্দ করেন।

গবেষণায় আরও দেখা গেছে, প্রথমে ই-সিগারেট সেবনের সময় বেশির ভাগ অংশগ্রহণকারী নিশ্চিত ছিলেন না যে এতে নিকোটিন আছে কি না। অংশগ্রহণকারীরা ই-সিগারেটের সম্ভাব্য স্বাস্থ্যের ক্ষতি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না। তাদের অধিকাংশই বিশ্বাস করতেন ই-সিগারেট সম্পর্কে পর্যাপ্ত বৈজ্ঞানিক গবেষণা ছিল না যে এটি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। অংশগ্রহণকারীদের নিকোটিন সম্পর্কে মিশ্র জ্ঞান ছিল। তারা ই-সিগারেট ও প্রচলিত সিগারেটের মধ্যে নিকোটিনের পার্থক্য সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন না। তাদের কেউ কেউ আবার মনে করতেন যে ই-সিগারেটে প্রচলিত সিগারেটের তুলনায় নিকোটিন কম থাকে।

স্বাদ আর স্টাইলের কারণে তরুণদের মধ্যে বাড়ছে ই-সিগারেটের ব্যবহার, বলছেন বিশেষজ্ঞরা / ফাইল ছবি

কীভাবে ই-সিগারেটের সংস্পর্শে আসা— এ বিষয়ে শিক্ষার্থীরা জানান, তারা প্রথমে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম, বড় ভাই-বোন, বন্ধু, পরিবারের অন্যান্য সদস্য, সিনেমা, শপিং মল বা উপহারের দোকান থেকে ই-সিগারেট সম্পর্কে শোনেন। বেশির ভাগ অংশগ্রহণকারী ই-সিগারেটের বিজ্ঞাপনগুলো সোশ্যাল মিডিয়া বিশেষ করে ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে দেখেছেন। অনেকে বন্ধুদের সঙ্গে তাদের প্রথম ই-সিগারেট সেবনের চেষ্টা করেন।

বেশির ভাগ অংশগ্রহণকারী ই-সিগারেটের বিজ্ঞাপনগুলো সোশ্যাল মিডিয়া বিশেষ করে ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে দেখেছেন। অনেকে বন্ধুদের সঙ্গে তাদের প্রথম ই-সিগারেট সেবনের চেষ্টা করেন

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন

ই-সিগারেটকে হিট-নট-বার্ন বা যে নামেই অবহিত করা হোক না কেন, এ ধরনের পণ্যকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ২০টি সিগারেটের সমান ক্ষতি করে একটি ই-সিগারেট। 

ই-সিগারেট ব্যবহারে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক বা ফুসফুসের ক্ষতি হতে পারে। এর মধ্যে যে উপাদানগুলো পাওয়া যায় তা শরীরের বিভিন্ন সেলকে বিকলসহ ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য দায়ী। এতে যে তরল পদার্থ (ই-লিকুইড) থাকে সেখানে প্রোপাইলিন গ্লাইকল, গ্লিসারিন, পলিইথিলিন গ্লাইকল, নানাবিধ ফ্লেভার ও নিকোটিন থাকে। এ রাসায়নিকগুলো গরম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সিগারেটের ধোঁয়ার সমপরিমাণ ফরমালডিহাইড উৎপন্ন করে। যা মানবশরীরের রক্ত সঞ্চালনকে অসম্ভব ক্ষতি করে।

ই-সিগারেটের ক্ষতির বিষয়ে জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘মানুষের ব্রেইন ডেভেলপমেন্ট (মস্তিষ্কের উন্নয়ন) ২৫ বছর বয়স পর্যন্ত চলমান থাকে। ই-সিগারেট ব্যবহারের কারণে শিশু-কিশোরদের এটি ব্যাহত হয়। ই-সিগারেট একটি নেশা তৈরি করে। আর নেশাগ্রস্ত হলে একটি মানুষ অসামাজিক হয়ে যায়। যখন সে ই-সিগারেট না পায়, তখন সে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে, ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। তার আচার-ব্যবহারে পরিবর্তন আসে।

ই-সিগারেটের ব্যবহারের ফলে ফুসফুসের কোষগুলো নষ্ট হতে হতে এমন অবস্থা তৈরি হয়, যা আর কখনওই ভালো হয় না / প্রতীকী ছবি

‘ই-সিগারেটের নিকোটিন আল্ট্রাসনিক, এগুলো ফুসফুসের কোষগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে শ্বাসতন্ত্রে রোগ তৈরি হয় এবং শ্বাস নিতে অসুবিধা হয়। ফুসফুসের কোষগুলো নষ্ট হতে হতে এমন অবস্থা তৈরি হয়, যা আর কখনওই ভালো হয় না।'

ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, টোব্যাকোর মাধ্যমে যে ক্ষতিগুলো হয় তার প্রত্যেকটি ই-সিগারেটের মাধ্যমে হয়। এটি মানুষের জন্য যে ক্ষতিকর, সেটি চিহ্নিত করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আন্দোলন হচ্ছে। মেডিসিন ও মানসিক চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত সোসাইটিগুলো ই-সিগারেটের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।

আমাদের শিশু-কিশোরসহ সব তরুণকে নেশার ছোবল থেকে রক্ষার জন্য একটি জাতীয় গাইডলাইন থাকা উচিত— জানিয়ে এ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, গাইডলাইনের মধ্যে তামাক বা তামাকজাত পণ্য নিষিদ্ধ থাকবে। ই-সিগারেট, ভ্যাপ বা সিসা— তরুণদের নেশার জগতে নিয়ে যায়, এমন সবকিছু নিষিদ্ধ করতে হবে। এর বিপরীতে তাদের জন্য খেলাধুলার মাঠ, বিনোদনের জন্য সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ব্যবস্থা রাখতে হবে। অর্থাৎ বিকাশমান শিশু-কিশোরদের যদি আমরা সৃজনশীল পথে পরিচালিত করতে না পারি তাহলে তারা নেশার বিষাক্ত নীল ছোবল থেকে বাঁচতে পারবে না।

২০টি সিগারেটের সমান ক্ষতি করে ই-সিগারেট। তারপরও তরুণদের মধ্যে এর ব্যবহার বাড়ছে / ফাইল ছবি

আমাদের দেশে এখনই ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করা উচিত— এমন দাবি তুলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত বলেন, ই-সিগারেট আসার পর প্রচার করা হলো যে এটি প্রচলিত তামাক তথা নিকোটিনে ভরপুর সিগারেটের চেয়ে নিরাপদ। উপরন্তু এটি প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপানকারীদের ধূমপানের অভ্যাস থেকে দূরে রাখতে কার্যকর। এভাবে প্রচার করা হলো। আসলে সেরকম কিছুই ঘটল না।

২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সিগারেটের বাজারের তিন-চতুর্থাংশ দখল করে নেয় নবাগত ই-সিগারেট। গতানুগতিক সিগারেটের চেয়ে নতুন এ সিগারেটের চাহিদা জনগণের কাছে বাড়তে থাকে। পরিকল্পনা অনুসারে এর মূল ক্রেতা প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপানকারী হওয়ার কথা থাকলেও তা হলো না। উল্টো অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোর-কিশোরীরা, যারা কখনও ধূমপানই করেনি, তারা এ সিগারেটের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ল। আসলে ই-সিগারেট বিভিন্ন আকার, স্বাদ ও গন্ধে পাওয়া যাওয়ায় তা সবার কাছে সমাদৃত হয়। তবে এর কুফল যে সাধারণ সিগারেটের তুলনায় কোনো অংশেই কম নয়, বিষয়টি অনেকেই অগ্রাহ্য করল। ২০১৯ সালের অক্টোবর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে ই-সিগারেট সেবনের ফলে ১৮ জনের মৃত্যু ঘটে। এক হাজারেরও অধিক মানুষ ফুসফুসের মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয়।

স্বাদ আর স্টাইলই ই-সিগারেট ব্যবহারের অন্যতম কারণ। এখনই এর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা উচিত— বলছেন বিশেষজ্ঞরা / ফাইল ছবি

ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত আরও বলেন, ইতোমধ্যে ভারতসহ ৫০টিরও বেশি দেশ, বিশেষ করে দক্ষিণ আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কোনো কোনো দেশ এ ধরনের সিগারেট কারও মালিকানায় থাকার ওপরও দিয়েছে নিষেধাজ্ঞা। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও নরওয়ে ই-সিগারেট ব্যবহারকারীদের ওপর বেশকিছু বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। আমাদের দেশেও ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করা এখন সময়ের দাবি।

এমএইচএন/এমএআর/